পঞ্চায়েত নির্বাচন তো নয়, যেন বাচ্চাদের লুডো খেলা! হারতে থাকলে দাও বোর্ড উল্টিয়ে! তবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা দেখলাম ধেড়ে বাচ্চাদের কাণ্ড। কোনওমতেই হারতে রাজি নয় তৃণমূল কংগ্রেস। তাই বোমা, বন্দুক দিয়ে বিরোধীদের মনোনয়ন আটকানো,মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো,ভোটের দিন ভোট লুঠ থেকে শুরু করে গণনার দিন হারা প্রার্থীকে জয়ের সার্টিফিকেট দেওয়া সহ নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি। দোসর পুলিশ আর বিডিও-এসডিও।

     কেবলমাত্র ভোট ডাকাতি? গোটা নির্বাচন পর্বে বেলাগাম হিংসায় এখনও পর্যন্ত প্রাণ গেছে বিভিন্ন দলের ৫৩ জন মানুষের। যার মধ্যে শাসকদলের মানুষরাও আছে। গ্রাম জ্বলেছে, মানুষ কেঁদেছে, এখনও কাঁদছে। মহামান্য আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন প্রশ্নে, সি সি টি ভি প্রশ্নে। ব্যালট বাক্স বদল, প্রদত্ত ভোটের থেকে ব্যালট বাক্সে সংখ্যায় বেশি ব্যালট পেপার। তারপর গায়ের জোরে সব লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে হেরোকে জয়ী আর জয়ীকে হেরো বানানোর অপকর্ম, নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার অর্থাৎ বিডিওদের সামনেই। তাদের প্রশ্রয় ও সমর্থনে।অর্থাৎ গণতন্ত্রের আদ্যশ্রাদ্ধ ঘটাল তৃণমূল গণতন্ত্র সম্প্রসারণের প্রতিষ্ঠান পঞ্চায়েতের নির্বাচনে।

       শুধু কি তাই? কয়েকহাজার নির্বাচন ও গণনাকর্মীর প্রাণের আতংক এবং তাদের পরিবারের লোকজনের অসীম উৎকন্ঠা তথা মানসিক যন্ত্রণাকে বিবেচনায় রাখতে হবে না? ভোটকেন্দ্র, গণনাকেন্দ্র ও ডি সি আর সি হিসেবে নেওয়া স্কুল-কলেজগুলিতে দরজা,জানালা,বেঞ্চ ভাঙ্গা, বোমাবাজি-গুলিবর্ষণ-অগ্নিসংযোগ হেতু এবং কল-পাখা-চেয়ার-টেবিল লুটের কারণে যে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে, বিবেচনায় রাখতে হবে তাকেও। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩৬  লক্ষ টাকা। সর্বোপরি গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে ক্ষতিসাধন এই কাণ্ডে হল তাও কি কম কিছু? কী শিখছে আমাদের নবীন প্রজন্ম? গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। ফ্যাসিবাদ কায়েমের রাস্তাকে খুলে দেবারই নামান্তর  এই ধরনের ভোট ডাকাতি।

        তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের সরকার দ্বারা নিয়োজিত দলদাস রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পাশাপাশি গণতন্ত্রের এই নিধন যজ্ঞের দায় থেকে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার কি মুক্ত থাকতে পারে? কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রশ্নে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও সেই প্রশ্নে চরম দীর্ঘসূত্রিতার জন্য দায়ী নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা। বিজেপি-তৃণমূলের সেটিং-এর   এর চাইতে বড়ো উদাহরণ আর কী হতে পারে? আর এরই প্রতিদানস্বরূপ ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড’ গণনায়  বিজেপিকে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়েছে? কারণ পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত বিকল্প বাম ও সহযোগীদের নগণ্য ও অপ্রাসঙ্গিক করে দেখানোই ওই সেটিং-এর এবং কর্পোরেট মহলের উদ্দেশ্য। কিন্তু এত কিছুর পরেও ওই কলঙ্কিত গণনার ফলাফলে দেখা গেল বিগত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের সাপেক্ষে বাম ও সহযোগী শক্তির ভোট বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ এবং বিজেপি’র ভোট কমেছে ১৬ শতাংশ। এই তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে যদি জনমতের প্রতিফলন ঠিকভাবে ঘটতে পারত, শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ধরাশায়ী হতই হত।

     এখন আসা যাক প্রশাসনিক অর্থাৎ সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের কথায়। এই কর্তাদের দায়িত্ব ছিল মানুষ যাতে অবাধে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করা এবং একইসাথে মানুষের প্রদত্ত ভোটের নিরাপত্তা বিধান করে সঠিকভাবে ফলাফল প্রকাশে তদারকি করা। কিন্তু তা তো তারা করলই না, উল্টে শাসকদলের হয়ে যতরকমের অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব করা যায় করল। এমনকি বিরোধী দলের এজেন্টদের মেরে বের করে দিল এবং গুলি চালিয়ে মানুষ মারল। জনগণের করের টাকায় বিপুল অঙ্কের বেতনভুক এই বিডিও, ওসি,আই সি-দের বিরুদ্ধে কেন জনস্বার্থে মামলা হবে না? উচ্চপদস্থ এইসব আধিকারিকরা কীসের টানে এই বেআইনী কাজে লিপ্ত হল তা সমগ্র রাজ্যবাসীর জানা প্রয়োজন। ওরা তো ভালো বেতন পায়, এমনকি সাধারণ কর্মচারীরা না পেলেও ওরা ডি এ পেয়েছে। তাহলে? তৃণমূলের চুরির ভাগ কি ওরা পায়? সেই লোভে? এই প্রশ্নের উত্তর চাই-ই চাই।

      এই নির্বাচনে বাম ও সহযোগীদের আহ্বান ছিল দুর্নীতিমুক্ত জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলা। এই লক্ষ্য সাধনে জনগণ ছিল প্রস্তুত। উল্টোদিকে বিপুল চুরি ও তার থেকে পাওয়া ভাগের অংশস্বরূপ বিপুল উপার্জন হারাবার ভয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ভীত ছিল। তাই যেনতেন প্রকারে জেতার জন্য তারা মরিয়া ছিল। ফলস্বরূপ ঘটেছে সংঘর্ষ, গড়ে উঠেছে প্রতিরোধও। গত কয়েকবছরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূলের গুন্ডামির পরোয়া না করে এইভাবে জনগণের প্রতিরোধে সামিল হওয়া এবং বোমা-গুলির সামনে অকুতোভয়ে জীবন বলিদান এক অতীব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জনগণের এই প্রতিরোধী মেজাজে শাসকদল আরও ভয় পেয়েছে। তাই আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। যেভাবে কেউটে সাপ ভীষণ ভয় পেয়ে ছোবল মেরে বসে। এই প্রসঙ্গে যেটা বলার কোনও কোনও স্বঘোষিত অতিবোদ্ধা সমাজ মাধ্যমে রাস্তার লড়াইয়ের বদলে বামপন্থীরা অতিমাত্রায় আদালত নির্ভর হয়ে পড়ছে বলে অভিমত পোষণ করছেন। এই কথায় তাঁরা বিগত দিনগুলিতে বঞ্চিত  নিপীড়িত শ্রমিক-কৃষক-যুবকদের রাস্তার লড়াই এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্বে রক্তক্ষয়ী, জীবন বিপন্ন করা রাস্তার লড়াইকে ছোটো করে ফেলছেন। তুমুল রাস্তার লড়াইয়ের পরেও যখন আইনের রক্ষকরা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইতিহাসের চাকাকে পিছন দিকে ঠেলার চেষ্টা করেন তখন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হবে বৈকি! সেক্ষেত্রে রাস্তার লড়াই বন্ধের কথা হচ্ছে কোথায়? রাস্তার লড়াই অতীতেও হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। যতদিন না মানুষ তার অধিকার আদায় নিশ্চিত করতে পারছে।

      এবার আবার আসা যাক সেটিংবাজদের কথায়। অর্থাৎ তৃণমূল-বিজেপির কথায়। তৃণমূলের সব খেলা ধরা পড়ে গেছে। নির্বাচনের আগে থেকেই  মানুষ ওদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছিল। ভোটের গণনার পরে সেই ক্ষোভ দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী দিনের গণআন্দোলনে সেই ক্ষোভ ফেটে পড়বে। এমনকি তৃণমূলের অন্দরে এইভাবে ভোট ডাকাতির  প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। অনেক তৃণমূল প্রার্থী এভাবে জয় হাসিল মেনে নিতে পারেনি। নৈতিকভাবে তৃণমূলের মানুষের সামনাসামনি দাঁড়ানো মুশকিল। আর বিজেপিও জানে গোটা নির্বাচনী সংগ্রামে প্রতিরোধে তারা ময়দানে ছিল না। ফলে সেটিং-এ দ্বিতীয় হওয়া তাদের কোনও  আয় দেবেনা। এখন লড়াই এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে। যে লড়াই চলবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাম ও সহযোগী দলগুলির শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে।

        আগামী লোকসভা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো,ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। তাই এগুলির সামনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকারী বিজেপিকে হারাতেই হবে। এক জায়গায় আসতে হবে বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তিকে। তবে তার মধ্যে একটা ‘কিন্ত’ আছে। তৃণমূল কি বিজেপিকে প্রকৃতপক্ষে হারাতে চায়? সর্বভারতীয় বিরোধী জোটে আর এস এসের নির্দেশে ওরা অনেকদিন ধরে ঘোঁট পাকিয়ে আসছে। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী ধনকড়কে সমর্থন দিয়েছিল ওরা। তৃণমূল চোর, গণতন্ত্র হত্যাকারী, বিজেপির সাথে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিযোগিতা করে। চুরিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত। তার থেকে বাঁচার জন্য বিজেপির দয়ার ওপর নির্ভরশীল। ওদের দুই নম্বর নেতা, সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক কয়লা পাচার কাণ্ডে ফেঁসে আছে। ওদের পক্ষে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। তবু ওরা নির্লজ্জের মতো পাটনা, বেঙ্গালুরুর সভায় যায় ও যাবে। তৃণমূলের সংস্পর্শ এড়ানোর জন্য সীতারাম ইয়েচুরি কেন ওই সভাগুলিতে অনুপস্থিত  থেকে বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ের মঞ্চ থেকে সিপিআই-এমকে বিযুক্ত করে দেবেন? কেন তৃণমূলের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন সিপিআই-এম বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তরিক নয় বলে প্রচার করার? সুতরাং কূটনৈতিক সংগ্রাম চলবে। আর পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই গড়ে উঠবে তৃণমূল- বিজেপির বিরুদ্ধে। ওদের কোনও ক্ষমা নেই। যেমনভাবে ১৯৭২-এর রিগিং-এর নির্বাচন সির্দ্ধার্থশংকরের কাছে পরবর্তী সময়ে কলঙ্ক ও বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল, প্রচারে প্রচারে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনও হবে তৃণমূলের বিভীষিকা। সেই মর্মে প্রস্তুতি ও জনসংযোগই  এখন জরুরী।

      শপথ নাও, তৈরি হও।