বৃহস্পতিবার ১৫ ই জুন পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁর দলের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন আটকানোর অভিযোগের মোকাবিলা করার জন‍্য অদ্ভুত কৌশল নিলেন। তিনি ডায়মণ্ডহারবারে দলীয় কর্মসূচিতে ঘোষণা করলেন,”যারা আক্রমণ করেছে সন্ত্রাস করেছে তারা তৃণমূল কংগ্রেসের কেউ নয়!” অভিজ্ঞতা বলছে এই ঘোষণার ফলে ভোটপর্বে অবাধ সন্ত্রাসের লাইসেন্স দেওয়া হল দলের প্রত‍্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া দুষ্কৃতীদের। ধরা পড়লে অপেক্ষাকৃত লঘু ধারায় কেস দেওয়া হবে সে তো মুর্শিদাবাদেই দেখা গেছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে এমন ভাবা নির্বুদ্ধিতা হবে। যখন মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় দলের গা থেকে সন্ত্রাস ও হিংসাত্মক প্ররোচনার অভিযোগ যখন ঝেড়ে ফেলার অজুহাত পেয়েছেন তার কাছাকাছি সময়েই মনোনয়ন পর্বে হিংসা অরাজকতা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশি ব‍্যর্থতা প্রকট হতে দেখে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ,বাহিনীকে মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা যদিও বলেছেন তাঁরা হাইকোর্টের নির্দেশ পালন করবেন,কিন্তু তাঁর এবং তাঁর সংস্থার সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে,কেননা ১৫ই জুন বিকেল অবধি পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপর্বে প্রাণহানির কোন খবর নেই নির্বাচন কমিশনে। অথচ বাস্তবিক মোট তিনজন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছেন গত পাঁচদিনে। যাঁদের মধ‍্যে দু জন আই এস এফের একজন শাসক দলের। বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন পত্র দাখিল করার সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যেখানে পুলিশ নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় ছিল। বিশেষত উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় তৃণমূল বিধায়কের বাড়ির দেড় কিলোমিটারের মধ‍্যে সিপিআই(এম ) এর প্রার্থীদের নিয়ে মনোনয়ন দেওয়ার মিছিলে তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতীরা গুলি চালায় যাতে প্রার্থীসহ দশজন গুরুতর জখম হন।

ভাঙড়ে বিডিও অফিস দখল নিয়েছিল তৃণমূল কর্মীরা। আই এস এফ ও সিপিআই(এম) কর্মীরা ব‍্যাপক জমায়েত করে নিজেদের মনোনয়ন নিশ্চিত করেন ঠিকই কিন্তু ভাঙড় থানা ও কাশীপুর থানার পুলিশের ভূমিকা ছিল শাসকদলের নেতাদের মতো। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলাতেও। সেখানেও পাল্টা প্রতিরোধ হয়। কিন্তু দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ক‍্যানিংয়ে প্রার্থী বাছাই নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষ যেমন চলে তেমনি চলে সিপিআই(এম) পার্টি অফিসে নেতা কর্মীদের আটকে রেখে ব‍্যপক মারধর, যাতে কোনভাবেই কেউ মনোনয়ন জমা দিতে না পারে। নির্বাচন কমিশন কোথাও কোন ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারেনি। ডায়মণ্ডহারবার থেকে ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিলেন, ভাঙড় বা চোপড়ার ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবেই তৃণমূল যুক্ত নয়।তিনি বলেছেন, প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে, সেই কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে।তাঁর কথায়,, ‘এত বিস্তৃত এলাকায় ভোট হচ্ছে। তার মধ্যে তিনটে অঞ্চলে তিনটে অঞ্চলে গোলমাল। এ সবে আমাদের দল কোনও ভাবেই যুক্ত নয়। সমস্ত দিক থেকে আমাদের আমাদের দলের বিভিন্ন স্তরে জোরের সঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শান্তি বজায় রাখার। যে যাঁর মতো নমিনেশন জমা দেবে।’ এর পরেই চমকে দেওয়ার মতো একটি পরিসংখ‍্যান দিলেন মুখ‍্যমন্ত্রী, ‘২০০৩ সালে সিপিএম-এর আমলে ৩৬ জন মারা গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে ৩৯ জন মারা গিয়েছিলেন, যে বার মীরা পাণ্ডে কমিশনার ছিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ভোট করা হয়েছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সমস্যা একটাই। একটা বাড়ি থেকে বিভিন্ন মানুষজন দাঁড়িয়ে পড়ছেন ভোটে। সেই নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোথাও কোথাও ঝামেলা হচ্ছে।’রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন সম্ভবত মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছেন এবার বিজেপি নয় বামপন্থীরাই তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ। সম্ভাব‍্য আসন সংখ‍্যার বিচারে নয় প্রভাব প্রতিপত্তি তেই এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআই(এম) তৃণমূল কংগ্রেসকে চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে।

উপরন্তু বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় স্তরে ভাঙন ধরছে। ঘাসফুল ছেড়ে অনেকেই লাল ঝাণ্ডা অথবা কংগ্রেসের পতাকা ধরছেন। অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের নবজোয়ার যাত্রার শেষপর্বে তাই ডায়মণ্ডহারবারে বক্তব্য রাখার সময় তিনি বামফ্রন্ট সরকারের আমলকে আক্রমণ করলেন। বিকালে কলকাতার সরোজিনী নাইডু সরণীতে রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরে রাজ‍্য বামফ্রন্টের বিক্ষোভ সমাবেশের লড়াকু মেজাজের খবরও তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সময়মতোই। ফলে, ২০২১ এর বিধানসভার ভোটের মতো পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে এসে বসিয়ে রাখা হবে অথবা স্থানীয় থানার পক্ষ থেকে তাদের বিভ্রান্ত করা হবে সেই সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ও তাদের অধীন নির্বাচন কমিশন অবাধ শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর সদিচ্ছা কারুর নেই। বাম ও গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি কে একজোট হয়ে প্রচার থেকে গণনা পর্যন্ত সর্বোচ্চ সক্রিয়তা নিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ যাতে নিজের ভোট নির্ভয়ে নিজে দিতে পারেন তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে।