
বড়ঞা থানার ওসি সাহেব অযথা টেনশন করবেন না। কাটমানি নিয়ে আপনার বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ এখন অস্বস্তিতে পড়বেন না। কারণএই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং দুর্নীতি শব্দ দুটি আজ কার্যত সমার্থক হয়ে গেছে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ সহ স্থানীয় প্রশাসনের একাংশকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রাখা তৃণমূল কংগ্রেসের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার কৌশল। এটা ঘটনা,সব তৃণমূল কর্মী সমর্থক দুর্নীতিগ্রস্ত না হলেও দুর্নীতিকে আঁকড়ে না ধরলে তৃণমূলের নেতা হওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলে পদোন্নতি হয় দলকে টাকার অঙ্ক কে কতখানি নিশ্চিত করতে পারবেন তার মাপকাঠিতে। দল দুর্নীতিগ্রস্ত কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা যেন তেন প্রকারে ভোটে জিতে ক্ষমতায় থেকে যাবেন – এই দুটি ব্যাপারেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ও নেতারা প্রবল আত্মবিশ্বাসী। শাসক দলের দু চারজন তরুণ নেতা নিজেদের মধ্যেই ঠাট্টা ইয়ার্কি করেন, বাংলা ভাষা না জানা কোন ব্যক্তি এই রাজ্যে পা রেখে সংবাদ মাধ্যমে কান পাতলে বার বার শুনতে শুনতে নাকি একটি বাক্য শিখে যান,”অভিযোগের তীর তৃণমূলের দিকে!”
পঞ্চায়েত স্তর থেকে পৌরসভা হয়ে কর্পোরেশন এবং বিধায়কের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের বরাদ্দকৃত অর্থ ঠিকাদারদের হাতে আসার আগে কেষ্ট বিষ্টুদের মধ্যে যেভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে যায় তা এখন মিডিয়ার দৌলতে “কাটমানি” হিসাবে পরিচিত। পরিবর্তনের পরের পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের ঢাক ফেঁসে যায় এই কাটমানির কোপেই। তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকরা এরই পাশাপাশি হাত বাড়ান এলাকায় বহুতল বাড়ির নির্মাতাদের দিকে। জমি কেনা থেকে বাড়ির ইঁট গাঁথা,ঢালাই সবেতেই ভাগ চাই এমনকি সঙ্গে সঙ্গে সিণ্ডিকেটে বালি পাথর ইঁটের বরাতও চাই। সিণ্ডিকেটের শর্তও চমৎকার! পয়সা দিয়ে কিনেও জিনিস পত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন করা চলবে না। আমাদের আশেপাশের সমাজ কখনোই ষোল আনা দুর্নীতিমুক্ত ছিল না। সরকারি ও পৌরসভার নাগরিক পরিষেবা পেতে অবৈধভাবে টাকা পয়সার লেনদেনের অভিযোগও তৃণমূল জমানার আগে বিরল ছিল না। কিন্তু বরাদ্দকৃত একশো টাকার পঁচাত্তর টাকাই “কাটমানি ” দিয়ে ঠিকাদার বাকি পঁচিশ টাকায় একশো টাকা খরচের কাজ শেষ করবেন – এমন পরিস্থিতি তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কারণেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর যথেষ্ট কারণ এই সময় পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় কান পাতলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ফলে মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানার ওসি সাহেব কালিপূজোর জলসার মঞ্চে উঠে যতই উপদেশ দিন” এক দুই পার্সেন্টের বেশি খাবেন না!” বাংলার ছবি বদলাবে না। এই কাটমানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে পঞ্চায়েত পৌর নির্বাচন থেকে বিধানসভা নির্বাচন অবধি জয় নিশ্চিত করতে দলের মধ্যেকার দ্বদ্ব বিভেদ তুলে রেখে এক কাট্টা হয়ে নেমে পড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ও নেতারা। অর্থের বন্ধন এখন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে রক্তের বন্ধনের চেয়েও বেশি দামী।
চিটফাণ্ডের লেনদেনে উপকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রী সহ ঘাসফুল ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি সাংবাদিকদের নাম উঠে এসেছে। সারদা, রোজভ্যালি,এম পি এস,আইকোর প্রভৃতি চিটফাণ্ডে জনগণের জমানো টাকা ফেরত না দিয়ে তা রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আনন্দময় বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তুলে দেওয়া এবং ২০০৭ থেকে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের নামে কুৎসা করে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে জনসমর্থন নিয়ে আসার জন্য নিত্য নতুন টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজ বাজারে নিয়ে আসা একটা বিরাট রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ যার অনেকটাই ইতিমধ্যেই জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণে এই বিষয়ে তদন্ত চাপা পড়ে যাওয়ায় অভিযুক্তরা নিশ্চিন্তে আছেন। যদিও গরুপাচার কয়লা পাচারের তদন্তেও পুরোন অভিযুক্তদের অনেকের নাম দেখা যাচ্ছে। চিটফাণ্ড কাণ্ডে হাজতবাস করা সাংবাদিক ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ কুনাল ঘোষ দলের সর্বোচ্চ নেযী মমতা ব্যানার্জীর নামে প্রকাশ্যে দুর্নীতির অভিযোগ করা পরেও ক্ষমা না চেয়েও তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান মুখপাত্র টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে ডিগবাজি খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,” বিষয়টি বিচারাধীন তাই মিডিয়ায় এই নিয়ে মন্তব্য করা যাবেনা ! কিন্তু মনে রাখবেন সে সময়ও আমি দলকে সাংসদ হিসাবে আমার জন্য ধার্য টাকা দিয়ে এসেছি।
বোঝাই যায় দলের জন্য টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে তৃণমূল কংগ্রেসে সাতখুন মাফ। এমনকি দলনেত্রীকে প্রকাশ্যে ” দুর্নীতিগ্রস্ত ” বলেও পার পাওয়া যায়। শাসকদলের সর্বোচ্চ নেত্রীর এই সহিষ্ণুতা অবশ্যই একদেশদর্শী নয়। অনুব্রত মণ্ডল,মানিক ভট্টাচার্য যেমন এই সাপ্লাই লাইনের কারণেই দলের নেত্রীর ঘোষিত জিরো টলারেন্সের নীতি সত্ত্বেও জেলে ঢুকেও স্বপদে বহাল রয়েছেন। একজন তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলার সভাপতি এবং অন্যজন নদিয়া জেলার পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক। দুজনের নামেই বিপুল অঙ্কের আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ। অবশ্য চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারির অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁদের মধ্যে যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গেছেন তাঁরা বাদে সবাই আজও স্বমহিমায় দলে রয়ে গেছেন। বিজেপিও ভোটের খাতিরে মুকুল রায় কে দলে নিতে দ্বিধা করেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযুক্ত অনেক নেতা নেত্রীর সঙ্গেই বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সখ্যতা সর্বজনবিদিত। মাঝে মাঝে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়লে বিতর্কের পারদ চড়ে।
তবে গত ৫৯২ দিন ধরে নিয়োগের দাবিতে টেট উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীদের অবস্থান এই রাজ্যের দুর্নীতির সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির কারণেই এই চাকরিপ্রার্থীরা যোগ্যতার মাপকাঠি পেরিয়েও নিয়োগপত্র থেকে বঞ্চিত। টাকার বিনিময়ে প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদের চাকরি বিক্রি করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিস্বরূপ ইতিমধ্যেই আদালতের নির্দেশে কিছু শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। আরও মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে। মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিয়োগপত্র পাননি,প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নতুন সভাপতি গৌতম পালের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২২ এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পরীক্ষায় না বসলে তাঁরা কেউ চাকরি পাবেন না। শুধু তাই নয়, চল্লিশ বছর বয়স যাঁদের পেরিয়ে গেছেন -যা শুধুমাত্র শিক্ষা দপ্তরের কর্তাদের দুর্নীতির কারণে -তাঁরা চিরতরে নিয়োগপত্রের সুযোগ হারাবেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী এখনো পর্যন্ত উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা এবং শূন্য পদের পূর্ণ তালিকা এখনো জানানো হয়নি। শূন্য পদের যে তালিকা ২০২২ সালের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে তা অসম্পূর্ণ। ক্ষোভ ক্রোধ স্বাভাবিকভাবেই দানা বাঁধছে বঞ্চিত নিয়োগ প্রার্থী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মনে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বিধাননগরের করুণাময়ীতে তাঁদের অবস্থানের ওপর পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাজনৈতিক রং লাগিয়ে এবং এই চাকরি প্রার্থীদের দাবিকে “অন্যায্য অবৈধ” হিসাবে চিহ্নিত করে এঁদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে সরকার ও তৃণমূল কংগ্রেস। পরিকল্পিতভাবে আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুটি সত্য,১) গত দশ বছরে যত শিক্ষক পদে নিয়োগ হয়েছে তার অধিকাংশই বেআইনি পথে এবং ২) শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভাঁওতার কারণে আট বছরের মত সময় নষ্ট হয়েছে এই প্রতারিত চাকরিপ্রার্থীদের।
আন্দোলনরত নিয়োগপ্রার্থীরা অনেকেই গ্রামবাংলার বাসিন্দা। তাঁদের বৃহত্তম অংশের সমর্থন ছিল শাসকদলের পক্ষে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই পরিবারগুলির ক্ষোভ আগুনের মত ছড়িয়ে পড়া কতটা আটকাতে পারবে তৃণমূল কংগ্রেস তার ওপরেই সাফল্য অনেকখানি নির্ভরশীল। গা জোয়ারি এবং কারচুপির ভোট মেশিনারির ওপরে আগামীদিন মাত্রাতিরিক্ত ভরসা রাখতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসকে। কারণ এককথায় রাজনৈতিকভাবে তারা এইমূহুর্তে কোণঠাসা।