প্রেমচাঁদ বড়াল , লালচাঁদ বড়াল, রাইচাঁদ বড়াল ,এঁরা সকলেই বাংলা সংগীত জীবনকে নিজেদের মেধা, মননশীলতা দিয়ে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন ।বাংলা কাব্য সংগীতের বিবর্তনে কলকাতার বড়াল বাড়ির ভূমিকা ঐতিহাসিক ।সেই বাড়ির সন্তান হিসেবে বাবুল সুপ্রিয় নিজের সংগীতপ্রতিভা কে পিতৃপুরুষের ধারা থেকে খানিকটা ভিন্ন খাতেই প্রথম থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। বিনোদন জগতের বাইরে সামাজিক ক্ষেত্রে এই বাবুল সুপ্রিয় কে আমরা কখনও কোন অবস্থাতেই সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখে নি, যেমনটা রাইবাবুকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছিলাম।


২০১৩-১৪ সালের আগে নিজের পেশা জগতের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যেই বাবুল নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। একটি বহুল প্রচলিত পত্রিকাতে স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ লিখে তিনি জানিয়ে ছিলেন ,আরএসএস বৃত্তের অত্যন্ত অন্দরের মানুষ, স্বঘোষিত ধর্মগুরু রামদেব তাকে কিভাবে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রাঙ্গনে কে নিয়ে এসেছিলেন ।বুর্জোয়া রাজনীতির একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সামাজিক বা আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা ,এই বুর্জোয়া রাজনীতির আওতার মধ্যে এসে হঠাৎ করেই নেতা হয়ে যান। রাজনীতির দৈনন্দিনতায় এদের খুব একটা আকর্ষণ কিন্তু কখনই থাকেনা ।এদের রাজনীতির ক্ষেত্রে সবথেকে বড় আকর্ষণ হলো, সংসদীয় ব্যবস্থা ।সংসদীয় রাজনীতির ধারা প্রবাহে নিজেদেরকে যুক্ত করতে না পারলে এই ধরনের মানুষেরা রাজনীতি করবার সার্থকতা খুঁজে পান না।


এটা আমরা বাবুল সুপ্রিয়র সংগীতশিল্পী থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার এই যে সময়কাল টা ,তাতে খুব গভীরভাবে সে জিনিসটা দেখতে পেয়েছি। বাবুল নিজেই লিখেছেন ,স্বঘোষিত ধর্মগুরু রামদেবের প্রভাবে তিনি বিজেপি রাজনীতির কর্মকাণ্ডের প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেন। রামদেব হলেন এমন একজন রাজনৈতিক হিন্দু পরিবৃত্তের সফল ব্যবসায়ী , যিনি পেশা জীবনকে অক্ষুন্ন রেখে ,হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার নানা দিক কে ব্যবহার করে, দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির পক্ষে একটা জোরদার সামাজিক প্রযুক্তির প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছেন ।


রামদেবের যে ব্যবসায় সংগঠন পরিচালনা করেন, সেই সংগঠনটিতে যে ধরনের ওষুধ পত্র বাজারজাত করে, তাতে নানা ধরনের কেমিক্যাল যৌগ থেকে শুরু করে, পশুপাখি, মানুষজনের হাড়গোড় পর্যন্ত ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ একটা সময়ে এনেছিলেন বিশিষ্ট সি পি আই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত ।অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ওঠা এই অভিযোগগুলি সেই সময়ের সরকার, বা পরবর্তীকালে ডঃ মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার তাদের দশ বছরের শাসনকালে সঠিক তদন্তের ভেতর দিয়ে একটা সত্যি উপনীত হবার কোনো চেষ্টাই কিন্তু কখনো করেননি ।আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনে একটা বিরক্তির জায়গা তৈরি করে ,প্রাচীন ভারতীয় জড়িবুটি র নানা ধরনের গুনাগুন কে মানুষের মনে গেঁথে দিয়ে ,চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা ধরনের ওষুধ পত্র ইত্যাদির ব্যবসা ভেতর দিয়ে আরএসএসের যে রাজনৈতিক কর্মসূচি, অর্থাৎ; হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, বিভাজনমূলক চিন্তা চেতনার প্রকাশের ভেতর দিয়ে, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় একটা বড় রকমের মেরুকরণের পরিবেশ তৈরি করে, সেই পরিবেশ কে ব্যবহার করে ,আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা — এই গোটা প্রক্রিয়াটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে রামদেব এবং তার প্রতিষ্ঠানের কাজ করে চলেছে।


সেই সংগঠন এবং সংগঠনের কর্মকর্তাদের ভেতর দিয়েই কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সঙ্গে গায়ক বাবুল সুপ্রিয়র পরিচয় সংযোগ এবং ঘনিষ্ঠতা। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে তিনি আসানসোল লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ।জেতেন।মোদি মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান ।২০১৯ সালে ও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ।জেতেন ।আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান । এই ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এবং তাদের হাজার রকমের সহযোগী সংগঠন, আর তাছাড়াও তাদের বৃত্তের মধ্যে সরাসরি না থেকেও ,তাদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে কাজ করে যারা, সেই তৃণমূল কংগ্রেসের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যে দাঙ্গা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় ,তার ভয়াবহ রেশ পড়েছিল গোটা আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে এবং ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে।


আসানসোলে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে নিজেদের থাকার ঘটনা কে ব্যবহার করে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চালায় । এক ইমামের শিশুপুত্র সেই দাঙ্গায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন ।ইমাম সাহেব কিন্তু নানা ধরনের প্ররোচনা সত্ত্বেও কোনো অবস্থাতেই, কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে তাঁর পুত্রের হত্যা ঘিরে কোনরকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রতিশোধের মানসিকতার মধ্যে না যায়, তার জন্য কার্যত আমাদের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর মত এক অসামান্য সামাজিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গোটা আসানসোলের সাধারণ মানুষ ,এমনকি হিন্দু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে যারা বিগত লোকসভা নির্বাচনে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির প্রতি তাদের সমর্থন উজার করে দিয়েছিল ,তেমন মানুষ ও ,কখনো কোন অবস্থাতেই তাদের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়ের নেতৃত্বাধীন যে ভয়ঙ্কর বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে গোটা আসানসোল জুড়ে মর্মান্তিক দাঙ্গার আগুন জ্বলেছিল, সেই বীভৎসতাকে কখনো কোনো অবস্থাতে সমর্থন করতে পারেন নি। আসানসোলের দাঙ্গা প্রশমন করার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। কার্যত গোটা আসানসোল কে দাঙ্গার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস দলটি এবং তাদের পরিচালিত রাজ্য সরকার।
গোটা পরিস্থিতি যাতে কেবলমাত্র আসানসোল লোকসভা কেন্দ্র টির মধ্যে নয়, সংলগ্ন কয়লা খাদান থেকে শুরু করে, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল হয়ে ,কৃষি সমৃদ্ধি সম্পন্ন বর্ধমান জেলা কে অতিক্রম করে ,গোটা বাংলা জুড়ে সেই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে ,তার জন্য যারা সবথেকে বেশি সক্রিয় ছিল তাদের ভিতরে প্রথমেই বাবুলের নামটি করতে হয়। বিজেপি সাংসদ তথা সেই সময়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় ওই দাঙ্গার কালে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দাঙ্গাকারীদের সংগঠিত করতে ,দাঙ্গার বিস্তার ঘটাতে এবং একতরফাভাবে আসানসোল অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর হত্যা, লুঠতরাজের টনা সংঘটিত করতে আরএসএস বিজেপি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন আজকে বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে যাকে তৃণমূল কংগ্রেস নিজের দলের প্রার্থী করেছে, সেই বাবুল সুপ্রিয়।
বিগত ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ,বাবুল যখন প্রথম আসানসোল কেন্দ্র থেকে জিতে বিজেপি সাংসদ হিসেবে সংসদে প্রবেশ করেন, তখন থেকে, বিজেপি দলে অবস্থানরত অবস্থার সময়কাল পর্যন্ত যদি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, তার প্রতিটি পদক্ষেপের ভেতরে কেবল হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থানই তীব্র ছিল না। মুসলমান বিদ্বেষী হিসেবে বিজেপিতে অবস্থানরত অবস্থায় বাবুল এক মারাত্মক বিদ্বেষ ,বিভাজনের রাজনীতি করে গিয়েছেন। বিজেপিতে অবস্থানরত অবস্থায় তার যে সমস্ত টুইট বা সামাজিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য বা খবরের কাগজে বক্তৃতার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, প্রত্যেকটি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে ভয়ঙ্কর বিদ্বেষের বিষে জর্জরিত। বাবুলের তীব্র মুসলমান বিদ্বেষের রাজনৈতিক পটভূমিকা, সেইখানটাতে আমাদের বিশেষ ভাবে মনে রাখা দরকার ,সংগীতশিল্পী হিসেবে যে পেশাগত জীবন বাবুলের ছিল, সেখান থেকে হঠাৎ করে তার বিজেপি প্রার্থী হিসেবে আসানসোল কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ,এই গোটা পর্যায়ক্রমটার ভেতরে ভয়ঙ্কর রকমের প্রভাব কাজ করেছিল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে সিম্প্রদায়িক খাতে বইয়ে দিতে সঙ্ঘের উদ্যোগ।বস্তুত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতরে ধর্মান্ধ চেতনার অনূপ্রবেশ করিয়ে, যুব সম্প্রদায় ,যারা গান-বাজনা ইত্যাদিতে বর্তমান সময়ের ভাবধারার সঙ্গে সাযুজ্য অনুভব করেন ,সেই অংশের মানুষদের ভেতরে কেবলমাত্র হিন্দুত্ব নয়, তার পাশাপাশি চরম মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া।এই যে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ভেতর দিয়ে যে কর্মকান্ড আমাদের এই রাজ্যে আরএসএস চালিয়েছে ,সেই কর্মকাণ্ড সম্পাদনায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শিবিরের আড়কাঠি হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন এই বাবুল সুপ্রিয় ।


বাবুলের সেই ভূমিকাই আমরা বিজেপি সাংসদ হিসেবে আসানসোল ঘিরে, গোটা কয়লার শিল্পাঞ্চলকে ঘিরে যে আর্থসামাজিক পরিবেশ বিবর্তিত হয়, সেখানে পরিস্ফুট হতে দেখেছি। সেই পরিস্ফুটন ই আমরা দেখেছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ,বাবুল যে মেরুকরণের রাজনীতি যাদবপুরে প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন তার ভিতরেও। সেই প্রেক্ষাপটের ভেতরে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাবুল সুপ্রিয়র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে মেরুকরণের রাজনীতি কে আড়াল করার জন্য রাজ্যপাল জাগদীপ ধনকার, যিনি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের রক্ষক হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি ,তথা রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে এই রাজ্যে নিযুক্ত ,তিনি প্রত্যক্ষভাবে বাবুলের সেই মেরুকরণের রাজনীতি কে প্রশ্রয় দেয়ার উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে।


নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ায় নানা ধরনের রঙ্গরসিকতা অভিনয়ের পর তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন বাবুল।তৃণমূল তাকে কিভাবে তাদের রাজনৈতিক দলে পুনর্বাসিত করবে ,সেটা ঘিরে অনেকেরই একটা প্রবল উৎসাহ ছিল। অবশেষে সেই উৎসাহের অবসান হয়েছে। তৃণমূল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের শূন্য আসনে বাবুল সুপ্রিয়কে প্রার্থী করেছে। প্রশ্ন হল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়ার ফলে বাবুলের বিজেপি ত্যাগ করার পর কি একটি বারের জন্যেও বাবুর বিজেপির মূল মস্তিষ্ক ,আরএসএস সম্পর্কে একটাও সমালোচনামূলক শব্দ উচ্চারণ করেছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন অটল বিহারি বাজপেয়ির সময়কালের বিজেপির প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন, যদিও সেই সময়ে তিনি লালকৃষ্ণ আদবানির সমালোচকের ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছিলেন, আর এখন লালকৃষ্ণ আদবানির অনুরাগী, অনুগামী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন ,কিন্তু একটিবারের জন্যেও বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএসের সমালোচনা করেন না ।ঠিক তেমনি এই বাবুল সুপ্রিয় ,নরেন্দ্র মোদির নিয়ন্ত্রণাধীন, অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিজেপি সম্বন্ধে অনেক অরাজনৈতিক, ব্যক্তিগত বিদ্বেষমূলক কথা বলা সত্বেও ,একটিবারের জন্য কিন্তু বিজেপির মস্তিষ্ক আর এস এস সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সমালোচনা করেন নি ।
আর এস এস সম্বন্ধে বাবুল সুপ্রিয় নীরবতায় কিন্তু প্রমাণ করে যে, আরএসএস যেখানে দেখতে পায় ,তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সংসদীয় রাজনীতিতে প্রতিপত্তি বিস্তারের কাজটি আশানুরূপভাবে হচ্ছে না ,সেখানেই তারা তাদের পরিমণ্ডলের ভেতরে থাকা ,অথচ নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ,অমিত শাহের সঙ্গে ,বা তাদের অনুরাগী ,অনুগামীদের সঙ্গে সংঘাতের ভূমিকায় অভিনয় করা ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক ভিত্তি সং,সদীয় রাজনীতিতে অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সব রকম ভাবে কাজ করে যায়। আরএসএসের এই রাজনৈতিক লক্ষ্য পথ থেকেই কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন এন ডি এ তে ছিলেন বিগত শতকের নয়ের দশকের শেষের দিকে।


আরএসএস ভক্ত ,আরএসএসের ছোকে দেওয়া পরিকল্পনা অনুযায়ী একটা সময় মুসলমান সমাজ সম্পর্কে খিস্তিখেউড় করা, অথচ তৃণমূলের প্রার্থী এখন বাবুল। ফেজটুপির আশ্রয় নিয়ে এক ধরনের সুদক্ষ অভিনেতা হিসেবে নিজেকে দেখানো বাবুল সুপ্রিয়ের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হওয়া। আমরা খুব ভালোভাবেই দেখেছিলাম গত এক বছর আগে ,২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি, ছুপা রুস্তম সাম্প্রদায়িকতা, ভয়াবহ পরিবারতন্ত্র, এইসবের বিরুদ্ধে মানুষের ভেতরে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, বিরক্তি তৈরি হয়েছে ,ঘৃণা তৈরি হয়েছে ,সেই সমস্ত বিষয়গুলি কে ‘সেফটি ভাল্ব’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য মুকুল রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্ত প্রমূখ ব্যক্তিত্বরা তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে, তৃণমূল কংগ্রেস সম্বন্ধে নানা ধরনের নরম-গরম কথা বলে ,বিধানসভায় বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন।
এদের ভিতর একমাত্র মুকুল রায় বিজেপি প্রার্থী হিসেবে ভোটে জেতেন। পরবর্তীতে আবার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেন। মুকুলের তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া, নির্বাচনে জেতা, আবার তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরে আসা- গোটা ব্যাপারটির যে নাটকীয় পরিমণ্ডল ,তা থেকে একটা কথা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো এবং আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্বের ভেতরে খুব উঁচু দরের বোঝাপড়া ছাড়া, মুকুলের গত কয়েক বছরের যে রাজনৈতিক অবস্থান আমরা দেখেছি ,তা মঞ্চস্থ হতে পারে না ।


একই কথা প্রযোজ্য রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে, সব্যসাচী দত্ত থেকে শুরু করে ,অন্যান্য তৃণমূল কংগ্রেসের লোক, যারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে সেফটি ভাল্বের মত বের করে দেওয়ার জন্য সাময়িকভাবে বিজেপিতে গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কথাগুলো কিন্তু বিজেপি ছেড়ে চলে এসে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করা ,আবার পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বাবুল সুপ্রিয় সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। আরএসএস ,তৃণমূলের ভেতরে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বাবুল সুপ্রিয়র মত রাজনীতির ব্যবসায়ীরা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন যাতে ,কোনো অবস্থাতেই বিজেপির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ,মুসলমান বিদ্বেষী অবস্থান, মুসলমান সমাজকে ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে এনআরসি র মত আত্মঘাতী আইন প্রণয়নের চেষ্টা ,মুসলমান সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে একেবারে খাদের কিনারায় এসে দাঁড় করিয়ে, তাঁদেরকে ধনেপ্রাণে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান কে ধ্বংস করে, আমাদের সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সমাধি নির্মাণ করে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পথে ভারতকে পরিচালিত করা –এইসব একটা পারস্পরিক সম্পর্কের কথা মানুষকে বোঝাতে হবে। তৃণমূল অনেকদিন ই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আছে। যে কোনভাবেই হোক বহু মানুষ, সেই দলে নানা শ্রম দিয়ে থাকেন । দলের ভেতরে পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে ,কেন সদ্য বিজেপি ত্যাগী বাবুল সুপ্রিয় কে বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে, পাশের রাজ্য বিহারের শত্রুঘ্ন সিনহা ,যিনি অল্প কিছুদিন আগেও বিজেপি সাংসদ ছিলেন, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য যার ভূমিকা মানব সভ্যতার লজ্জা ,এই ধরনের মানুষকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী করতে হয়? নিজের দলের পরীক্ষিত নেতাদের প্রার্থী করতে না পারার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়বদ্ধতা এবং সীমাবদ্ধতা– এই বিষয়গুলি কিন্তু এই ধরনের লোকেদের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হওয়ার ভেতর দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে আমরা দৃশ্যমান হতে দেখছি। তাই সাধারণ মানুষকে আমাদের সদ্য বিজেপি ত্যাগী কিন্তু সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ লোকেদের তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটে প্রার্থী করার ভেতরের যে রাজনীতি ,সেটাকে মানুষকে বোঝাতে হবে ।


আরএসএসের পরিমণ্ডলের মানুষদের কিভাবে তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের দলে সাদরে গ্রহণ করছে, নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের এগিয়ে নিচ্ছে ,দলটি তাদের ঘিরে ক্ষমতার পরিবৃত্ত তৈরি হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত আগামী লোকসভা নির্বাচনের(২০২৪) আগে থেকেই আমাদের এই রাজ্যে আরএসএসের যে আকাঙ্ক্ষিত সামাজিক মেরুকরণের কাজ ,তাকে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে দিচ্ছে ,যাতে লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে দেখে দেয়, আর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেখে দেয় ,এই ফর্মুলাটা বজায় থাকে, সে সম্পর্কে মানুষকে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝানোটা এখন সবথেকে বড় রাজনৈতিক কাজ হিসেবে উঠে এসেছে।