সম্প্রতি একটি রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দে দেশের ২৮ টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ১৭ তম । এর আগে আমাদের রাজ্য শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দে চতুর্থতম স্থানে ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ কমা বর্তমানে নতুন বিষয় নয়, ২০১১ সালে এরাজ্যে পালাবদলের পর এবং ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ কমাচ্ছে দুই সরকার। ভারতের ছাত্র ফেডারেশন ডাক দিয়েছিল শিক্ষার বেসরকারীকরণ করা যাবে না। বিজেপি এবং তৃণমূল এই দুই সরকারের রাজত্বে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ কমিয়ে আনা হচ্ছে, কলকাতা শহরে প্রায় প্রত্যেক সাধারণ মানুষের নুন্যতম সাক্ষরতার জ্ঞান আছে। কিন্তু সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রায় ৩০ টার বেশি পৌর স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই কলকাতা শহরেই কয়েক বছর ধরে স্কুল ছুটদের সংখ্যা লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলেছে। আসলে কলকাতা শহরে কাজ না থাকার কারণে স্কুল পড়ুয়ার অভিবাবকরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, ফলে তারা তাদের সন্তানদের বেশি দূর পড়াতে পারছেন না। ক্লাস এইট, নাইন কিংবা মাধ্যমিক দিয়েই সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা ছেড়ে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ছেন পড়ুয়ারা। সরকার কাজ দিতে পারছেনা, কর্মসংস্থানের সমস্যার ফলে কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরিব খেটে খাওয়া মানুষের কাজ চলে গেলে এবং কন্ট্রাক্টচুয়াল চাকরিতে বেতন না দিলে কিংবা অসুখ করলে সেই খেটে খাওয়া মানুষের বাড়ির ছেলেমেয়েরা তাদের অভিবাবকের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে যোগ দেয়। আমরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বরাবর বলেছি এই সকল মানুষের জন্য যারা আয়কর আওতার নিচে রয়েছে তাদের প্রত্যেক মাসে ফ্রী রেশন এবং ৭৫০০ টাকা দিতে হবে।

এমনিতে সাধারণ মানুষের অসুবিধার কোনো কম ছিলনা, এরমধ্যে করোনার আসার ফলে বহু মানুষের চাকরি চলে গেল। ফলে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে বাড়িতে বসে রইলো কিংবা কাজে যোগ দিল। সেক্ষেত্রে আমরা ফী মকুবের দাবি করেছিলাম, অন্তত কলেজের একটা সেমিস্টারের ফী মকুব করা হোক। বহুদিন ধরে দাবি করে আসছি শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যাশনাল জিডিপির বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য, যেটা দিনদিন কমে যাচ্ছে। মূলত দুই সরকার, একটা ফ্যাসিস্ট আর এক আধা ফ্যাসিস্ট সরকার বিজেপি এবং তৃণমূলের লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ কে শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে দিয়ে এদের বক্তব্য সাধারণ মানুষকে খাইয়ে দেওয়া। হীরক রাজার দেশে সিনেমায় একটা কথা ছিল, “ওরা যত বেশি পড়ে- তত বেশি জানে- তত কম মানে”। এরা চাইছে এরা মানুষ শিক্ষা থেকে যত দূরে রাখবে মানুষ তাদের কথা তত মানবে। সেইজন্য শিক্ষা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার নানান চেষ্টা এরা করে যাচ্ছে। তারই প্রতিফলন কর্পোরেশন স্কুল বন্ধ, তারই প্রতিফলন ফী বৃদ্ধি, এবং তারই প্রতিফলন হচ্ছে সাধারণ মানুষ কে কাজ না দেওয়া।

এরাজ্যে দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল বামেরা, তার মধ্যে কলকাতা কর্পোরেশনের অধিকাংশ ওয়ার্ড বামপন্থীদের আঁতুড়ঘর ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সত্ত্বেও বামপন্থী জনপ্রতিনিধিরা দলীয় প্রতিনিধি হিসাবে কোনোদিন কাজ করেননি। কিংবা সরকারি কাজ কোনো দলীয় অফিসে হয়নি। কিন্তু তৃণমূল সরকার আসার পরে আমরা দেখেছি রাস্তায় রাস্তায় সরকারি টাকায় অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় বড়ো বড়ো হোর্ডিংয়ে মমতা ব্যানার্জীর হাসি মুখের ছবি দেওয়া। আমদের বক্তব্য হচ্ছে মমতা ব্যানার্জী এই যে নানান সরকারি প্রকল্প গুলো করছেন সেই প্রকল্পগুলির জন্য তো তিনি তার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করছেন না। প্রকল্প গুলো করছেন সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। আমরা দিনের পর দিন দেখছি সরকারি প্রকল্পের নামে এই যে টাকা বা কাটমানির খাওয়ার প্রবণতা চলছে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওপরের পিরামিডের মাথা যদি ঠিক থাকে অথবা কোনো সংস্থার হেড যদি নীচু তলার কর্মীদের দুর্নীতিতে মদত না দেয় তাহলে সেখানে দুর্নীতি হওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠেনা। এই যে কাউন্সিলরা টাকা খাচ্ছে, সেই কাউন্সিলরের চামচা বা পোষা গুন্ডারা তারা বাজারে তোলা তুলছে এবং এদের তোলা মানে পাঁচ দশটাকার না। বামেদের একটা বদনাম আছে মানুষ আমাদের কৌটো নাড়ানো পার্টির লোক বলে, আমরা মনে করি এটাতে আমাদের প্রচন্ড লাভ আছে। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে চেয়ে নিচ্ছি যে আমরা সিপিআইএম পার্টির পক্ষ থেকে এসেছি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের সাহায্য করুন। অন্যদিকে তৃণমূল তোলা বাজদের শুরু হয় পাঁচশো টাকা- হাজার টাকার তোলা চেয়ে।


বাজারে এমন মানুষ রয়েছেন যাদের ১০০ টাকাও দৈনিক আয় হয়না, তার কাছে গিয়ে তোলাবাজরা যদি হাজার, পাঁচশো টাকা চায় তাহলে সেই দোকানদারের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব?। আসলে যারা তৃণমূল করছে, যারা শাসকদলের কর্মী তাদের কী হওয়া উচিত? শাসকদলের কাজ মানুষের সেবা করা কিন্তু তৃণমূল নেতা কর্মীরা সাধারণ মানুষের শোষণ করে। কাউন্সিলার অফিস তো সরকারি অফিস হওয়ার কথা, তৃণমূল জমানায় অধিকাংশ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর কে খুঁজে পাওয়া যায়না। কাউন্সিলারের স্বাক্ষর চাইতে গেলে পাওয়া যায়না, কিন্তু কাউন্সিলারের চামচাদের টাকা ধরিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়। তাছাড়া আর একটা মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ ওয়ার্ডে অন্য ওয়ার্ডের লোক এনে প্রার্থী করেছে তৃণমূল, তৃণমূলের কথায় “বহিরাগত” প্রার্থী। আসলে নিজের এলাকার মানুষ যতটা সেই ওয়ার্ডের সমস্যা জানবে কিংবা মানুষের পাশে দাঁড়াবে অন্য ওয়ার্ডের লোক সেই ওয়ার্ড কে ততটা সময় দিতে পারবে না। হঠাৎ কোনো দরকার পড়লে কাউন্সিলর কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা যদি ১ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষ কে ৫০ কিংবা ১০০ নম্বরের কোনো ওয়ার্ডে প্রার্থী করি তাহলে সে কি সেই ওয়ার্ডের পাল্স বুঝতে পারবে? । বাইরে থেকে লোক এনে দাঁড় করানো তৃণমূল জমানায় একটা নতুন ট্রেন্ড হয়ে গেছে।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের দিদি দাদারা এখানে পড়ে এখানেই চাকরি করছে। কিন্তু আমি যখন কলেজে যায় ২০১৩-১৫ সালের সময়ে দেখলাম আমদের সিনিয়াররা চাকরি্র খোঁজে কলকাতা এবং রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। যখন এরাজ্যে ছেলেমেয়েরা রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্য যাচ্ছে তার মানে এরাজ্য চাকরি নেই। শুধু শিলান্যাস করে রাখলে তো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়ে যাবেনা। কলকাতা যত কম্পানি আছে , infosis, IBM কিংবা অনান্য কোম্পানি সব বাম জমানায় এসেছে। উল্টে সিঙ্গুরের টাটা কারখানা তাড়িয়ে দেওয়া হলো। যেখানে হাজার হাজার যুবকের চাকরি হতো। সেই টাটা ন্যানোর কম্পানি কথায় গেল? গুজরাটে। যাতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্ল্যান্ট হতে পারেন। কলকাতা কর্পোরেশনে ২৮০০০ শূন্যপদ রয়েছে। আমরা বহুদিন ধরে আন্দোলন করছি। সাধারণ মানুষের মেধা আছে চাকরি পাওয়ার জন্য, কিন্তু আমাদের সরকার, মেয়র চাকরি দিতে ব্যর্থ। মেয়র তোয়ালে মুড়ে টাকা নিতে ব্যস্ত। ঘুষ দিয়ে তো চাকরি হওয়ার কথা না, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখেছি যারা মেধাবী তারা চাকরি পায়নি কিন্তু কোনো তৃণমূল কাউন্সিলের কিংবা কোনো তৃণমূল নেতার ডান, বাম হাত ধরে অনেকে চাকরি পেয়েছে।

আমাদের পার্টির সিপিআইএমের ম্যানিফেস্টোতে আমরা বলেছি আমরা সুস্থ, স্বাভাবিক কলকাতার পক্ষে যেখানে কোনো নোংরা থাকবে না। কিন্তু বর্তমানে তৃণমূল জমানায় রাস্তা থেকে শুরু বিদ্যুৎ থেকে পানীয় জল পর্যন্ত কোনো পরিষেবায় ঠিক নেই। দুয়ারে সরকারের মতো দুয়ারে গঙ্গা বইছে এখন। ক্ষমতায় এসেই ত্রিফলা বানালো হলে, সেগুলো তো চললোই না। কিন্তু সেই সব নষ্ট তারের ফলে বৃষ্টির সময় মানুষ মারা যাচ্ছে। রাজভবনের সামনে একজন পড়ুয়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারাগেল। মুখ্যমন্ত্রী সটান বলে দিলেন ক্ষতিপূরণ দেবেন, একজন মানুষের জীবনের কী ক্ষতিপূরণ? উনি সমস্ত কাটমানির টাকা সেই পড়ুয়ার বাবা মাকে যদি দিয়েও দেন তাহলেও তারা তাদের ছেলে কে ফিরে পাবেন না । যদি নিকাশি এবং বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা ঠিক রাখা হতো তাহলে কাউকে জীবন হারাতে হতো না। আমরা আমাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে গ্রীণ সিটি এবং স্বচ্ছ কলকাতার কথা বলেছি।

২০১১ সালে পালাবদলের পর থেকে মানুষ দেখছে রাজ্য এবং কলকাতার কি পরিস্থিতি, শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের চাকরি নেই, কাজ নেই। খেটে খাওয়া মানুষেরা খেতে পাচ্ছে না। নানান সরকারি প্রকল্প ঘোষণা করলেও সাধারণ মানুষ সেই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে না। কর্পোরেশনে কাউন্সিলর থেকে শুরু করে মেয়রের দুর্নীতি দেখেছেন কলকাতার মানুষ। ফলে তৃণমূলের প্রতি কলকাতা মানুষের আর সেই ভরসা নেই, এটা লোকাল নির্বাচন তাই সাধারণ মানুষ চাইবে দুর্দিনে যারা তাদের পাশে ছিল তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করতে। দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য বামপন্থীদের উপর মানুষের আস্থা বেড়েছে তাই তারা এবারের কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেবেন।