সাম্প্রদায়িকতা কথাটার সঙ্গে আমরা সাধারণভাবে ধর্মের মেলবন্ধন ঘটিয়ে ফেলি। কিন্তু ধর্মচিন্তা আর সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। উভয়ের মধ্যে প্রচুর প্রভেদ আছে। সাম্প্রদায়িকতাবাদ এমন এক বদ্ধমূল ধারণা গড়ে তোলে যে, একদল বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ এক । ভারতীয় প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িকতাবাদ এই বিশ্বাস গড়ে তুলতে চায়

যে, হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিষ্টান এদের নিজেদের মধ্যে কোনো লিঙ্ক নেই। এই এক একটি সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়গুলি থেকে কেবল ধর্মবিশ্বাসে আলাদা নয়,এদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থও ভিন্ন। অর্থাৎ মানুষের শ্রেণিগত পরিচয়কে সাম্প্রদায়িকতাবাদ অস্বীকার করে। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গীকে নাকচ করে। শ্রেণিসংগ্রাম বা ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রতিবন্ধক স্বরূপ।

       সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্য কখনই যথার্থ ধর্মীয় নয়। উভয়ের মধ্যে প্রচুর প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও একটিকে অন্যটির অবিচ্ছেদ্য রূপ হিসাবে মনে করা হয়। এই ধারণা অবশ্যই ভুল এবং মনের একটি ঐতিহ্যগত সংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকলেও ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক পরিচিতি কখনই এক নয়।

          ধর্মীয় পরিচিতি কোনো ব্যক্তিবিশেষের কোনো বিশেষ ধর্ম ও ধর্মসংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠান ও বিধি নিষেধের প্রতি তার ব্যক্তিগত আনুগত্যকে বোঝায়। অতি প্রাকৃতিক জগৎ থেকে কোনো পুরস্কারের আশায় কোনো ব্যক্তিবিশেষ এইরকম আনুগত্য দেখাতেও পারে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার মধ্যে থাকে পারলৌকিক সুখের ভাবনা। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার  মধ্যে থাকে ইহলৌকিক সুখ সমৃদ্ধি ও উন্নতির চরম আকাঙ্খা। সাম্প্রদায়িকতার  মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষ তার নিজস্ব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হয়ে অপর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জাগতিক সুযোগ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে। বলাই বাহুল্য, সে চেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই সোজাপথে বা শান্তির পথে চালিত হয় না। খুন, দাঙ্গা, লুঠতরাজের পথ নেয়।

এ থেকে বলা যায়,ধর্মনিষ্ঠা একটি সম্পূর্ণ ভাবগত বিষয়। সাম্প্রদায়িকতা একটি অতি বাস্তব বিষয়। সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্য তাই কখনই যথার্থ ধর্মীয় হতে পারে না। এর গোড়ায় রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিসন্ধি—politics of power.

       এই প্রসঙ্গে  আর এস এস/বি জে পি’র ‘হিন্দুত্ব’ সম্পর্কে আলোচনাটা সামনে আনা দরকার। হিন্দুধর্ম আর ‘হিন্দুত্ব’ কখনোই এক নয়। ‘হিন্দুত্ব’ একটি হিংস্র মতবাদ। যে মতবাদে অহিন্দু সব ধর্ম সম্প্রদায় ব্রাত্য। তাদের জন্য এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে জীবন নির্বাহের বিধান ধার্য করেছে এই মতবাদ। এমনকি হিন্দুধর্মভুক্ত আদিবাসী-তপশিলী-দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের কোনো মানমর্যাদার স্থান নেই এই মতবাদে। প্রয়োজনে উপরোক্ত সম্প্রদায়গুলির প্রতি সবধরনের হিংস্র ও অবমাননাকর পদক্ষেপ নেবার লক্ষ্যেই স্থিরিকৃত এই মতবাদ। এক কথায় আর এস এস গুরু গোলওয়ালকরের মতবাদ আশ্রিত এই ‘হিন্দুত্ব’। একই সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মনুবাদেরই একটি রূপ বি জে পি’র এই ‘হিন্দুত্ব’। পক্ষান্তরে হিন্দুধর্মের মধ্যে রয়েছে পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথা। রামকৃষ্ণ বলেছেন “যত মত তত পথ”। বিবেকানন্দ বলেছেন, মুচি-মেথর-চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই। আর বি জে পি’র লোকেরা দলিতদের খুন করে, তাদের মুখে মুতে দেয়। লোকদেখানো পা ধুইয়ে কি সেই অপরাধ স্খালন হবে? ওরা তো জাতি-উপজাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে চায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ দিয়ে। তাই তো ‘অভিন্ন দেওয়ানি আইন’ নিয়ে ওদের এত তৎপরতা ! তাই তো নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে দলিত হবার অপরাধে সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী দ্রৌপদি মুর্মু ব্রাত্য থাকেন, সাধু সন্ন্যাসীরা প্রাধান্য পান। অথচ এই দেশ হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান সবার।

   মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যেন ধর্মপ্রাণ মানুষের অনভূতিতে আঘাত না লাগে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টাই হবে মূল কাজ। আবার সাম্প্রদায়িকতাবাদ যেহেতু ধর্মবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তার জন্য ধর্ম সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা পরিষ্কার থাকা দরকার। ধর্মের কবল থেকে মুক্তি তখনই মিলবে, যখন ধনতন্ত্রের অবসান হবে। প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ ফুটে উঠবে তখনই। মনে রাখা জরুরী,একটি সমাজের অর্থনীতি হল কাঠামো বা বনেদ। ধর্ম তার উপরি কাঠামো বা উপরি বনেদ। কাঠামো বদল ব্যতিরেকে উপরি কাঠামোর বদল কতটা সম্ভব ? প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ধর্মের বিরুদ্ধ নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে লেনিনকে স্মরণ রাখা অবশ্য কর্তব্য : “যে সমস্ত মানুষ ধনতন্ত্রের নিষ্পেষণে পিষ্ট,এবং ধনতন্ত্রের অন্ধ ধ্বংসাত্মক শক্তির দয়ায় টিকে আছেন, তাঁদের মন থেকে ধর্মকে দূর করা কোনো পাঠ্য বইয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। এটা তখনই হতে পারে,যখন সেই মানুষেরা নিজের ধর্মের শিকড়টিকে নির্মূল করার লড়াইতে নামবেন এবং সংঘবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিক ও সচেতনভাবে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন।”

     ধর্ম সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে  অবগত থেকে বর্তমান পর্যায়ে যে অবস্থানের প্রতি অনুগত থাকা দরকার,তা হল, সব ধর্মের মানুষের ধর্মাচরণের অধিকার রক্ষা, তাদের ধর্মস্থানের অধিকার রক্ষা করা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা। অর্থাৎ ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি বন্ধ করা। যা বি জে পি/আর এস এস করে চলেছে।তৃণমূল কংগ্রেসও পাল্লা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। তাদের নিজেদের চুরি-দুর্নীতি-কলঙ্ক ঢাকতে বি জে পি/আর এস এস-এর সাথে গোপন বোঝাপড়াও গড়ে তুলছে।তাই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ও তৃণমূলের মতো নীতিহীন সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণকারী শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সমাবেশ ঘটানো আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে, এই সময়ের জরুরি কাজ।।

এই সত্য অনুধাবনে ঘাটতি এই পর্যায়ের সংগ্রামকে দুর্বল করবে। এখানে কুন্ঠা লালন করা এই সত্য অনুধাবনে অক্ষমতার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।