০১৩- Story Bias

কিছু দিন আগে জনৈক দেবাঞ্জন নামে এক ফেক IAS অফিসারকে নিয়ে মিডিয়া সরগরম ছিল। অনেক নেতা মন্ত্রীর ছবি সামনে এল। সবাই হতভম্ব কার্তিক সেজে বলল, জানতুম না হে! অথচ এক ছটাক সিমেন্ট বালি কিনলে ডাঃ স্কোয়ারফিট সেনের মত স্হানীয় কাউন্সিলারের হাত জানলা দিয়ে গলে যায়। মিডিয়া এমন ভাবে দেখায় যে মনে হয় যে লোক ধূর্ত শেয়ালদের ধোঁকা দেয়, সে কত বড় মাতব্বর। আসলে সবটাই গটআপ। এই রোমহর্ষক গল্প সবার ভাল লেগেছে। একে বলে Story Biasএর শিকার।

অথচ সেই লোকগুলোকে আপনি প্রশ্ন করুন, ইষ্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির PhD ডিগ্রী ফেক নয়? কেউ বলবেন, তিনি মা সারদা, রাসমণি থেকে ভগিনী নিবেদিতা। ওনারা ডিগ্রী জালিয়াতি করেছিলেন নাকি? অথবা মনে করুন, মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে অপদার্থ মন্ত্রী উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূঁইমালি PhD করে ফিরলেন। সেই গল্পটা করলে আপনাদের মনের মাধুকরী মিশিয়ে যে সততার প্রতীকের মূর্তি বানিয়েছেন, তা ভষ্মিভূত হবে। তাই আপনি মনের গহীনে Story Bias কাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করেন।

আসলে মানুষ সবচেয়ে ওস্তাদ নিজেকে বোকা বানাতে। একে বোকা বানানো বলবেন, নাকি ধান্দাবাজী? লোকে মনের ভিতর খারাপ বাম রাজত্বের গল্প পুষে পার্থ দের মৃত দিদির কঙ্কালের মত রোজ চা-বিস্কুট খেতে দেয়। আবার পার্থ দে-কে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত বলে। সেই লোকটা নিজেই Story Biasএ অসুস্হ। দেবাঞ্জনের হাতে রাজ্য চালাবার গুরুভার ছিল না, তাই সে প্রতারক হলে যতটা ক্ষতি তারচেয়ে যাঁর হাতে রাজত্ব, সে প্রতারক হলে পাহাড় প্রমাণ লোকসান। মানুষ লোকসান সইবে কিন্তু সুস্হ হবে না।

মানুষ জীবনকালে যা করে, ভাবে সব নাকি এক বড়বাবু আকাশে বসে নোট করে রাখেন। ভাদু শেখ মরেছে পাপে, আনারুল জেলে সেই পাপে। পার্থর টাকে শুভ্রা ঘোড়ুই জুতো ছোঁড়ে পাপের ফলে, যাঁরা চোদ্দ তলায় সেই বড়বাবুর কাছাকাছি বসে, তাঁরা দেখে না শিখলে মরবেন নিজের পাপে। Story Bias থেকে বড়বাবুর কল্পকাহিনী বাদ দিয়ে বাস্তবতা নিয়ে ভাবুন। যখন বিজ্ঞান, যুক্তির অবকাশ কম ছিল, তখন রূপকথার গল্পের প্রয়োজন হত। এখন মানুষের হাতে স্যান্ডেল আছে, গাল সামলে রাখুন।

০১৪- Hindsight Bias

ব্যাঙ্কের এক শাখায় নতুন ম্যানেজার যোগ দিতেই ব্যবসা দ্বিগুণ হয়ে গেল। সবাই বাহবা দিচ্ছে। আসলে নিকটবর্তী দুটি ব্যাঙ্কের শাখা বন্ধ হয়ে গেছে, সেই বাস্তবটা ম্যানেজমেন্টের চোখে পড়ল না। ফলতঃ সেই ম্যানেজার যখন প্রমোশন পেয়ে বড় দায়িত্ব পেলেন, তখন নীল শেয়ালের রঙ খসে পড়ল। মানুষ সামনে যা দেখে তাই বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত। Hindsight Biasএর ফলে পেছনের অনুঘটকগুলোর বিশ্লেষণে অনীহা। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পেছনেও অনাকাঙ্খিত কোন সমস্যা নজরে পড়ে না।

আমাদের ধারণা মমতা ব্যানার্জী সব কেন্দ্রে প্রার্থী। মানুষ তাঁকেই সব ভোট দেয়। আসলে জয় পরাজয় নির্ভর করে ভোট লুঠ ও স্হানীয় সমীকরণে। মমতা নিজেই নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর কাছে হেরেছেন। তার আগে যাদবপুর কেন্দ্রে হেরেছিলেন মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে। হিসাব করলে দেখবেন ২০%বার তিনি হেরেছেন। যাদবপুরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে কোন ম্যাজিক দেখাননি। Hindsight Biasএর ফলে মানুষ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া ইন্দিরা গান্ধীর চিতার ছবির সুফল মানুষ বেমালুম ভুলে গেছেন।

মমতা ব্যানার্জী কিন্তু Hindsight Bias সম্পর্কে সচেতন। তিনি খড়দা কেন্দ্রের জয়ী প্রার্থীর মৃত্যুতে সেখানে দাঁড়াতে সাহস দেখাননি। ভবানীপুরের জয়ী প্রার্থী বৃদ্ধ শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে খড়দায় পাঠিয়ে নিজে ভবানীপুরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। Hindsight Bias সম্পর্কে আমাদের নজর খুব কম থাকায় আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। আমরা যদি নিজেদের মত করে মতামত ডায়রিতে লিখে রাখি ও সময়কালে পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমরা ভুল।

২০১১র পরিবর্তনের Hindsight Biasএ আমরা খেয়াল করিনি, চিটফান্ডের টাকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০০৯ সাল থেকেই রেলে চাকরির বিনিময়ে ঘুষ দেওয়া নেওয়া শুরু হয়েছিল। ২০১৪র নির্বাচন হয়েছিল কেডি সিং-এর অর্থানুকুল্যে। তারপর কয়লা-গরু-বালি পাচার, নিয়োগ দূর্নীতিতে তৃণমূল টাকার পাহাড় বানিয়েছে। তৃণমূলের জয় সেই টাকায়, কোন নেত্রীর ছবিতে নয়। Hindsight Biasকে আমরা সম্যক ভাবে চিনতে পারলে রাজনৈতিক সমীক্ষা অনেক বেশী কার্যকারী ও নিখুঁত হতে পারে।

০১৫- Overconfidence Effect

আমি জানি না, সেটা অপরাধ হত যদি আমি জানতাম, আমি জানি না। আসলে সত্যি আমি জানি না যে আমি জানি না। না জানার অনেক মেরামতির উপায় আছে, কিন্তু আমি জানি না, না জানার ফলে মেরামতিটাও হয় না। এটা অপরাধ। একে বলে Overconfidence Effect। একটা সহজ উদাহরণ দিই, টিভিতে বসে তোলাচোর বলছে, সারা ভারতে যখন ৪০% বেকার কমেছে তখন মাননীয়া বিশ্ববাংলায় ৪০%বেকার কমিয়েছে। আপনি Overconfidence Effectএ চায়ের দোকানে বলতে হাসির রোল উঠল।

অথচ আপনার পরিবার, পরিজন, প্রতিবেশীর কতজন ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে কর্মরত দেখুন। গুগল সার্চ করে তোলাচোরের কথার সত্যতা যাচাই করুন। যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী টেট উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি না পেয়ে বাজারে সব্জী বিক্রী করছে, তোলাচোররা সেটাকে কর্মসংস্হান বলছে। কর্মসংস্হানের সংজ্ঞাটা জেনে নিন। আপনার Overconfidence Effect আপনাকে হাসির খোরাক করে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল, অথচ তোলাচোর বক্তব্য ঝেড়ে কোন এক তরুণীকে নিয়ে তখন বিছানায় সাঁতার কাটছে।

কিংবা মনে করুন, অমিত মিত্র মিহি স্বরে দাবী করলেন, বিশ্ববাংলায় BMW বিনিয়োগ করবে। অমিত মিত্র মূর্খ নন, তিনি ধান্দাবাজ, ফেরেব্বাজ। মাননীয়াকে খুশী করতে তাঁকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হল। আপনি কেন সেই ঘিয়ে আপনার স্বপ্ন ভাজতে যাবেন? শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা আগের দিনও জানতে পারেনি, দেশটা দেউলিয়া হয়ে গেছে। রাজপক্ষের ভাষণে বিশ্বাস করার Overconfidence Effectএ ভুগছিল, তার মাশুল দিতে হয়েছে। আপনিও কি নরেন মোদীর সবকা বিকাশ বিশ্বাস করেন না?

আপনি কি বিশ্বাস করেন নি, নোটবন্দীতে সব কালাধন ফিরে আসবে, সন্ত্রাসবাদ, জাল নোটের কারবার বন্ধ হবে? কিংবা হাততালি দিয়ে করোনা খেদাবেন? যেখানে এই দুর্বৃত্তদের বিশ্বাস করাই যায় না সেখানে Overconfidence Effect অপরাধ। আপনার না জানার ইচ্ছাকে ওরা ব্যবহার করে, আর আপনি জানেন না, যে আপনি জানেন না। আপনি চোখের উপর ঘুষ খেতে দেখেও জানতেন না যে তোলাচোররা ঘুষখোর। এই Overconfidence Effect তোলাচোরদেরও একদিন ডুবিয়ে দেবে ঠিক।