O

০০৭-Confirmation Bias

জন চৌধুরী। অভিজাত পরিবারের সুদর্শন পুরুষ। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে এক বান্ধবীকে নিয়ে দীঘায় বেড়াতে গিয়ে ধরা পড়ে। তখন এসব ঘটনায় বিস্তর জল ঘোলা হত। একটু থিতু হবার পর আবার জন আরেক প্রেমিকাকে নিয়ে মুম্বাই চলে যায়। ভাল চাকরি করত, জনের সান্নিধ্যের আকাঙ্খায় উৎসাহী নারীর সংখ্যা কম ছিল না। কিন্তু কেউ বিয়ে করেনি, বরঞ্চ বার কয়েক সম্বন্ধ ভেস্তে গেছে। পরবর্তী জীবনে সংযত হয়েছিল কিনা জানি না, তবে অকৃতদার রয়ে গেছে। একে বলে Confirmation Bias।

জনমানসে একটা বিশ্বাস তৈরী হওয়া। ও হয়ত ভাল সংসার করতে পারত, কিন্তু হয়নি। দক্ষিণপন্হী রাজনীতিতে Confirmation Bias অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নির্ণয় করে। বামপন্হীরা নীতি কেন্দ্রীক, কিন্তু দক্ষিণপন্হীরা নেতা কেন্দ্রীক। কেউ আগ্নিকন্যা হয়ে যান, পরে সততার প্রতীক উপাধি গ্রহণ করেন। সুব্রত মুখার্জীরা যতই বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বলে বিব্রত করুন, মানুষের Confirmation Bias হেলাতে পারেনি। পুরো দলটাই যখন দূর্নীতির ঘোলা জলে আবদ্ধ, তখনও জনতার ধারণা তিনি সৎ।

তিনি সৎ হয়ে অসৎ মানুষদের পুষছেন কেন? Disconfirming কোন অকাট্য যুক্তিও ভক্ত শ্রেণী শুনতে নারাজ। কোন কবিয়াল তাঁর মন্দির করতে চান, মাজি ডাক্তার মা সারদা দেখেন, বাগদার বিধায়ক বিজেপি ফেরৎ বিশ্বজিৎ প্রথমে রাণী রাসমণি, পরে ভগিনী নিবেদিতার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী যখন করোনা মোকাবিলায় তালি থালি বাজাতে বললেন, তখন বহু শিক্ষিত মানুষ বাদ্য বিশারদ হয়ে গেল। তারপর দিয়া জ্বলল। শেষে লক-ডাউন, ভ্যাক্সিনেশন। তবু মানুষ মোদীকে বিশ্বাস করেছিল।

নোটবন্দীতেও অনেকে বিশ্বাস করেছিল কালাধন চলে যাবে, সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হবে, জাল নোট থাকবে না। মানুষের Confirmation Bias মোদী-মমতা বোঝেন। মানুষ একবার যা সত্যি ভেবে নেয় তার বিরুদ্ধে কঠোর সত্যকে স্বীকার করে না। দুঃখের বিষয় আমরা সবাই ছোট বড় Confirmation Biasর বৃত্তে বাস করি। বাংলায় যাকে বলি চোখে ঠুলি পরে থাকা। মিডিয়ার প্রধান কাজ Confirmation Biasর চাষ করা। সত্য প্রতি মুহূর্তে বদলে যায়। নেতা-নেত্রীর হাতে নিজের মস্তিষ্ক বন্ধক দেওয়া অপরাধ।

০০৮-Confirmation Bias Part 2

পীর কখনও আকাশে ওড়ে না, ভক্তরা ওড়ায়। ঘুড়ির প্যাঁচের মত। কখনও কোন পীর কেটে ভাসতে ভাসতে পড়ে তালপুকুরে। মানুব সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকে বুদ্ধিমান মানুষরাই কেবল সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন। এসব লগ-ইন সর্বদা হয় গুহা কন্দরে, আস্তাবলে, মরুভূমির একাকীত্বে। ধর্মতলার জনসমুদ্রে কদাপি নয়। অসৎ মানুষদের আরাধ্যা দেবীমূর্তির প্রয়োজন হয়েছিল। মালকিনকে সততার প্রতীক বানিয়ে সব ধর্মের অসৎ মানুষদের মূর্তি অর্চনা শুরু হল। কখন মৃন্ময়ী, কখন চিন্ময়ী।

ইস্কুলে থাকতে আমরাও সরস্বতীর মূর্তি বসিয়ে চাঁদা তুলতাম। পরে ভন্ডামো বুঝতে পারি। এখনও বহু মানুষের পূজো করা বাৎসরিক জীবিকা। তার সাথে ধর্মের কোন যোগ নেই। দেবী কাউকে মন্ডপে ভিড় করতে বলেন না, মিডিয়া বলে, পুরষ্কার কমিটিকে ধরতে হয়। বহু শক্তিশালী ধর্মের যাজকদের খেলা ইতিহাসের পাতায় শেষ হয়ে গেছে তরবারির সামনে। তারপরেও অসহায় সময়ে ভরসা করার টোটকা চলছে। এটাই ধর্মীয় Confirmation Bias। সততার প্রতীক বা বিকাশপুরুষরা দুর্বলতার সুযোগ নেন।

কেবল জ্যোতিষরা নয়, অর্থনীতিবিদরাও Confirmation Biasএর সুযোগ নেন। মোদীকে আরো সুযোগ দিলে জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি হবে, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়বে, দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি হবে, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, দেশীয় সম্পদ বিক্রী হবে, চোর সহজে ভারতছাড়ো আন্দোলন চালাবে, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া দূর্নীতির তদন্ত প্রকৃত হবে না এবং ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে না। এই সত্য মিডিয়া বা অর্থনীতিবিদরা স্পষ্ট করে বলবেন না, কারণ Confirmation Biasএর গড্ডালিকা প্রবাহে তাঁদের আয়।

গান্ধীজীর দারিদ্র মহার্ঘ ছিল। Confirmation Bias প্রয়োজন ছিল। বুদ্ধদেববাবুর দু কামরার সরকারী ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন দরকার ছিল না, মমতার টালির বাড়ির কনফারেন্স হলের হাস্যরসেও Confirmation Bias অটুট থাকে, কারণ দুষ্কৃতিদের মূর্তির প্রয়োজন। ২১শে জুলাইয়ে মমতার স্ফূর্তির খরচের বহর হিসাব করতে পারছেন? মূর্তির সুরক্ষার সরকারী খরচ! লক্ষ্মীভান্ডারে সবাই ১০০০টাকা পেতে পারত। আপনার বিশ্বাস আর স্বার্থ নিয়ে মিডিয়া ও সুশীলদের সহযোগিতায় ছেলেখেলাই Confirmation Bias।

০০৯-Authority Bias

মনস্তত্ববিদি স্ট্যানলি মিলগ্রাম ১৯৬১সালে একটি পরীক্ষা করে। এক ব্যক্তিকে কাঁচের বাক্সে বন্দী করে বস অধঃস্তনকে ইলেকট্রিক শক দিতে বলেন। ১৫V, ৩৫V, ৫৫V, ১১০V, ২২০V, ৪৪০V করে কারেন্ট বাড়ানো হয়। (আসলে বন্দীর কোন শক লাগছিল না, কিন্তু মরণ যন্ত্রনার নিখুঁত অভিনয় করে) যাঁদের দিয়ে এই পরীক্ষা করানো হয়, তারা আর অগ্রসর হতে চায় না। কিন্তু বস পরীক্ষা নিস্পন্ন করার জন্য চাপ দেন নয়ত অধঃস্তনের ক্ষতি হবে। পরীক্ষার ফল বলছে বেশীর ভাগ লোক মৃত্যু অবধি শক দেয়।

মানুষ যুক্তি নির্ভর দাবী করলেও Authority Bias আজকেও পৃথিবীতে রাজতন্ত্র টিঁকিয়ে রেখেছে। অশিক্ষিত দেশে Authority Biasএর প্রভাব এতটা বলে শাসকরা পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করছে, উন্নয়নশীল দেশগুলির বিকাশ আর উন্নয়ন কেবল খাতায় কলমে। শ্রীলঙ্কার মত বিস্ফোরণ না হলে Authority Bias জনগনকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। ভাইপো বলছেন, ঠিকাদারী করলে তৃণমূল নয়। দাদার জল বয়ে মিলবে না টিকিট। ভাইপোকে তদন্তকারী সংস্হা আমন্ত্রণ করে, নিজে ভাইপো না হলে ডেলিভারি বয় হতেন।

Authority Bias এমন একটা অসুখ যে কংগ্রেস দলটাই খাদের কিনারে। বহু যোগ্য ব্যক্তি থাকতেও গান্ধী পরিবারের কাছে দলটা জামানত হয়ে আছে। সনিয়া গান্ধী ২৪বছরেও মমতাকে চিনতে পারেননি। তিনি রাজনীতির লোক নন। অনেক প্রোপ্রাইটারশিপ কোম্পানির অযোগ্য উত্তর পুরুষ Authority Bias দেখিয়ে কোম্পানি লাটে তুলে দিয়েছে। ছোট সংস্হা থেকে দেশের ক্ষেত্রে জনতার ভাবনা, আকাঙ্খা কেউ শোনে না। হুকুম তামিল করা পুলিশ, প্রশাসন চাইলেও জনগনের সেবা করতে পারবে না।

বিজেপিও হিন্দুত্ববাদ থেকে ক্রমশঃ মোদীবাদের দিকে। Authority Bias ছাড়া অশিক্ষিত জনতাকে বোকা বানানো মুশকিল। বাপন্হীদের কি Authority Bias নেই? তার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পর নেতৃত্বে বদল দরকার। যেটা ব্যক্তি মালিকানাধীন দলে অসম্ভব। কতটা দৌড়ালেন নয়, কতটা এগোলেন দিয়ে সাফল্য নিরূপণ করা উচিৎ। আজকে যে মানুষ আপনার পাশে ঘুরঘুর করছে, কাল নতুন মালিকের থেকে বেশী ফায়দা পেলে আপনাকে শক দেবার জন্য দ্বিতীয় চিন্তা করবে না কারণ Authority Bias।