পশ্চিম ইউরোপে আজ যে গনতন্ত্র প্রচলিত আছে তা-ই হচ্ছে মার্কসবাদের পূর্বসূরী। বাস্তবে প্রথমোক্তটিকে বাদ দিয়ে শেষক্তটিকে চিন্তাই করা যায় না। মার্কসীয় বিশ্ব-কীটের জীবানুসমূহের জন্মস্থানই হচ্ছে গনতন্ত্র এবং সেখানেই এর বৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটে।” —-MEIN KAMPF, পৃষ্ঠা: ৪৪১, হিটলার। “ফ্যাসিবাদ হলো ফিনান্স পুঁজির সব চাইতে প্রতিক্রিয়াশীল, সব চাইতে উগ্রজাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী অংশের সর্বাধিক প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক একনায়কতন্ত্র।” ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ১৯৩৫ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকে গৃহিত হওয়া এই সজ্ঞাটি সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত মার্কসবাদী সজ্ঞা। কিন্তু ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে কিন্তু এক দিনেই আসা সম্ভব হয়নি। কেননা ফ্যাসিস্টরা খুব ধীর ধীরে নিজেদের খোলস ছাড়তে ছাড়তে অবশেষে পূর্ণাঙ্গ ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ফ্যাসিবাদের জন্মভূমি ইতালি। ইতালির মিলান শহরে ১৯১৯ সালের ২৩শে মার্চ মুসোলিনির উদ্যোগে জনা পঞ্চাশেক মানুষ মিলিত হন এক সম্মেলনে। মুসোলিনি তখন সবেমাত্র সমাজতান্ত্রিক পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যোগদান করার পক্ষে ছিলেন মুসোলিনি। মূলত এই কারণেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মিলানের ওই সম্মেলনে যোগ দেন মুসোলিনির মতো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সমর্থক কিছু প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিকরা, radical সিন্ডিকালিস্টরা, ফিউচারিস্টের মতো ছোট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোকেরা এবং কালো পোশাক পরা একদল প্রাক্তন সৈনিকেরা (যাঁরা পরবর্তী সময়ে ব্যাক শার্ট নামে পরিচিত হন)। এই সম্মেলন থেকেই মুসোলিনি তাঁর রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ঘোষিত হয় ফ্যাসিস্টদের প্রথম কর্মসূচি।

এই কর্মসূচির প্রথান দাবিগুলি ছিল নিম্নরুপ:-🛑 আইন করে শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি।🛑 ন্যুনতম মজুরির স্বীকৃতি।🛑 শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারিগরী পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ।🛑 শিল্পপুঁজি এবং শিল্পপতিদের মুনাফার ওপর ক্রমবর্ধমান হারে কর।🛑 ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।🛑 যুদ্ধের জন্য দেওয়া অর্ডারগুলিকে পুনর্মূল্যায়ন করা ও যুদ্ধের থেকে কোম্পানিগুলির লভ্যাংশ থেকে ৮৫% বাজেয়াপ্ত করা।🛑 মহিলাদের সার্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব।🛑 দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের জমি।🛑 নতুন সংবিধানের জন্য ন্যাশনাল এসেম্বলি গঠন।

আপাতদৃষ্টিতে এই কর্মসূচি দেখলে মনে হয়, এতো শ্রমিক-কৃষকের স্বপক্ষে এক বিনম্র কর্মসূচি। এবং এই কর্মসূচি একচেটিয়া পুঁজি সর্বোপরি চার্চ ও পোপ বিরোধী। মৌলবাদী শক্তির বিরোধী। এই কর্মসূচি রূপায়ণ হলে রক্ষিত হবে মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এটা ছিল এক চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী ভাঁওতা। ১৯২১ সালের থেকে ক্রমশ ফ্যাসিস্টদের শক্তি বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথেই একে একে অস্বীকার অথবা তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে ১৯১৯ সালে নেওয়া প্রথম ফ্যাসিস্ট কর্মসূচির বুনিয়াদি বিষয়গুলিকে। প্রথমেই তারা বিরোধীতা করে ‘লিগ অফ নেশনস্’ -এর। যে রাজা আর ভ্যাটিকানের বিরোধিতা করেছিল ফ্যাসিস্টরা সেই রাজা আর ভ্যাটিকানের হাত ধরেই মুসোলিনি ক্ষমতা দখল করে। তারপর পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে শ্রমিক বিরোধী অবস্থান নিতে থাকে ফ্যাসিস্টরা। ক্রমশ নিষিদ্ধ করা হয় ট্রেড ইউনিয়ন। গ্রেফতার করা হয় সমস্ত কমিউনিস্টদের। কমিউনিস্ট পার্টিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা উচিত তৎকালীন ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড আন্তেনিও গ্রামসির কথা। ১৯২৮ সালে ইতালির ট্রাইব্যুনালে গ্রামসির সাজানো বিচারের সময় ফ্যাসিস্ট সরকারের উকিল বিচারকের কাজে কুড়ি বছরের জন্য গ্রামসির মাথাটা অকেজো করে দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। বিচারকও এই আবেদনে সাড়া দিয়ে তেমনটাই রায় দিয়েছিলেন। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট কারাগারে রোজ গ্রামসির মাথাটা দেওয়ালের সাথে ঠুঁকে দেওয়া হতো। নির্মমভাবে অত্যাচার চালানো হতো গ্রামসির উপর। কমিউনিস্টদের প্রতি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর সরকারের ঘৃণা এতটাই ছিল যে, ১৯৩৭ সালের ২৭শে এপ্রিল গ্রামসির মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের অব্যবহিত পরে পুলিশ কর্তৃপক্ষ একটি সংবাদ প্রকাশিত করে জানায়- “শয়তান আন্তেনিও গ্রামসির শবযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন শুধুমাত্র তাঁর পরিবারের সদস্যরা”।

‘রোম মার্চ’- এর পরবর্তী সময় থেকেই মুসোলিনি খাপ খুলে ফ্যাসিবাদের ধারালো তরোয়ালটা এক ঝটকায় খুলে বার করে আনতে থাকে। ১৯৩২ সালে এসে তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয় Doctrine of Fascism (ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব)। ততদিনে ইতালিতে ফ্যাসিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে এই তত্ত্বের লেখক ছিলেন ফ্যাসিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপাত্র এবং দার্শনিক জিওভান্নি জেন্টিলে। লেখাটি সংশোধন করার জন্য মুসোলিনিকে দেখানো হয়। মজার বিষয় হলো সংশোধন করার নামে গোটা তত্ত্বটিই মুসোলিনি নিজে লেখেন। এই ডকট্রিন অব ফ্যাসিজমই হলো মুসোলিনি লেখা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বই। যেখানে তিনি ১৯১৯’এর ফ্যাসিস্ট কর্মসূচির উল্লেখ যোগ্য দিকগুলি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কথা বলেন। বলা যেতে পারে এই বইটির মাধ্যমেই তিনি তাঁর “মনকি বাত” বলেন। এই বইটিতে তিনি পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করেন- “ফ্যাসিবাদ বস্তুবাদের বিরোধী। ফ্যাসিবাদ মনে করে জীবন আসলে একটি ভাববাদী অস্তিত্ব। মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত উন্নততর সত্ত্বা রাষ্ট্রের স্বার্থে নিয়োজিত হওয়া। ব্যক্তি সুখ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এগুলোর আলাদা কোন অর্থ নেই যা রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে লাগে না। স্বাধীনতা বা গনতন্ত্রও রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের বাইরে অস্তিত্বহীন এবং ফ্যাসিবাদ তার বিরোধী। রাষ্ট্রই চূড়ান্ত, রাষ্ট্রের স্বার্থের বাইরে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।” এভাবে শ্রমিক-কৃষকেসহ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে ভাঁওতা দিয়ে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনী তাঁর ফ্যাসিবাদের তত্ত্বকে চূড়ান্ত রূপ দান করেন। এই তত্ত্ব শ্রেণী সংগ্রাম বিরোধী, শ্রমজীবী মানুষের বিরোধী। ফ্যাসিবাদ গনতন্ত্রকে অস্বীকার করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিরোধী, ধান্দা পুঁজির রক্ষক। ফ্যাসিস্টদের তত্ত্ব হাজির করতে গিয়ে মুসোলিনি তিনজনের ঋণ স্বীকার করেন। এই তিনজন হলেন হলেন, জর্জ সোরেল, এমিল পিগু এবং হুবার্ট ল্যাগারডেল। তিনজনই ছিলেন ফরাসি radical সিন্ডিকালিস্ট। এই সিন্ডিকালিস্টরা ছিল ধর্মঘটের পক্ষে কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল গঠনের বিরুদ্ধে।

তারা মনে করতো, শ্রমিকদের দেশ ভিত্তিক ধর্মঘটই পরিবর্তন ঘটাবে তাই আলাদা রাজনৈতিক দলের কোনো প্রয়োজন নেই। জর্জ সোরেল নিজেকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার পক্ষের মানুষ বলে দাবি করলেও দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। ইতিহাস সোরেলকে মনে রাখবে তার কুখ্যাত “রিফ্লেকশনস অব ভায়োলেন্স”-এর জন্য। শ্রেণী সংগ্রামের বদলে তিনি হিংসার কথা বলেন। ওনার মতে, সাধারণ ধর্মঘট এবং হিংসার হাতিয়ারেই একমাত্র সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব। ফ্যাসিবাদের জন্ম হয় এই সিন্ডিকালিজমের এই তাত্ত্বিক বধ্যভূমিতে। বিক্রিত ও বিচ্যুতির উপর। তবে ইতালির ফ্যাসিস্টদের হাতে পরে এই সিন্ডিকালিজম আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। হয়ে ওঠে মানব সমাজের পয়লা নম্বরের শত্রু। চলবে…

গ্রন্থ সূত্র: ফ্যাসিবাদের উত্থান: একটি পুনর্পাঠ –মানব মুখার্জি।ফ্যাসিবাদ অতীত ও বর্তমান —সুকমল সেন।আন্তেনিও গ্রামসি: বিচার-বিশ্লষণ — সম্পাদনা: শোভন লাল দত্ত গুপ্ত চলবে…