এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ইউরোপীয় অতি-দক্ষিণপন্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাভারকারের অবস্থান। সাভারকারের রাজনীতিতে আসার সূত্রে, ১৯৩০-র দশকের শেষ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে সর্বগ্রাসী শাসনগুলোর সাথে নতুন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু হয়। একই সাথে ইতালি ও জার্মানির নীতির সমর্থনে আওয়াজ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। লক্ষ্যণীয়, জার্মানির প্রতি পছন্দটা ক্রমশ বাড়ছিল।
১৯৩৭-এ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই সাভারকার হিন্দু মহাসভার সভাপতি হন। তিনি এই পদে ছিলেন ১৯৪২ পর্যন্ত। এই সময়টা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ভারত ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়। এটা সবাই মেনে নিয়েছেন যে, আর এস এস এবং হিন্দু মহাসভা কখনোই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ ছিল না। সাভারকার সভাপতি থাকাকালীন উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায়। বাস্তব ঘটনা কিন্তু অন্যরকম। যা কিছু নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে, তার থেকে বলা যায় যে, হিন্দু মহাসভা ও আর এস এস-র মধ্যে কখনোই বিচ্ছেদ ঘটেনি। এবং এই দুটি সংগঠন সব সময়েই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ ছিল। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না, হেডগেওয়ার ১৯২৬-৩১ হিন্দু মহাসভার সচিব ছিলেন INAL Home Poll Department, August, 28, 1942, intelligence report ‘Rashtriya Swayam Sewak Sangha’, dated March 7, 1942)।  আর এস এস যে হিন্দু মহাসভাকে সমর্থন করতো, তা বোঝা যায়, যখন আমরা দেখি যে, সাভারকারের মুক্তি উদ্‌যাপনের সভাগুলোরে আর এস এস উগ্রপন্থীরা ভিড় জমাতো।


সাভারকার তাঁর সম্মানে আয়োজিত জমায়েতগুলোতে ও অন্যত্র দলীয় সভার ভাষণে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিতেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। প্রথমটির – ক্ষেত্রে, ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে কী ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখবে, সে বিষয়ে সাভারকারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। তিনি যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নতুন করে রাজনীতিতে যোগ দিলেন, তখন রোম-বার্লিন অক্ষশক্তির সাথে জাপান যুক্ত হয়েছে। এই ত্রয়ীর মিলনকে হিন্দু মহাসভা সহ হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো স্বাগত জানায়। ১৯৩৮-র ১ আগস্ট পুনেতে সাভারকার ‘ভারতে বিদেশ নীতি সম্পর্কে ভাষণ দিলেন প্রায় কুড়ি হাজার লোকের সামনে। সেই ভাষণেরই একাংশ (হিন্দু মহাসভার জারি করা প্রেস নোট অনুযায়ী) উদ্ধৃত করা যাক :


ভারতের বিদেশনীতি কোন ‘ইজ্‌মে’র ওপর ভিত্তি করবে না। জার্মানি ও ইতালি ন্যায্যতই যথাক্রমে নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের পথ বেছে নিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই ধরনের মতবাদ ও তদ্রুপ রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে তাদের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় ও হিতকারী ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে। 
[1938’MAY, Press note issued by the Hindu Mshasabha office Bombay Branch, “A Summary of Savarkar’s speech”.] অর্থাৎ, একটা দেশের জনগোষ্ঠীর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে, সেখানে কি ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে। এই তত্ত্ব স্পষ্টতই জাতি সম্পর্কিত নিমিত্তবাদী (deterministic) ধারনার দ্বারা অনুপ্রাণিত। সেই সময় এই রকম ধারনা ইউরোপে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল।


জওহরলাল নেহরুর সাথে এক বিতর্কে সাভারকার তৎকালীন ইতালি এবং আরও বেশি করে জার্মানির স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিকে খোলাখুলি সমর্থন করেন:

জার্মানি, জাপান, রাশিয়া কিংবা ইতালি কি ধরনের রাষ্ট্রনীতি গ্রহণকরবে তা বলার আমরা কে? হিটলার নিশ্চয়ই পণ্ডিত নেহরুর চেয়ে ভালো জানেন জার্মানির পক্ষে কোনটা ভালো। যদি এই কথাটা মনে রাখি যে জার্মানি অথবা ইতালি নাৎসি ফ্যাসিবাদের জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় চমকপ্রদভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ও অভূতপূর্ব শক্তি অর্জন করেছে, তবে এটা মেনে নিতে অসুবিধা হয় না যে, এই মতবাদগুলোই তাদের সঠিক দাওয়াই।


ভারত তার নিজস্ব রাজনৈতিক তাগিদ অনুযায়ী কোন বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মেনে নিতে বা বাতিল করতে পারে। কিন্তু পন্ডিত নেহরু এটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেন, যখন তিনি সমস্ত ভারতবাসীর পক্ষে জার্মানি বা ইতালি-র বিপক্ষে দাঁড়াবার কথা বলেন। তিনি শুধু বড় জোর কংগ্রেসীদের মনোভাবটাই তুলে ধরতে পারেন। জার্মান, ইতালিয় বা জাপানী জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, ভারতে কোটি কোটি হিন্দু সাংগঠনিকরা, যাদের সাথে পণ্ডিত নেহরু বা কংগ্রেসের কোন যোগ নেই, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের প্রতি শুধুমাত্র তারা নির্দিষ্ট কোন রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে বলে, বিরূপ মনোভাব পোষণ করে না।
সাভারকর সুদেতান সমস্যায় জার্মানির অবস্থান সমর্থন করেন:
…চেকোস্লোভাকিয়ার আছে, ভারতে হিন্দু সাংগঠনিকরা মনে করে যে জাতীয় ও সুতোন বাার্মানদের জার্মান পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ করা পুরোপুরি সঠিক কাজ হয়েছে। গণতন্ত্র দাবি করে সরকার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছাই শেষ কথা। জার্মানি গণভোট দাবি করেছিল, চেকদের অধীনে থাকা জার্মানরা তাদের আত্মীয় পরিজনদের সাথে মিলতে চেয়েছিল। জার্মানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধরে রেখে বরং চেকরাই গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী কাজ করেছে। এখন, যখন জার্মানি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সে কেন সমস্ত জার্মানদের একত্রিত করে এক সর্ব-জার্মান রাষ্ট্র গড়ে তোলার বহু পরস্পরার রাজনৈতিক স্বপ্নকে পূর্ণ করার উদ্যোগ নেবে না ?


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন একেবারে দোরগোড়ায়, তখন সাভারকর অন্যান্য জাতিগুলোর প্রতি হিন্দু মহাসভা কি দৃষ্টিভঙ্গি নেবে তা স্পষ্ট করে দেন :
কোন দেশ, যে ভারতকে সাহায্য করবে কিংবা তার স্বাধীন আন্দোলনের বন্ধুত্ব মনোভাবাপন্ন হবে, সেই আমাদের মিত্র। আর যে দেশ আমাদের বিরোধিতার নীতি নেবে, সে আমাদের শত্রু। যারা এ কোনোটার মধ্যেই থাকবে না, ভারতের তাদের আভ্যন্তরীণ বা পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে অযথা নাক না গলিয়ে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়া উচিত।


এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, উল্লেখিত ভাষণটি ১৯৩৮-র ৩০ নভেম্বর বিখ্যাত জার্মান দৈনিক Volkischer Beobachter-এ প্রকাশিত হয় [ NMML, Savarkar Papers microfilm, 937-May 1938]
চলবে…_______________________________________

গ্রন্থসূত্র: মহাফেজখানার দলিল। 
সুভাষচন্দ্র বসু ও অক্ষশক্তি: সুধীপ্রধান