তাঁর সরবেড়িয়ার বাড়িতে রেশন কেলেঙ্কারির তদন্তে যাওয়া ইডি অফিসারদের ওপর অনুগামীদের দিয়ে হামলা করানোর পরেই উধাও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইডি বা রাজ‍্য পুলিশ নাকি খুঁজেই পাচ্ছিল না তাঁকে। কিন্তু ছাপ্পান্ন দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা ও জেলাপরিষদের সদস্য মৎস‍্য দপ্তরের কর্মাধ‍্যক্ষ তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান মিনাখাঁয় রাজ‍্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরেই বোঝা গেল সন্দেশখালির প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়ক নিরাপদ সর্দারই সঠিক কথা বলেছিলেন। তৃণমুল নেতা শাহজাহানের দুই অনুগামী তৃণমূল আশ্রিত শিবু হাজরা ও ভানু মণ্ডলের করা দুটি মিথ‍্যা অভিযোগে সতেরো দিন জেলে থাকার পরে জামিনে মুক্ত হয়ে কমিউনিস্ট নেতা নিরাপদ সর্দার বলেছিলেন "শাহজাহান পুলিশের আশ্রয়েই আছে। মুখ‍্যমন্ত্রী যেদিন চাইবেন,সেদিনই গ্রেফতার হবে,নতুবা হবে না।' ইডি অফিসারদের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ই ডি বা সি বি আই এর মতো কোন এজেন্সির হাতে না পড়ার জন‍্যই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। গত চার বছরে তৃণমূলের নেতা শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে তেতাল্লিশটি মামলা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ছেড়েই রেখেছিল পুলিশ। রেশন কেলেঙ্কারিতে যুক্ত বিচারাধীন বন্দী রাজ‍্যের প্রাক্তন খাদ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও তাঁর অনুগত ব‍্যবসায়ী বাকিবুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া তথ‍্য যাচাই করার জন‍্যই গত ৫ ই জানুয়ারি তৃণমুল নেতা শাহজাহানের বাড়ি তল্লাশি করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল ইডি আধিকারিকদের। শাহজাহানের অনুগামীরা তাঁদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেছিলেন,গাড়ি ভাঙচুর করেছিলেন। শুধু তাই নয় কর্তব‍্যরত সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের অনেকেই সেদিন অনুগামীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেদিন থেকে সরকারিভাবেই তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব শাহজাহানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে ইডির এই তল্লাশিকেই "বে আইনি" ঘোষণা করে কুনাল ঘোষ থেকে শোভনদেব চ‍্যাটার্জী পর্যন্ত শেখ শাহজাহানকে "রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার " হিসাবে গণমাধ্যমে খাড়া করতে চেয়েছিলেন। প্রধানত তাঁদের অঙ্গুলীহেলনেই আদালতের নির্দেশে সিট গঠন করার পরেও ধরা যায় নি শাহজাহানকে। গোপন আস্তানা থেকে বার বার আগাম জামিনের আবেদন জানিয়েছিলেন শাহজাহান । আবেদন নামঞ্জুর করে প্রতিবার আদালত প্রশ্ন তোলেন কেন শাহজাহান কোর্টের সামনে আসছেন না , ইডির তদন্তে বাধা দেওয়ার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? তৃণমূলের নেতা শাহজাহানের সঙ্গেই নিখোঁজ ছিলেন তাঁর আরেক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাকরেদ তৃণমূল আশ্রিত শিবু হাজরাও। শাহজাহানের আরেক সাকরেদ উত্তম সর্দার এলাকায় থাকলেও আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু হিসাব পাল্টে দিল সন্দেশখালির জনরোষ। শাহজাহান গা ঢাকা দেওয়ার এক মাসের মধ‍্যেই শাহজাহান ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে জমি হাতিয়ে নিয়ে মেছোঘেরি বানানোর অভিযোগ এনে সন্দেশখালির বাসিন্দাদের বৃহত্তর অংশ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শুধু তাই নয় শিবু হাজরার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও নারীনিগ্রহের অভিযোগও সামনে আসে। প্রথমে উত্তম সর্দার ও পরে শিবু হাজরা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরেই প্রশ্ন ওঠে এই দুষ্কৃতীদের কি পুলিশ জেনেশুনেই প্রশ্রয় দিত? পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালে মহিলাদের বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সন্দেশখালিতে শাহজাহান নিজের রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা ক্রমশ বাড়িয়ে নিচ্ছিল। বিশেষত মাছের ভেড়ির ব‍্যবসায়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে একদা অটোচালক শেখ শাহজাহান হয়ে ওঠে সন্দেশখালির ত্রাস। ২০১১তে প্রবল তৃণমূল হাওয়া সত্ত্বেও ভাঙড়ের মতো সন্দেশখালিতেও জয়ী হয়েছিলেন বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী। সন্দেশখালির ত‍ৎকালীন এম এল এ নিরাপদ সর্দার ২০১৩ র পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকেই গ্রামে গ্রামে তৃণমূল কংগ্রেসের মদতপুষ্ট গুণ্ডাদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়া ও বামপন্থী মহিলা সংগঠনের কর্মীদের ধর্ষণে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ বিধানসভার অধিবেশনে জানিয়েও কোন প্রতিকার পান নি। ২০১৪ সালে বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের জিরো আওয়ারে নিরাপদ সর্দার আবার সন্দেশখালিতে অশান্ত পরিস্থিতির প্রতি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন কিন্তু সেবার তাঁর মাইক অফ করে দিয়েছিলেন বিধানসভার তদানীন্তন উপাধ‍্যক্ষা বর্তমান বিজেপি নেত্রী সোনালী গুহ। তোলাবাজি ও দুর্নীতির সাহায্যে আদায় করা অর্থের উৎস অক্ষুন্ন রাখার জন‍্যই তৃণমূল কংগ্রেস কখনও শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে কোন প্রশাসনিক ব‍্যবস্থা নিতে দেয়নি। এমনকি ২০১৯ সালে যখন তিনজন বিজেপি কর্মী খুনের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে সেই সময় মমতা ব‍্যানার্জী,অভিষেক ব‍্যানার্জী ও তাঁদের তখনকার অনুগামী শুভেন্দু অধিকারীর নির্দেশে চার্জশিট থেকেই শেখ শাহজাহানের নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এবার সন্দেশখালির জনরোষ কোনভাবেই সামলাতে পারছিলেন না পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও বিজেপির রাজ‍্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি করার ব্যর্থ চেষ্টা করার পর রাজ‍্যের দুই মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক ও সুজিত বসু বেশ কয়েকবার সন্দেশখালির মহিলাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার পরেও শাহজাহান বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারেন নি। উত্তম সর্দার ও শিবু হাজরাকে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে গ্রেফতার করিয়ে দেওয়ার পরে শাহজাহান কে গ্রেফতার করার দাবিতে অনড় থাকেন সন্দেশখালির বিক্ষুব্ধ মানুষ। "ষড়যন্ত্রের শিকার " সাজানোর কারসাজি বশংবদ মিডিয়ার সাহায্যে টেকানো যাচ্ছেনা বুঝেই বিধানসভার অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী শাহজাহানকে টার্গেট করা হচ্ছে বলার পরেও অভিষেক ব‍্যানার্জী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেন "পলাতক শাহজাহানকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে "বলে । কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেন পুলিশ বা ইডি ,সিবিআই এর মতো যেকোন তদন্তকারী সংস্থা শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে পারবে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না এখনও নেই।

এরপর শাহজাহানকে গ্রেফতার না করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ থাকত না। কিন্তু যেভাবে সন্দেশখালির তথাকথিত "বেতাজ বাদশা"কে গোপনে বসিরহাট থেকে কলকাতার ভবানীভবনে নিয়ে যাওয়া হল তা যথেষ্ট রহস্যজনক।