আমাদের দেশে শাসক শ্রেণি  ইংরেজদের বিরুদ্ধে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই ঘৃণার চোখে দেখেছে। তাই “চূয়াড় বিদ্রোহ” বা “সাঁওতাল বিদ্রোহগুলি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা সাঁওতাল গণ অভ্যুত্থানের একশত বছর ১৯৫৪ সালে পালন করে। বামফ্রন্ট সরকার  কলকাতায় গণসংগ্রামের কেন্দ্রস্থলের নামকরণ করেন ‘সিধু,কানু,ডহর’ হিসাবে।

  
৩০ শে জুন সাঁওতাল গণ অভ্যুত্থানের দিন। এইটা বিদ্রোহ তাই ‘হুল’। ৩০ শে জুন প্রতিবছর ‘হুল দিবস’ পালন করা হয়। কেউ কেউ আবার এই দিনটিকে ‘হুল উৎসব’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এই দিনটি উৎসবের দিন নয়, এটা ইংরেজদের হাতে নিহত প্রায় দশহাজার সাঁওতাল ও অন্যান্য গরীব মানুষদের স্মরণ করার দিন, শপথ নেওয়ার দিন, লড়াই আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিন।


প্রায় দুশো বছর ধরে আমরা বিদেশি ইংরেজ সরকারের শাসনে ছিলাম। তাদের শাসনের পূর্বে আমাদের গ্রামবাংলা ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি নির্ভর গ্রামগুলি থেকে শাসকরা রাজস্ব বা কর নিয়ে যেতেন।  সমগ্র সমাজ থেকে এই কর তারা আদায় করত। কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে নয়। ইংরেজ শাসকরা এই সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। নতুন ভূমি ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারী ব্যবস্থা চালু করে। কৃষক তার পরিশ্রমে তৈরী জমির মালিকানা হারায়। এর প্রতিবাদে একের পর এক কৃষক একের পর এক আন্দোলন ও লড়াই গড়ে ওঠে। এর মধ্যে একটি বড়ো আন্দোলন হলো ১৮৫৫ সালের ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ বা ‘সাঁওতা হুল’।  ‘হুল’ কথার অর্থ হলো ‘বিদ্রোহ’। 
সাঁওতালরা মূলতঃ কৃষি নির্ভর ও পরিশ্রমী। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম,ছোট নাগপুর এলাকার রুক্ষ মাটিতে তাদের বাস। এখানেই তারা বন পরিস্কার  করে চাষবাস করতো। কিন্তু ইংরেজদের তৈরী জমিদারদের অত্যাচারে তারা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।


ইংরেজ সরকার তখন বিহারের রাজমহল পাহাড়ের জঙ্গল দখল করে জরীপ করে। ঐ এলাকার জঙ্গল পরিস্কারের কাজে গরীব সাঁওতালদের লাগায়। চুক্তি হয় তারা যতটা খুশি এলাকা দখল করবে। ঐ এলাকায় জমি তৈরী করে তারা চাষও করতে পারবে। এজন্য তাদের কোনো খাজনা দিতে হবে না।  বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাঁওতালরা সেখানেই আসে। চাষবাস করে সুখে বাস করে। জায়গাটির নাম দেয়  দামিন-ই-কোহ বা মুক্তাঞ্চল।


কিন্তু গরীব সাঁওতালদের এ সুখ বেশিদিন সহ্য হয় নি। জমিদার, সরকারি কর্মচারি, ব্যবসায়ী, আড়তদার, মহাজনদের অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।  জমিদারের কর্মচারীরা সরকারী প্রতিশ্রুতি ভুলে খাজনা আদায় করে। আড়তদাররা এখানে কম দামে ঠকিয়ে তাদের ফসল কেনে।  ব্যবসায়ীরা মদের দোকান করে সাঁওতালদের নেশাগ্রস্ত করে। পুজো পার্ব্বণ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এতদিন তারা নেশা করত। এখন তারা ভাত ফেলে মদ খায়। আবার লোভনীয় জিনিস বিক্রি করার মধ্যে দিয়ে তাদের ঠকায়। 
 ধীরে ধীরে গরীব সাঁওতালরা অভাবে পরে, মহাজনের খপ্পরে পরে। মহাজন তাদের বেশি সুদে টাকা ধার দেয়। যে টাকা ধার দেয় তার দশগুণ লিখিয়ে নেয়। ধার করা টাকা শোধ দিতে না পেরে তারা জমি ঘরবাড়ি বাধা দেয়। এরপর নীলকর সাহেবরা জোর করে চাষের জমিতে নীল চাষে বাধ্য করে। জমিদার, নায়েব,গোমস্তারা খাজনা আদায়ের নামে জোর জুলুম করে। এমনকি নীলকর সাহেবরা বাড়ির মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে। 


এই অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সিধু ও কানু নামে দুই ভাই তাদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।  সাঁওতালরা শাল গাছে ‘গিরা’ দিয়ে ধর্মীয় ডাক দেয়। ১৮৫৫ সালে ৩০ শে জুন বৃহস্পতিবার প্রায় দশহাজার সাঁওতাল ভাষা ডিহির মাঠে জড়ো হয়। বড়লাটের কাছে প্রতিকারের দাবীতে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সাথে যোগ দেয় এলাকার গরূব মানুষেরা। এগিয়ে আসে মোমিন সম্প্রদায়ের মুসলমানরা। শুরু হয় গণ পদযাত্রা। কিন্তু পথে অত্যাচারী শাসক দারোগা বাধা দিলে বিদ্রোহীরা তাকে খুন করে। তাদের কলকাতা যাত্রা বন্ধ হয়। বিদ্রোহীরা রেল স্টেশন,ডাকঘর,থানা, সরকারি দপ্তর জ্বালিয়ে দেয়। জ্বালিয়ে দেয় মহাজন ও জমিদারদের ঘরবাড়ি।  ভাঙ্গলপুর থেকে মুঙ্গেঁর পর্যন্ত তাদের দখলে আসে। এই বিদ্রোহ সিধু,কানু ছাড়া তাদের আরো দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব যোগ দেয়। যোগ দেয় বীর সিং, কালো প্রামানিক ও ডোমন মাঝির মতো শক্তিশালী নেতারা। 


  ইংরেজ সরকার প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরে সেনা পাঠায়। চলে গণহত্যা।  সাঁওতাল গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হাজার হাজার মৃত্যু দেহ রাস্তায় পড়ে থাকে। সিধুকে এক বিশ্বাসঘাতক ধরিয়ে দেয়। ভাষা ডিহির মাঠে তাকে গুলি করে মারা হয়। কানুকে ফাঁসী দেওয়া হয়। এইভাবে গণহত্যা চালিয়ে আন্দোলনকে দমন করা হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসকদের ভাবিয়ে তোলে।  সাঁওতালদের ওপর তারা নরম হয়। সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায়  সাঁওতাল পরগণা জেলা গঠিত হয়। সাঁওতালদের আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্রোহের আগুন ব্রিটিশরা নেভাতে পারেনি। এর দুইবছর পর ১৮৫৭ সালে আবার শুরু হয় মহাবিদ্রোহ।  হুল দিবস উদযাপন  এবছর ১৬৮ তম হুল দিবস আদিবাসী অধিকার মঞ্চের যথাযোগ্য উদ্যোগে মর্যাদার সাথে পালন করা হবে। 


ঝাড়গ্রাম জেলায় প্রতিটি ব্লকে আদিবাসী অধিকার মঞ্চ, সারাভারত কৃষক সভা, সারা ভারত খেত মজুর ইউনিয়ন ও সামাজিক ন্যায় মঞ্চের উদ্যোগে পালন করার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালে ৩০ শে জুন যে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিলো তাদের বীরত্বের কথা ও লড়াই সংগ্রাম যে ভাবে সংগঠিত করেছিলো তা কেবল আদিবাসী মানুষ নয়, আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষদের এই বিদ্রোহে সামিল করেছিলো। স্থানীয় জোতদার,জমিদার, গোমস্তা,মহাজন, পুলিশ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিলো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নতুন জমিদারি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো। খুবই কষ্ট করে অর্জিত ধনসম্পত্তি সুদখোর,মহাজন লুঠ করতে লাগলো এবং মহিলাদের ওপর  নির্মম অত্যাচার ও সম্মান লুট করার ফলে বিদ্রোহ বিরাটকার ধারণ করে।

 
আদিবাসী অধিকার মঞ্চের মূল উদ্দেশ্য হল—-
  ১) আদিবাসী মানুষকে সচেতন করা ও সংগঠিত করা,২)  সংবিধানে উল্লেখিত — সুযোগ সুবিধা ও অধিকার সর্ম্পকে সচেতন করা।৩)  সমাজে আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা সমস্যা সমাধানে   ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছাড়া অধিকার অর্জন সম্ভব নয়।  বোঝানোর প্রয়োজন রয়েছে। ৪)  সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য, উচ্ছেদ অব্যাহত রয়েছে।  সে সর্ম্পকে অবহিত করানও প্রয়োজন।
RSS, BJP বিভাজনের রাজনীতি সর্ম্পকে  আদিবাসী মানুষদের সজাগ করানো।৫) চাকরী ও কাজের দাবীতে আরো বেশী করে সংগঠিত হওয়ার দরকার।৬)জাতিগত শংসাপত্র দ্রুততার সঙ্গে প্রদান করার বিষয়ে প্রশাসনকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।   ৭) ভুয়ো শংসাপত্র বাতিল ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।৮) আদিবাসী মানুষের বয়সকালের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে। ৯) শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে সরকারকে আর্থিক বৃদ্ধি করতে হবে।