“পার্টির সামনে গুরুতর সঙ্কট” এই শিরোনামে পৃথ্বীরাজ ছদ্মনামে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সমর মুখার্জি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল রচনা করেছিলেন।১৯৬২সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সুযোগ নিয়ে যখন উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে কমিউনিস্ট পার্টিকে শেষ করবার ষড়যন্ত্র চলছিল এবং অত্যন্ত লজ্জার বিষয় এই পার্টির ভিতরকার একাংশও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল ঠিক সেই সময় কমরেড মুখার্জির এই দলিল টি মতাদর্শগত ক্ষেত্রে এক আলোকবর্তিকার কাজ করে।এই দলটির এক অংশে তিনি তৎকালীন শাসক “কংগ্রেস “এবং বিরোধী “স্বতন্ত্র দল “সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন ১৭তম বিধানসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে পার্টির ভরাডুবির পর যখন বিভিন্ন মত উঠে আসছে এমনকি তৃণমূলের সঙ্গে জোটের লাইন পর্যন্ত ঘুরিয়ে বাজারিদের কাছে ছাড়া হচ্ছে সেই সময় কমরেড মুখার্জির এই দলিলের “স্বতন্ত্র দল এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব “এই অংশটির আলোচনা আরোও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বলে আমার মনে হয় দেখা যাক কী ছিল ওই আলোচনায়।


ভারত সরকারের নীতিতে দঃপন্থী ঝোঁক অনেকখানি বেড়েছে ,একথা স্বীকার করেও ডাঙ্গেপন্থীরা মনে করেন এই দঃপন্থী ঝোঁকের উৎস স্বতন্ত্র দল ,জনসংঘ পিএস পি প্রভৃতি দল।এরাই আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধি ।কংগ্রেসের মধ্যেও কিছু কিছু প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধি থাকলেও নেহেরু প্রমুখ কংগ্রেসের অধিকাংশই জাতীয় বুর্জোয়ার প্রতিনিধি।এরা এদের দ্বৈত চরিত্র সত্ত্বেও প্রধানত প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন।নেহেরুকে সরিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ক্ষমতা দখল করতে চাইছে ।অতএব এই অবস্থায় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে নেহেরুর নেতৃত্বেকে সমর্থন করাটাই প্রগতিকামী জনসাধারণের কর্তব্য ।এই ধরনের মতবাদ পার্টির মধ্যে বারবার মাথা তোলার চেষ্টা করেছে ।এই বিষয়টি ধীরভাবে বিচার করে দেখা দরকার।


১মত প্রতিক্রিয়ার উৎস কোনো দলবিশেষ নয় -শ্রেণীবিশেষ।একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণী ও সামন্ততন্ত্র আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার মূল উৎস।বর্তমান শাসক দল এই আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত একথা ভাবা ভুল হবে।


২য়ত,আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া সত্যিই কী নেহেরুকে সরাতে চায়।এটা সকলেই জানেন আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া র দেশের বাইরে প্রেরণার উৎস হল সাম্রাজ্যবাদ প্রধানত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।মার্কিন পত্রিকা টাইমস ৩০শে নভেম্বরের সংখ্যায় এই প্রসঙ্গে লিখেছে”নেহেরু যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তাঁকে ভারতের নেতৃত্ব থেকে সরাবার কথা কেউই গুরুত্ব দিয়ে উন্থাপন করে না।তাঁর দেশের কাছে তিনি শুধু একজন রাজনীতিঞ্জ নন তিনি একজন দেবতা বিশেষ।”প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে এই আক্রমণের অর্থ কি?তার ইঙ্গিত এই টাইমস পত্রিকা দিয়েছে।নেহেরুর ক্ষমতা সঙ্কুচিত করতে হবে ।তাঁকে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার আরোও অনুকূলে আনতে হবে।শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং প্রতিক্রিয়ার পক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার পক্ষে আরোও অনুকূল অবস্থা সৃষ্টিকারী স্বতন্ত্র দল পরস্পর বিরোধী নয় এরা অনেকখানি একে অপরের পরিপূরক।বর্তমান সরকার সামন্ততন্ত্র ও ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হলেও এর উপরে একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।এই সরকারের অনুসৃত নীতির ফলে একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণীই প্রধানত লাভবান হচ্ছে।মাঝারি ও ক্ষুদ্র ধনিকদের স্বার্থ বলিদান দেওয়া হচ্ছে।তাই কংগ্রেস নেতৃত্ব একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিভূ নয় একথা কিছুতেই বলা চলে না।কংগ্রেসের কথা ও কাজের মধ্যে স্ববিরোধিতা আছে।তার কারন একদিকে আসল কাজের সময় একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে হবে অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগণের সমর্থন পক্ষে রাখতে হবে।জনমত পক্ষে রাখবার জন্যই শিল্পায়নের কথা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও ব্যবসার কথা প্রচার করা হয়।কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় এইসব প্রচারকে অবলম্বন করে বামপন্থী শক্তিগুলি জনমত গঠন করে এবং তদনুযায়ী কাজ করবার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে।ফলে সেই চাপের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে প্রচার করে অপরদিকে আর একটি বিরুদ্ধ জনমত গড়ে তোলার দরকার হয় যে কাজ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে করা সম্ভব নয় কেননা ঐ নীতিগুলি জনমত স্বপক্ষে রাখার জন্য কংগ্রেস থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।তাই আর একটি স্বতন্ত্র দলের দরকার পড়ে।অনেকের হয়তো স্মরণে আছে যখন স্বতন্ত্র দল গঠন করা হয় তখন রাজাজী ঘোষণা করেছিলেন “আজ পর্যন্ত যে দলগুলি কাজ করছে তা রাষ্ট্রযন্ত্রে আক্যসিলারেটরের কাজ করছে।ব্রেকের কাজ করবার মতো কোনো দল নেই ।স্বতন্ত্র দল সেই ব্রেকের কাজ করবে।”টাটা,বিড়লা প্রভৃতি একচেটিয়া পুঁজিপতিরা নির্বাচনের সময় প্রকাশ্য মোটা টাকা চাঁদা দেন দুটি দলকে একটি কংগ্রেস আরেকটি স্বতন্ত্র দল।একটিকে তাদের প্রতিভূ হিসেবে শাসন চালাবার জন্য অপরটিকে কংগ্রেস যাতে জনসাধারণের চাপে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের গন্ডি পেরিয়ে যেতে না পারে তার জন্য চাপ সৃষ্টি করার জন্য একই শ্রেনীর দুমুখো নীতির এই বহিঃপ্রকাশ।বাইরে থেকে বিরোধীতা যত তীব্র বলেই মনে হোক না কেন অলক্ষ্যের বন্ধন বেশ শক্ত।তাই দঃপন্থী প্রতিক্রিয়ার ভূত খাড়া করে সেই ভূতের দোসরের কাছেই মাথা বিক্রি করার উপদেশের অর্থ কি?এই দুমুখো নীতির বিরুদ্ধে একইসঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত পার্টিতে গৃহীত হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তই সঠিক সিদ্ধান্ত।


অবশ্য এই বিশ্লষণ থেকে এটা যেন মনে করা না হয় যে নেহেরু নীতির সঙ্গে স্বতন্ত্র দলের নীতিকে পুরোপুরি এক করে দেখা হচ্ছে।পূর্বেই বলা হয়েছে নেহেরুকে জনসমর্থন স্বপক্ষে রাখার দিকে খেয়াল রেখে তার বক্তব্য রাখতে হয় ,তাই সেই বক্তব্যর কিছুটা তফাত থাকে।তাছাড়া একচেটিয়া পুঁজিপতিদের নিজেদের মধ্যেও স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে যা এই সকল রাজনৈতিক দলের বিরোধের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে।তাদের সেই বিরোধের সুযোগ নেওয়া ও জনগণের স্বার্থে তার পূর্ন সদ্ব্যবহার করার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।এখানে যেটা দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে এই কংগ্রেস নেতৃত্বের অনুসৃত নীতি এবং স্বতন্ত্র দলের অনুসৃত নীতি শ্রেণীভিত্তি একই।স্বতন্ত্র দলে যদি ১০জন রাজা মহারাজা আইনসভায় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে থাকে কংগ্রেসে সেখানে স্থান পেয়েছে ২৫জন।গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় একথা প্রমাণিত হয়েছে নেহেরুর মতাদর্শ দিয়ে আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না ,তাকে প্রতিক্রিয়ার পথকেই সুগম করে দেওয়া হয়।আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাতেও দেখা গেছে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করতে পারেনি ,তার পথই প্রশস্ত করেছে।বুর্জোয়া মতাদর্শের একটা রূপ তার আরেকটি রূপের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিষেধক হতে পারে না।কারন তারা একই উৎস থেকে জন্ম লাভ করেছে।একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শ ই আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সফল সংগ্রামের পথ দেখাতে পারে।

লেখক– বিপ্লব ব্যানার্জী