বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খানের পরম স্নেহের নাতি শাহ কুলি খান মীর্জা মোহাম্মদ জং বাহাদুর নবাবী বংশের উত্তরাধীকারী শেষ হকদার। নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষের বাংলায় গোলাম হোসেনরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। গোলাম হোসেন ছিলেন সিরাজের বিশ্বস্ত গোলাম। গোলাম হোসেনরা না থাকলে পারিবারিক শাসনতন্ত্র কায়েম হতে পারে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় রেনেশাঁর ছটায় বাংলার উপরিতল ছিল অগ্রগামী। তথাপি সার্বিক চেতনা ছিল অধরা। পরিণতিতে আড়াই শত বছর পর ক্রীতদাস গোলাম হোসেনদের কবর নড়ে উঠল। প্রায় আড়াই শত কিলোমিটার দূরে আজ নয়া রাজতন্ত্রের পদধ্বনী মেরুদন্ডী গোলামদের ফিনিক্স পাখির মত বেঁচে ওঠা। ইতিহাসে আগে দুবার সিরাজউদদৌল্লা বেঁচে উঠেছিলেন। তবে গোলাম হোসেনদের দৌলতে নয়। বাংলা একটা সর্বজনগ্রাহ্য নায়কের মুখ চেয়েছিল, বীরত্বের অলীক অতিরঞ্জন চেয়েছিল।

১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে প্রাথম পুনর্জন্ম। পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতা লোকমুখে। ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার, অক্ষয় কুমার মৈত্র, নিখিলনাথ রায়, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়রা ফার্সী-ভাষী সিরাজউদদোল্লার দেশপ্রেমকে বাঙালীর সামনে নিয়ে এলেন। গিরীশচন্দ্র ঘোষের নাটকে জেগে উঠল স্বাধীনতাকামী জনগন। ১৯১১সালে মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করল তাবড় ব্রিটিশরাজ। ১৯৩৮সালে আবার নাটক লিখলেন শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। দেশভাগের পরেও ১৯৫১সালে দ্বিতীয়বার পুনর্জন্ম দিলেন সিকান্দার আবু জাফর। উদ্দেশ্য ছিল উর্দূভাষী পশ্চিম পাকিস্তানী খানদের থেকে বাংলাভাষী জনগনকে জাতীয়তাবাদী নায়ক উপহার দেওয়া। নাট্যকারদের কলমে নায়ক বীর, বুদ্ধিমান, বিবেকবান, সততার প্রতীক, প্রজাবৎসল। আড়াইশ বছর পর মনে হয় History repeats itself, first as tragedy, second as farce. মোহান্ধ দাদু আলিবর্দী কোন উত্তরাধীকারীকে দেশের পতনের জন্য সঁপে দিয়ে গিয়েছিলেন?  

আলিবর্দী খান ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত যোদ্ধা। ইংরাজ বণিকের বন্দুক আর তুর্কীর তরবারিতে ফারাক ছিল না বাঙালীর কাছে। তবে বিলেতি লাটরা কোন ভাগ্নে বা ভাইপোকে সম্পদ সঁপে দেবার জন্য বয়ে আনেনি। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের পূর্বের মুখ্যমন্ত্রীরা অকৃতদার ছিলেন। সিদ্ধার্থ ছিলেন নিঃসন্তান। বামপন্হী দুই মুখ্যমন্ত্রীর সন্তান রাজনীতিতে নাক গলাননি। ফলে সিংহাসন হস্তান্তরের পরিকল্পনা দাদু আলিবর্দীর পর পিসির। মাঝে আড়াইশ বছর, আড়াইশ কিলোমিটার। শেষ স্বাধীন নবাবের প্রতি বাঙালীর দুর্বলতা ছিল এবং আছে। সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগমের স্বামী ছিলেন ঢাকার শাসনকর্তা। স্বামীর মৃত্যুর পর হোসেন কুলী খাঁর সাথে ঘসেটি বেগমের গোপন প্রেম ছিল। এদিকে পাঠান বিদ্রোহীদের হাতে সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পর মা আমিনা বেগমও হোসেন কুলি খাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। সেই কীর্তি মুর্শিদাবাদে প্রচার হতে দাদুর সম্মতিতে প্রেমিককে সপরিবারে নিষ্ঠুর সিরাজ হত্যা করেন।

সে সময়ের বিখ্যাত নর্তকীকে রূপে মুগ্ধ সিরাজ মোগল দরবার থেকে এক লক্ষ মুদ্রার বিনিময়ে ফৈজী বাঈকে ক্রয় করে হারেমে নিয়ে আসেন। কিন্তু ফৈজী বাঈ সিরাজের ভগ্নিপতি সৈয়দ মহম্মদ খাঁর সাথে গুপ্ত প্রণয়ে লিপ্ত হলে সিরাজ দখলদারির চেষ্টা করেন। ফৈজী বাঈ সিরাজের মাকে বারাঙ্গনা বলে উল্লেখ করলে তাঁকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। নিখিল রায় ও গোলাম হোসেনের গ্রন্হে ফৈজী বাঈয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নবাব পরিবারের মদ্যপ সদস্য ও সিরাজের ইয়ার দোস্তরা তৎকালীন বাংলায় বহু শত নারীর সর্বনাশ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দী খাঁ সব দেখেও ধৃতরাষ্ট্র হয়ে ছিলেন। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, যাত্রীবাহী নৌকা ডুবিয়ে মানুষের আর্তনাদ উপভোগ করা বা গর্ভস্হ শিশুর মাতৃগর্ভে অবস্হানের রূপ পেট চিরে দেখতে অনীহা ছিল না। রাণী ভবানী সিরাজের ভয়ে তাঁর রূপসী কন্যা তারাসুন্দরীর মৃত্যু সংবাদ রটিয়ে মথুরায় জগৎ শেঠ ভবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

অপরিণত আদরের মধ্যমেধা যুবরাজের চারপাশে কালো ভ্রমরেরা ভনভন করে। ওদের লাম্পট্যের দোষ বইতে হয় নবাবজাদাকে। ধরাকে সরা জ্ঞান করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মোহনলাল একজন সাধারণ রাজকর্মচারী থেকে কী করে মহারাজা ও প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে গেলেন? মোহনলালের রূপসী বোন হীরা বা পরবর্তীকালের আলেয়ার ভূমিকা ছিল। তাদের পুত্র সন্তানও ছিল। অনুপ মাঝি ওরফে লালা, বিনয় মিশ্র, বিকাশ মিশ্র, এনামুল হক ছাড়াও বহু থানার দায়িত্বে থাকা বড়বাবুরা এই সুযোগের সন্ধান করছিল। নবাবী বংশের ভিতরেও লাম্পট্য মাত্রাছাড়া হয়ে গিয়েছিল। বিমান বন্দরে সোনা পাচার সহ শ্বশুর বাড়ির ব্যবসায়ী আত্মীয়রা ফায়দা তুলতে কসুর করে না। অপ্রাপ্তমনস্ক ক্ষমতাশালী তার সম্পদ ও ঐশ্বর্যের প্রদর্শন করে ফেলবেই। এরা ভাবতে পারেন না, একদিন মীরজাফর, ঘসেটি বেগম, উঁমিচাদ, ইয়ার লতিফরা চুড়ান্ত ভোগী যুবরাজকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না, ক্ষতি হবে দেশের।

একজন মেধাবী যুবক যে বয়সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করছে, ঠিক তখন স্রেফ বংশের কোন অগ্রজের লালসায় যুবরাজ সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ মেধাবীদের হুকুম করার ক্ষমতা পাচ্ছেন। ক্রীতদাস গোলাম হোসেনরা ধূর্ত শেয়ালের মত ‘সেনাপতি- সেনাপতি’- বলে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছে। কারণ অশিক্ষিত জনগনের নেতার প্রয়োজন নীতির চেয়ে বেশী। সিপাহী বিদ্রোহে তাই বাহাদুর শাহ জাফরকে নেতা নির্বাচন করা হয়েছিল। নায়ক পূজো আম জনতার জিনগত অসুখ। একাংশ তথাকথিত শিক্ষিত বা সুশীল নামক হায়নারা যুবরাজের দরবারে পৌঁছে যায় সবার আগে। সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরলে, তাঁর পাশে দাঁড়াবার কেউ ছিল না। পালাবার সময়ে চড়ায় নৌকা আটকে যেতে মসজিদে খাদ্য সংগ্রহে গেলে এক ফকির মীরজাফরের কাছে খবর পাঠিয়ে দেন। যুবরাজ থাকার সময়ে সিরাজ সেই ফকিরের একটি কান কেটে দিয়েছিলেন। সেই কানের মূল্য প্রাণের মূল্যে ফিরেছে।

শাসক দলের সাধারণ দুর্বৃত্তরা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মরছে। একাধিক খুন খারাপি, অর্থের বিনিময়ে টিকিট পেয়ে যখন শোষণের ইজারা পাচ্ছে তখন জীবনের অনেকটা বয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরিবারের সন্তান, ভাই বা আত্মীয়দের বেপরোয়া জীবন দুর্বৃত্ত বাপকে বিপদে ফেলে। ক্ষমতার শীর্ষে পরিবারবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তৃণমূল স্তরে তা বিস্তৃত হবেই। মীরজাফরের পুত্র মীরণ সিরাজকে হত্যা করতে দেরী করেননি। কথিত আছে যখন সিরাজের মৃতদেহ হাতির পিঠে নগর পরিক্রমা করছিল, তখন দর্শকরা একটি করে ঢিল ছুঁড়লে ইংরেজ সৈন্য পালাবার পথ পেত না। সিরাজের অতীত মানুষকে বিরত করেছিল। আজ যে সেনাপতি বা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কিংবা যুবরাজ আঙুল উঁচিয়ে শাসাচ্ছেন, তখন ভবিষ্যৎ হাসছে। অসহায় মানুষ চায়নি বাংলার গরু-কয়লা-বালি পাচারের টাকা ব্যাঙ্ককের কাশিকর্ন ব্যাঙ্ক বা ইংল্যান্ডের বার্কলে ব্যাঙ্কে মজুত হোক। সেদিন প্রতিবাদ করতে পারেনি।

সুভাষ চন্দ্র বসু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, জ্যোতি বসুরা ছিলেন ব্যারিস্টার, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রেসিডেন্সির ছাত্র। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় শিক্ষায় প্রবাদ প্রতিম ছিলেন। যখন মেধাবী প্রার্থীদের যোগ্যতা দুর্বৃত্তরা লুঠ করে নিল, তখন আয়েশী যুবরাজ দয়া করে তাদের সাথে কথা বললেন। তারপর মধ্যরাতে পুলিশী সন্ত্রাস। সেই যোগ্য মেধাবীদের চেয়ে যুবরাজের যোগ্যতা বেশী? প্রশ্নটা উঠবেই। একমাত্র উত্তর, তিনি পারিবারিক শাসন কায়েম করা শাসকের নির্বাচিত বংশধর। সাদ্দাম হোসেনর পুত্র উদয়ের চরিত্র সাদ্দামের প্রতি বিরূপতা সৃষ্টি করেছে। (উদয় নামটি ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া।) আজকের শাসক সরণীকে স্বেচ্ছাচারে যদি ধরণী করতে পারেন, সেই তরণী যেদিন ডুববে, সেদিন কোন ঘরনী বাঁচাতে পারবেন না। ধৃতরাষ্ট্র জানতেন তাঁর দুর্বলতা ও অক্ষমতা, তাই তিনি কেবল অন্ধ নন, মোহান্ধ। সেই অন্ধত্বের পরিণতি কুরুক্ষেত্রে। আলিবর্দীর প্রিয় ছিলেন সিরাজ।

আজ যেখানে শান্তিনিকেতন প্রাসাদ পুলিশের কর্ডনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই চাটুকার বাহিনী নিকেতনের শান্তি রাখতে পারবে তো? ভানুয়াতু থেকে বন্ধু বিনয় আসবেন, নাকি যুবরাজকে যেতে হবে ভানুয়াতু? চোর্কুনাল, চোর্কুন্তলদের কাঁকুঁউঁউঁউঁরা ফোঁপড়া করে দিচ্ছে শান্তিনিকেতনের ভিত। আশেপাশের মীরজাফররা ঠিক কখন উন্মুক্ত করবেন তরবারি? অসমেয়ের ভোগ রোগের কারণ। অশিক্ষিত দেশে প্যারাসুট থেকে চেয়ারে নেমে আসা যায়, কিন্তু প্যারাসুটে পতিত উড়ান দিতে পারে না। কার্বাইডে পাকা ফল ডায়মন্ড হারবার মডেলের মত। কিছু মানুষকে কিছু দিনের জন্য বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব মানুষকে চিরকাল বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। গোলাম হোসেনরা বাঁচাতে পারবেন না নবাবী। তখন অন্ধকূপ হত্যার মত অমানবিক অতিরঞ্জিত কাহিনীও মানুষ বিশ্বাস করবে। আড়াইশো বছর পর শিক্ষিত সংখ্যালঘু আধুনিক মানুষ মেনে নেবেন না পরিবারতন্ত্র। সেটাই লালসার বোমে অগ্নিসংযোগ।

ধৃতরাষ্ট্রের কোন দ্বিতীয় সম্ভাবনা ছিল না। তিনি জানতেন বিকর্ণ ছাড়া নিরানব্বই জন পুত্রই হিংস্র। তাই দুঃশাসন, দুঃসহ, দুঃসলদের মাঝে সবচেয়ে শক্তিমান দুর্যোধনকে বেছে নিয়েছিলেন। বিকর্ণ শিক্ষিত সৎ হলেও নেহাৎ সংখ্যালঘু। আলিবর্দী খাঁয়ের বংশে বাতি দেবার মত লোক খুঁজে পাননি। কারণ ধৃতরাষ্ট্র বা আলিবর্দী খানরা তেমন উদাহরণ রাখতে পারেননি। আজ শাসক দলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন সৎ, শিক্ষিত চরিত্র পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়তঃ গোলাম হোসেনরা খানদানী খানসামা হতে পারেন, কিন্তু নবাব হতে পারবেন না। দলের দু নম্বরী মুকুল ঝরে গেছে, আরেকজন প্রেসিডেন্সি জেলে বসে। সুতরাং শাসকের বাছাই করার কোন সুযোগ নেই। নিয়োগ দূর্নীতি থেকে কয়লা, গরু, বালি পাচার বন্ধ করলে সাম্রাজ্যের পতন ঘটবে। নরকের সেই সিংহাসন নারকীয় ব্যক্তির জন্য। কুরুক্ষেত্র বা পলাশীর প্রান্তর কেবল ঐতিহাসিক ভূমি। মূল ভূমি রচনা করেন শাসকের সর্বগ্রাসী লালসা ও ভোগ।