না,প্রয়াত সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের মুখ‍্যমন্ত্রীত্বের সময়কার  পশ্চিমবঙ্গও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর এমন ভয়ংকর পুলিশি আক্রমণ দেখেনি। তখন বামপন্থী রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পুলিশ বিভিন্ন এলাকার তরুণদের তুলত। চোরাগোপ্তা খুন করাত কখনও কখনও নিজেদের হেফাজতে কখনও বাইরে। মহিলা রাজনৈতিক কর্মীদের সম্ভ্রমহানির ঘটনাও বিরল ছিল না।  কিন্তু রাজনৈতিক পতাকা ছাড়া কোন দাবি দাওয়া বিক্ষোভের ওপর পুলিশ বিনা প্ররোচনায় হামলা চালিয়েছে এমন ঘটনার নজির ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ অবধিও খুব বেশি নেই। পাঁচ দশক পরে  মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর পূর্বসূরিকে ছাপিয়ে গেলেন। চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ পত্রের দাবিতে সল্টলেক করুণাময়ীতে পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সামনে  অবস্থান ও  অনশন ধর্মঘট ভাঙতে রাতের অন্ধকারে পুলিশ পাঠিয়ে টেনে হিঁচড়ে প্রিজন ভ‍্যানে তুলে নেওয়ার নতুন নজির তৈরি করলেন তিনি। অনশনরত চাকরিপ্রার্থীরা মার খেয়েছেন,মহিলা চাকরিপ্রার্থীরা নিগৃহীত হয়েছেন। টেলিভিশনে নিয়োগদুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলেছেন এই আন্দোলনে সামিল এমন চাকরি প্রার্থী তিন তরুণ তো বারো ঘন্টার জন‍্য নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। টেলিভিশন চ‍্যানেল, সোশ‍্যাল মিডিয়াতে শোরগোল না পড়ে গেলে কি হত বলা মুশকিল। কারণ এঁদের একজনকে দাগী আসামীদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

দিল্লি,পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ,রাজস্থান  হরিয়ানা জুড়ে যখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নয়া কৃষিবিলের বিরুদ্ধে  কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল তখন বিজেপি রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে এই আন্দোলনে “খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত আছে” এমন প্রচার ছড়িয়ে দিয়েছিল। অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের টেট উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগপত্র না পাওয়া হবু শিক্ষকদের আন্দোলনকে “অবৈধ” বলে চিহ্নিত করে তাঁদের দাবিকেই উড়িয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর তৃণমূল কংগ্রেস।  উদ্দেশ্য সহজবোধ্য। মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জীর মুখরক্ষা করতেই হবে যে কোন মূল‍্যেই। যেদিন মাঝরাতে চুরাশি ঘন্টার অবস্থান ও ছাপ্পান্ন ঘন্টার অনশন ধর্মঘট পনেরো মিনিটের মধ‍্যেই পুলিশ তুলে দিল হাইকোর্টের বিচারপতি লপিতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের একটি রায়কে হাতিয়ার করে সেই ঊনিশে অক্টোবর বিকালেই উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে মুখ‍্যমন্ত্রী বিধাননগর করুণাময়ীতে চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থান নিয়ে  সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছিলেন “আমি ন‍্যায‍্য আন্দোলনকারীদের ভালবাসি!” এরপর টেট পরীক্ষার্থীদের চাকরি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা মাত্র ব‍্যস্ত হয়ে মুখ‍্যমন্ত্রী বললেন “ওটা নিয়ে ব্রাত‍্য বলবে। গর্ভণমেন্টের পক্ষে ওকেই এনটাইটেলড করা আছে। আমি এখন কালিপূজো উদ্বোধনে যাচ্ছি।” ২০২০ সালের ২৭ শে নভেম্বর দ্বিতীয় পর্যায়ের সরকারের মেয়াদ শেষ করার ছ মাস আগে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই এই মুখ‍্যমন্ত্রীই কিন্তু নবান্নের সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন  ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা সবাই চাকরি পাবেন।

তৃতীয়বারের জন‍্য  সরকারে আসার পরেও তিনি এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত‍্য বসু জোর দিয়ে এই নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে হাইকোর্টের নির্দেশে ইডি সিবিআইয়ের তদন্তে টাকার বিনিময়ে প্রাথমিক শিক্ষকের  চাকরি বিক্রি হওয়ার অভিযোগ প্রমাণসহ সামনে আসার পরেই। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জী থেকে অপসারিত পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেপ্তারের পরেই মুখ‍্যমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদবর্গ বুঝে যান শূন্যপদে চাকরি এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের সরিয়ে পদ তৈরি করে যোগ‍্যদের পুনর্বাসন দুটো কাজই কঠিন। ফলে ক‍্যামেরার সামনে “কারুর চাকরি যাবেনা “প্রতিশ্রুতি রাখা এবং পুরোন প্রতিশ্রুতি  “সবাই চাকরি পাবেন “- একসঙ্গে পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।


অগত‍্যা লজ্জাঘেন্নার মাথা খেয়ে  কৌশল নেওয়া হল বেকার যুবক যুবতীদের মধ‍্যে  বিভাজনের।  ২০১৭ সালের টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে সল্টলেকের দশ নম্বর ট‍্যাঙ্কের সামনে অবস্থানে বসলেন। “২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন তাই তাঁরা অযোগ্য”- এই যুক্তি দেখিয়ে ২০১৭ সালের টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা  বললেন বকেয়া  নিয়োগপত্র দিলে প্রথমে তাঁদের কথাই যেন বিবেচনা করা হয়। কারণ ন‍্যাশানাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশনের নিয়ম মেনে তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোগ‍্য প্রার্থী। অন‍্যদিকে  নবনিযুক্ত পর্ষদ সভাপতি গৌতম পাল পূর্বসূরীদের অনিয়ম দুর্নীতির দায় সরকারের শীর্ষ ব‍্যক্তিদের প্রতিশ্রুতি সব ঝেড়ে ফেলে বলেছেন স্বচ্ছ নিয়োগের জন‍্য এন সিটিই র নিয়ম মেনেই তিনি এগোবেন এবং সেই অনুযায়ী চাকরি পেতে গেলে ২০২২ সালের টেট পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের বসতেই হবে। ২০১৪ র টেট উত্তীর্ণ  চাকরিপ্রার্থীরা এই আহ্বানে সাড়া দিতে পারছেন না কারণ, ২০১৪ সালের টেটের সময় ননট্রেন্ডরা পরীক্ষা দিতে পেরেছিল। তখন টেট পরীক্ষায় বসার জন্য ট্রেনিং থাকা বাধ্যতামূলক ছিল না। ২০১৪ থেকে প্রথম রিক্রুটমেন্ট হয় ২০১৬ এর নোটিফিকেশন অনুযায়ী। তখন বিএডরা ননট্রেন্ড হিসাবে ফর্ম ফিলাপ করে। তাদের বিএড ডিগ্রীকে কোনো রূপ মূল্য দেয়নি পর্ষদ। ২০১৬ র নিয়োগে বিএড দের বঞ্চিত করে যাদের কোনো ট্রেনিং ছিল না, একাডেমিক নম্বরে অনেক পিছিয়ে ছিল এমন হাজার হাজার অযোগ্য,টেট ফেল দের টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয় পর্ষদ। ২০১০ সালের ইন্ডিয়া গেজেট অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে আগে ডিএড দের নিতে হবে। তারপর সিট ফাঁকা থাকলে বিএড দের নিতে হবে। তারপর সিট ফাঁকা থাকলে নন ট্রেন্ডদের নিতে হবে।

কিন্তু কেন্দ্র সরকারের এই নিয়মকে পর্ষদ মানেনি।২০২০ সালের নভেম্বর মাসে  CM এর ঘোষণা মতো ২০০০০ টেট পাশ ট্রেন্ড প্রার্থী আছে প্রাথমিকে। তাদের প্রথমে ১৬৫০০ ইন্টারভিউ নিয়ে অ‍্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হবে।বাকিটা ধাপে ধাপে নিয়ে নেওয়া হবে।কিন্তু ১৬৫০০ র মধ্যে মাত্র ১২০০০ এর সামান্য কিছু বেশি সংখ‍্যক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর টি আই  করে জানা গেছে বাকি ১৬৫০০র মধ্যে ৪৫০০ এর বেশি সিট খালি পড়ে আছে,নিয়োগ করা হয়নি। অন্যদিকে বাকি ৩৫০০ সিট যেটা ধাপে ধাপে নিয়োগ দেওয়ার কথা সেটাও নিয়োগ দেয়নি। অনেক প্রার্থী অন্য চাকরি পেয়ে গেছেন,বা দূরে স্কুল পাওয়ার জন্য কাজে যোগ দেননি । সেই সমস্ত নন জয়েনিং সিটে ওয়েটিং দের থেকে নেবার কথা। কিন্তু পর্ষদ কোনো ওয়েটিং লিস্ট প্রকাশ করে নি। ভারত বর্ষের কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় ” You are not included in the present merit list” কথাটি লেখা থাকে না। একমাত্র ২০২০ প্রাইমারি রিক্রুটমেন্ট রেজাল্টে এই কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।এর কারণ ২০০০০ টেট পাশ ট্রেন্ড প্রার্থীদের সকলেই এমপ্যানেল্ড আনএবজর্ভড ছিল।২০১৬ সালের নিয়োগে ৪২০০০ নিয়োগের কথা বলা হলেও বাস্তবে নিয়োগ হয়েছিল ২৫- ৩০ হাজার।বাকি সিট গুলোতে নিয়োগ না করিয়েই পর্ষদ ৪২০০০ নিয়োগ কমপ্লিট বলে ঘোষণা করে।তাহলে ২০১৪ টেট উত্তীর্ণদের দায় ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে  কেন? কেন এখনো এনসিটিই র নিয়ম মেনে ৩৫ জন ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক এই হিসাবে শূন‍্য পদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি? 


সহজ কাজটাই মমতা ব‍্যানার্জীর  সরকার করছে। এই  আন্দোলনকে “”অবৈধ”এবং “অযোগ্যদের অন‍্যায় আবদার “বলে নস‍্যাৎ করা। আপাতত এই আন্দোলনকে  বিরোধীদের সমর্থন করা তৃণমূল কংগ্রেস “ঘোলাজলে মাছ ধরা “- বলে বিদ্রুপ করছেন। তা করুন। যার যেমন অভ‍্যাস। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তো তাঁদের দিতেই হবে শূন্য পদ টাকা দিয়ে যাঁদের কাছে বিক্রি করেছেন,সেই বেচাকেনা কোন বৈধ আইনি উপায়ে হয়েছিল? সেই চাকরি কেনা ভূয়ো মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের মধ‍্যে যাঁরা এখনো  ধরা পড়েন নি,তাঁদের বেতন,ইনক্রিমেন্ট,বোনাস,অবসর – সেসব কোন নিয়মে হবে সেসব তাঁদের জানা আছে তো? অসংখ্য বেকার যুবক যুবতীদের প্রতারণা করার শাস্তি জনতার আদালতে অপেক্ষা করছে।