মুখ‍্যমন্ত্রীর গুণগ্রাহী এক জনপ্রিয় গায়ক টি ভি ক‍্যামেরার সামনে স্পষ্ট স্বীকার করেছিলেন,” প্রতিকূল সমালোচনা আমি ঠিক নিতে পারিনা!” গত ২৫ শে জুলাই নজরুল মঞ্চে বাঙালি সমাজে শিল্প সংস্কৃতি ও খেলাধূলা সহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশিষ্ট বাঙালিদের সংবর্ধিত করার সরকারি অনুষ্ঠানে নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে উদ্ধার হওয়া টাকার সঙ্গে সরকার শাসকদল ও মুখ‍্যমন্ত্রীর যোগাযোগ নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রচারের প্রসঙ্গ তুলে সেই গায়কের প্রিয় নেত্রী মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী স্বয়ং বক্তব্যে প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে সমালোচকদের বিঁধেছেন এই ভাষায় ” রাজনীতি না করলে জিভ ছিঁড়ে নিতাম!”

মুখ‍্যমন্ত্রী অসত‍্য বলেছেন,এমনটা বলা যাবে না। বিরোধীদের মুখ বন্ধ করিয়ে রাখায় দৃঢ় বিশ্বাসী মমতা ব‍্যানার্জী ২০১১ সালে বিপুল সংখ‍্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ার পরেই বামপন্থীদের বিশেষত সিপিআই(এম) কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,” দশ বছর মুখে সেলোটেপ মেরে রাখুন।” না হলে কি পরিণতি হতে পারে তার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছেন, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়কে নিয়ে করা একটি মিম সোশ‍্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করে জেলে যাওয়া অধ‍্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, মুখ‍্যমন্ত্রীকে সারের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করে “মাওবাদী” তকমা পেয়ে আটক হওয়া শিলাদিত‍্য চৌধুরী। আন্দোলনের ময়দানে জীবন দিতে হয়েছে ছাত্রনেতা সুদীপ্ত গুপ্ত এবং যুবনেতা মইদুল ইসলাম মিদ‍্যাকে। নিজের বাড়িতেই পুলিশের হাতে খুন হয়েছেন ছাত্রনেতা আনিস খান। পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম সংবাদ মাধ‍্যম ২০১৬ সালের পর থেকে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বা রাজ‍্য সরকারের কাজকর্মের সমালোচনা কখনও সখনো করলেও মুখ‍্যমন্ত্রীর কার্যকলাপের সমালোচনা করে না। কারণ, মুখ‍্যমন্ত্রী সংবাদমাধ‍্যমকে উপদেশ দিয়েছেন, পজিটিভ নিউজ করতে। শিক্ষকপদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি না পেয়ে পাঁচশো দিন ধরে অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হওয়া ছেলেমেয়েদের জীবনযন্ত্রণার খবর পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বা সরকারের পক্ষে কতটা ইতিবাচক তা অবশ্যই অনুমানের বিষয়। কিন্তু চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি,নারদার স্টিং অপারেশনে শাসকদলের নেতা মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পরে টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির অভিযোগ চালচুরি ত্রিপল চুরি,গ্রামীণ রোজগার যোজনার টাকা সরিয়ে নেওয়া সিণ্ডিকেট তোলাবাজির অভিযোগ কে নেহাতই ছিঁচকে চুরির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে তাতে সন্দেহ নেই। যে অভিযোগে তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথা রাজ‍্যের বর্তমান শিল্পদপ্তরের ও পরিষদীয় বিষয়ক মন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জী (এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করেননি বা মুখ‍্যমন্ত্রী তাঁকে পদচ‍্যুত করেন নি) সপার্ষদ গ্রেফতার হয়েছেন,তা পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন বলা যায়। টেলিভিশনের পর্দায় বস্তা বস্তা নোট এবং টাকার স্তুপ দেখে বর্ষীয়ান সহনাগরিকরা বলেছেন এমন ঘটনা তাঁরা এবং তাঁদের পূর্বসূরীরাও কখনও দেখেন নি। তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট সন্দেহ করছেন টাকার বিনিময়ে অযোগ‍্য প্রার্থীদের শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী পদে নিয়োগ করানোর অভিযোগের সঙ্গে এই উদ্ধার করা কালো টাকার নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। হ‍্যাঁ কোন নগদ টাকার আয়ের উৎস এবং ব‍্যয়ের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ‍্য সরকারের আর্থিক নথিতে না থাকলে তাকে কালো টাকা ছাড়া অন‍্য কিছু বলা যায় না। অসংখ্য যোগ‍্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে সরকারি ও সরকার পোষিত বিদ‍্যালয়ে শিক্ষক অশিক্ষক পদে চাকরি দেওয়ার মত গুরুতর অপরাধের শাস্তি কতটা কঠোর হতে পারে সে বিষয়ে বিতর্ক একপাশে সরিয়ে রেখে বরং দাবি উঠুক বঞ্চিত যোগ‍্য প্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগপত্র দিয়ে নিয়োগপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পূর্ণ করতে হবে। বঞ্চিত যোগ‍্য প্রার্থীদের মামলাকারী আইনজীবী এবং বিচারপতিরা উভয়েই একমত যে উপযুক্ত প্রার্থীদের তালিকা থাকলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করার কোন আইনী প্রতিবন্ধকতা নেই। হাইকোর্টের বিচারপতি সরকারের কাছে শূন‍্যপদ ও উত্তীর্ণ নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা চাইলেও রাজ‍্যসরকারের পক্ষ থেকে এখনও তা দেওয়া হয় নি। গত ২৫ শে জুলাই মুখ‍্যমন্ত্রী নিজে বলেছেন এই দুর্নীতি দূরে থাক নিয়োগ নিয়ে নাকি তিনি কিছুই জানেন না। বিক্ষোভ রত কর্মপ্রার্থীরা তাঁকে সাংবাদিক মারফত মনে করিয়ে দিচ্ছেন, একাধিকবার তিনি এই আন্দোলনমঞ্চে এসে স্বচ্ছ নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন,বলে গেছেন, অবস্থানরত নিয়োগ বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা সবাই চাকরি পাবেন। সিপিআইএম নেতা মহম্মদ সেলিম,সুজন চক্রবর্তী,বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে এস এফ আই এর সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীক উর রহমান, ডি ওয়াই এফ আই এর মীনাক্ষী মুখার্জী, সায়নদীপ মিত্ররা মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রতিটি জনসভায় মুখ‍্যমন্ত্রী লাখ লাখ বেকারের কাজের প্রতিশ্রুতি যেমন দিয়েছেন তেমনি অতি সম্প্রতি নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মামলা লড়ার জন‍্য বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যকে দায়ী করে বলেছেন কেস করার জন‍্যই নাকি তিনি চাকরি দিতে পারছেন না। বামপন্থীরাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন যুক্তি হিসাবে মুখ‍্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কোন সারবত্তা নেই। কোন বাজারি সংবাদ মাধ‍্যমের সেই সাহস নেই যে মুখ‍্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে, যে “এই রাজ‍্যে যখন প্রত‍্যন্ত গ্রামের কোন শৌচাগারও আপনার অনুপ্রেরণা ছাড়া উদ্বোধন করার সাহস কারুর নেই,তখন সরকারের অনুমোদিত বিদ‍্যালয়ে এত চাকরির খবর আপনাকে না জানিয়ে অনুমোদিত হয়েছে এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?” কিন্তু বিজ্ঞাপনের পিছুটান বড়ো কঠিন তার চেয়ে অনেক সহজ বামপন্থীদের প্রতিবাদ মিছিল সভার খবর না দেখিয়ে প্রশ্ন তোলা বিরোধী পক্ষ কোথায়?

আরও একটি জ্বলন্ত সমস‍্যা মিডিয়ার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রীমো মমতা ব‍্যানার্জী আর্থিক দুর্নীতি ও স্বজন পোষণকে দুর্নীতি বলে মানতেই রাজি নন। তাঁর ভাষায় এসব “ছোটোখাটো ভুল”। ইনিই কুড়ি একুশ বছর আগে জর্জ ফার্ণাণ্ডেজের কফিন কেলেঙ্কারির তদন্ত চেয়ে এন ডি এ সরকারের মন্ত্রীসভা বেরিয়ে এসেছিলেন। সেদিনের মমতা ব‍্যানার্জীর সঙ্গে আজকের মমতা ব‍্যানার্জীকে মেলানো যাচ্ছে না। দুর্নীতির সমর্থনে শাসকদলের সর্বোচ্চ নেত্রী যদি লাগাতার প্রচার করেন তাহলে তার সামাজিক কুপ্রভাব পড়বেই। গত সপ্তাহ পর্যন্ত তৃণমূল কর্মী নেতাদের মুখে শোনা যেত “রাজনীতি করলে খরচা পাতি থাকেই রোজগার সেই কারণেই করতে হয়!” এখন অবশ‍্য তাঁরা চুপ। চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি এবং নারদার স্টিং অপারেশনের সময় মুখ‍্যমন্ত্রীরও যুক্তি ছিল ” পার্টি চালাতে টাকা পয়সা লাগেই!” যে কারণে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় “আগে জানলে ওদের টিকিট দিতাম না “বললেও ভোটে জেতার পর নারদার স্টিং অপারেশনে টাকা নিতে দেখা যাওয়া সব তৃণমূল নেতাকেই নির্বাচিত হয়ে আসবার পর তিনি মন্ত্রীসভায় সসম্মানে ঠাঁই দিয়েছেন।

এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেটের তল্লাশিতে তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী বিধায়কদের যোগসাজশের জায়গা থেকে নোটের বাণ্ডিল উদ্ধার হওয়া বেআইনি সম্পত্তির হদিশ পাওয়া আমাদের রাজ‍্যের রাজনীতি ও সামাজিক চিত্রের পক্ষে খুব ভালো বিজ্ঞাপন নয়। কিন্তু সরকারি শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে পণ‍্য করে কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে শিক্ষক অধ‍্যাপক নিয়োগকে ব‍্যবসায়ে পরিণত করার দুর্নীতির রাজনৈতিক বৈধতা পাওয়া আরও বড়ো সর্বনাশের ইঙ্গিত। এখন চিটফাণ্ড ও নারদা ঘুষকাণ্ডের তদন্তের মত যদি এই তদন্তও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বেকার যুবক যুবতী এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য গাঢ় অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।