মিছিল এগোচ্ছে।

দীনেশ মজুমদার ভবন থেকে শুরু করে মল্লিকবাজার মোড় হয়ে পার্ক সার্কাস ক্রসিং পেরিয়ে গড়িয়াহাটের দিকে। গড়িয়াহাট থেকে কালিঘাট শ্মশান যাবে মিছিল। সাথে আছে একটি লাশ। লাশের নাম কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত। ক্যালেন্ডারে দিনটি ছিল ৩রা এপ্রিল।

তখন পড়ন্ত বিকেল। আসতে আসতে সন্ধ্যে নামছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী,তাদের অভিভাবক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কমরেডরা মিছিলে পা মিলিয়েছে। অথচ একটা দীর্ঘপথ লোডশেডিং সেদিন। রাস্তার পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে!! প্রত্যেকের মুখে আতঙ্ক। সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেননি প্রতিবাদ করার জন্য একজন ছাত্রনেতা কে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়!! তবু মিছিল হয়েছিল। ঘৃণা ঝরে পড়েছিল কলকাতার রাস্তায় শাসকের বিরুদ্ধে।

দশটা বছর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে। আজ ২রা এপ্রিল।সুদীপ্ত খুন হওয়ার দশ বছর।

কিন্তু কিসের জন্য আইন অমান্য হয়েছিল ২০১৩র ২রা এপ্রিল?? ছাত্র দের দাবি কী ছিল সেদিন?? সুদীপ্ত গুপ্তর নেতৃত্বে সেদিনের ছাত্ররা কী স্লোগান তুলেছিল??

যদি একবার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখি,ফেলে আসা পথ কে ফিরে দেখার জন্য। তাহলে নিশ্চিত ভাবে লক্ষ্য করবো সেদিনের ছাত্র আন্দোলনের মূল দাবি ছিল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ইউনিয়ন ইলেকশন গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠিত করতে হবে।

যা ২০১১সালের পর থেকে বন্ধ ছিল। তখন শিক্ষামন্ত্রী এই ব্রাত্য বসুই। মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজের গভর্নিং বডি,সিনেট, সিন্ডিকেট,ইসির গণতান্ত্রিক নির্বাচন ২০১১ সালেই অর্ডিনান্স জারি করে বন্ধ করেছিল রাজ্য সরকার। যাতে ভেঙে দেওয়া যায় রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। তারপরই আসে ছাত্র ভোট বন্ধ করার ফতোয়া। শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার সেই শুরু। তারই বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন করে তৎকালীন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন গুলি। নেতৃত্বে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন।

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার উপর আঘাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গোটা দেশেই এই আঘাত বর্তমান।আজ থেকে ৩০বছরেরও বেশ কিছু সময় আগে যখন মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি চালু হয় এই দেশের মাটি তে। শিক্ষা কে পণ্যে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ তখন থেকেই। তখনকার বিড়লা আম্বানি কমিশন হয়ে আজকের জাতীয় শিক্ষানীতি তে যা আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে।বড়োলোকের আর্থিক নীতির সাথে মিশেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ।

বর্তমান পুঁজিবাদ যখন প্রতিনিয়ত নিজের পছন্দ গুলো কেও ঠিক করে দিতে চায়। যখন আমরা প্রচন্ড রকম ব্যক্তিতান্ত্রিক হয়ে উঠছি। যখন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি। যখন ভাবছি বাইরের দুনিয়া চুলোয় যাক!! আমি ভালো থাকলেই হল। তখন সুদীপ্ত কে স্মরণ করা আরোও  প্রয়োজন।

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চললে তো রাজ্যের হাজার হাজার স্কুল বন্ধ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।প্রশ্ন উঠবে স্কলারশিপ বন্ধ নিয়ে।বিতর্কে উঠে আসবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চরিত্র,ইতিহাস কে গুলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস।ছাত্ররা ভাববে বর্তমান সমাজের অব্যবস্থা নিয়ে।

তাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিতর্ক বন্ধ করতে চায় ওরা।তাই তো নির্বাচন বন্ধের ফতোয়া।

ঠিক যেমন করে সুদীপ্ত হত্যার পরে “ঘন্টা খানেক সঙ্গে সুমন” অনুষ্ঠানে লাগাতার ছাত্ররাজনীতি কতো রকম ভাবে খারাপ,তাই নিয়ে আলোচনার আসর বসেছিল। একের পর এক বাংলার এগিয়ে থাকা পত্রিকায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার জন্য কলাম বের করেছিল। সুদীপ্তর মৃত্যু যে একটা হঠকারিতার ফল, তা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল।

থেমে থাকেনি ছাত্র আন্দোলন। এগিয়েছে। আরও গতি সঞ্চার হয়েছে ছাত্র আন্দোলনে।

সুদীপ্ত গুপ্ত খুব ভালো গান গাইতো বলে খুন হয়নি। সুদীপ্ত গুপ্ত খুন হয়েছিল কারণ সে বিপ্লবী রাজনীতির অঙ্গ ছিল বলে। সুদীপ্ত গুপ্ত খুন হয়েছিল কারণ সে স্লোগান তুলেছিল “ছোটো ছোটো কুঁড়ি দের ফোটাবার সংগ্রাম, নিরন্ন মানুষের অন্নের সন্ধানে আমাদের সংগ্রাম, চাকরির দাবি তে বেকারের সংগ্রাম, মজুরির দাবি তে শ্রমিকের সংগ্রাম, ফসলের দাবি তে কৃষকের সংগ্রাম, শিক্ষার দাবি তে ছাত্রের সংগ্রাম…চলছে চলবে”

আসলে এটাই আমাদের শিক্ষা। যে শিক্ষা সুদীপ্ত গুপ্তের মতই আমরা পেয়েছি,আমাদের জীবনের প্রথম পাঠশালা ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের থেকে।

ভারতের ছাত্র ফেডারেশন কোনো শ্রেণি সংগঠন নয়।কিন্তু তার শ্রেণি অভিমুখ আছে নির্দিষ্ট। তা হল সমাজের পিছিয়ে পড়া ছাত্র দের জন্য লড়াই। সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য ওঠা স্লোগান কে শক্তিশালী করা লড়াই এর ময়দানে। এই শ্রেণি অভিমুখ ভুলিয়ে দিতে চায় একটা গোটা ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার দালালেরা। কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত সেই শিক্ষা ভোলেনি।

সুদীপ্ত গুপ্ত খুন হওয়ার দশ বছর পরে এসেও সুদীপ্ত গুপ্তের স্লোগান গুলো ভীষণ রকম ভাবে বাস্তব। খেতে না পাওয়া মানুষের সংখ্যার হিসেবে আজ আমাদের দেশ গোটা পৃথিবীতে প্রথম ১০০-র মধ্যেই নেই। আজও কৃষক তার ফসলের সঠিক মূল্য পায়না। শ্রমিক তার সঠিক মজুরি পায়না। অধিকাংশ ছাত্র তার লেখাপড়ার সুযোগ পায়না।বেকার দের হাতে চাকরি নেই।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রজন্মের ছাত্র আন্দোলনের কমরেডদের আরও একবার তাই শপথ নেওয়ার দিন।

যতোদিন এই শাসন ব্যবস্থা থাকবে ততোদিন “ওদের” বিরুদ্ধে “আমাদের” লড়াই চলবেই।এই লড়াই ঐতিহাসিক ভাবে সত্য।

১৯৩৬এর স্পেনের মাদ্রিদ শহর। ফ্রাঙ্কোর স্লোগান ছিল “হিমোস পাসোদা” অর্থাৎ আমরা অতিক্রম করবো। আর তার জবাবে কমিউনিস্ট নেত্রী ডলোরেস ইবারুরির উদ্বাত্ত কণ্ঠে স্লোগান তুলেছিলেন “লা পাসিওনারিয়া” অর্থাৎ ওদের পথ ছেড়ে দেওয়া হবেনা। সেই শিক্ষা লাতিনের মাটিতে ফুটে উঠেছে চে, ফিদেলের লড়াই এর মধ্যে দিয়ে। সেই শিক্ষাই ফুটে উঠেছে আমাদের দেশের মাটিতে ভগৎ সিং এর লড়াই এর মধ্যে দিয়ে।

এই লড়াই এ আপোষ হয়না। আপোষ করা মানে শাসকের হাত শক্ত করা। শাসকের হয়ে দালালি করা। 

কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত বিপ্লবী রাজনীতির ফসল।

বর্তমান ছাত্র আন্দোলন সেই শিক্ষা নিয় আদর্শ বোধে আরও ঋজু হয়ে এগিয়ে চলুক।

কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত লাল সেলাম!!

কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত অমর রহে!!