দার্শনিক দিক থেকে বিবেকানন্দ ছিলেন শঙ্করাচার্যের বেদান্ত দর্শনের অনুগামী। তবু তিনি একথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন নি, “রামানুজ, শঙ্কর, এঁরা শুধু পন্ডিতমাত্রই ছিলেন, এঁদের হৃদয় ছিল অতি সংকীর্ণ। কোথায় সেই ভালোবাসা, পরের দুঃখে কাঁদে, কোথায় সেই হৃদয়?” এই মানবদরদি হৃদয় নিয়ে এই বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছিলেন একজন সমাজবিপ্লবী। ভারতের শ্রমজীবী শ্রেণিকে তিনি আহ্বান করেছেন, “হে ভারতের শ্রমজীবী, তোমরা নীরব, অনবরত নিন্দিত, পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ব্যাবিলন, ইরান, আলেকসান্দ্রিয়া, গ্রীস, রোম, ভেনিস, জেনোয়া, বাগদাদ, সমরকন্দ, স্পেন, পর্তুগাল, ফরাসী, দিনেমার, ওলন্দাজ ও ইংরেজের ক্রমান্বয়ে আধিপত্য ও ঐশ্বর্য। আর তুমি—কে ভাবে একথা ! ” অপরদিকে উচ্চবর্ণের অভিজাত সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন—“তোমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নতুন ভারত বেরুক।” তাঁর স্বদেশচিন্তা ও শ্রমজীবীদের স্বার্থচিন্তা একান্ত বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। ১৮৯৪ সালের নভেম্বরে শিকাগো থেকে দেওয়ান হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লেখা চিঠিতে তার উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া যায়—‘কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীদের জন্য চিন্তা করিয়াছে? অথচ ইহাদের নিষ্পেশন করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি। দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশি কেন? একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল।—বস্তুত জমিদার ও পুরোহিত বর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল। আর সেই জন্যই বাংলাদেশ, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশি।

অলৌকিক অনুভূতির উপর গভীর বিশ্বাসসঞ্জাত শঙ্কর বেদান্তের অনুগামী হয়েও তাই মানুষের মর্মবেদনায়, সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিবাদে প্রচন্ড বিক্ষোভে বিবেকানন্দের হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠত। সর্বক্ষেত্রেই তিনি হৃদয়ের দরদ মিশিয়ে এক মানবধর্মী বৈদান্তিক ব্যাখ্যার উপর জোর দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ সর্বত্রই বেদান্তের ব্যাখ্যা করেছেন জ্ঞানযোগে ও কর্মযোগে, মায়াবাদকে তিনি কখনোই আশ্রয় করেননি। শঙ্কর থেকে মধুসূদন সরস্বতী পর্যন্ত কোনও বৈদান্তিকের মধ্যে বৃহত্তম মানবিকতার লেশমাত্র পাওয়া যাবেনা। কারণ তাঁরা সমাজদর্শন বা সমাজবীক্ষাকে তাঁদের দর্শন চিন্তায় স্থান দেন নি অথবা মনু সংহিতাকেই সমাজদর্শনের শেষ ও সার কথা বলে ধরে নিয়েছিলেন। যে মনু সংহিতা অস্পৃশ্যতা ও জাতপাত ব্যবস্থার সংহতকরণে প্রয়াসী ছিল। বিবেকানন্দ বারবার ঘুরে ফিরে দর্শনের মানবিক মর্মকেন্দ্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সকল মানুষ যখন এক, নিখিল বিশ্ব যখন একই ব্রহ্মের সংহত মূর্তি (Perfect Soliderity of the Universe) তখন মানুষের উপর মানুষের বৈষম্যমূলক শোষণ ও নিপীড়ন এই শাশ্বত সত্যের বিরোধী, অদ্বৈত বেদান্তের ব্যাভিচার।

    মানবচেতনা বিকাশের প্রথম পর্ব রেনেসাঁ বা নবজাগরণ, দ্বিতীয় পর্ব রিফর্মেশন বা সমাজ সংস্কার এবং তৃতীয় পর্ব হল রেভেলিউশন—বিপ্লব। বিবেকানন্দের মধ্যে ছিল রেনেসাঁর সুনিশ্চিত উত্তরাধিকার এবং সেই উত্তরাধিকার বহন করেই তিনি তাঁর সমগ্র জীবদ্দশায় দাঁড়িয়েছিলেন রিফর্মেশনের পরিধিতে। যদিও ইউরোপে রিফর্মেশনের পরিধি ছাড়িয়ে মানবসভ্যতা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে গিয়েছিল শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে। বিবেকানন্দের অভিজ্ঞতা ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তাঁর হয় নি। কিন্তু নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও মানব সভ্যতা সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞানই তাঁকে অনাগত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবীতা সম্পর্কে প্রত্যয়ী করে তুলেছিল। বিশিষ্ট ফরাসি পন্ডিত রোঁমা রোঁলার গ্রন্থে ভগিনী ক্রিস্টিনের কাছে করা বিবেকানন্দের ভবিষ্যদ্বাণী এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য—‘The next great upheal which is to be bring about a new epoch will come from Russia or China. I can’t quite see which, but it will be either Russia or China.’

    সাধারণ যুক্তিতে শূদ্রশাসন অপ্রতিরোধ্য, কারণ জনসমষ্টির অধিকাংশই শ্রমজীবী—তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে বাধা দেবার শক্তি কার? এই ভাবনার অনুসারী হয়েই তিনি শূদ্র জাগরণ ও অভ্যুত্থান সম্পর্কে নিঃসংশয় ছিলেন। ‘They must have it, none can resist it.’ বিশিষ্ট মার্কসবাদী ব্যক্তিত্ব ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর শূদ্রশাসনের তত্ত্ব সর্বহারা শাসনের একটি ‘হিন্দু’ রূপান্তর। তাঁর লেখাতেই প্রথম ভারতের অবহেলিত শ্রেণি—অজ্ঞ, মুচি, মেথর, চণ্ডাল ইত্যাদি গোত্রের মানুষদের সমাজে উপযুক্ত মর্যাদায় স্থান দেবার কথা ধরা পড়েছিল।

   জনসাধারণের প্রতি ভালোবাসা ও করুণায় প্লাবিত হৃদয় নিয়ে বিবেকানন্দ একটি নতুন শব্দ চয়ন করেছিলেন—‘দরিদ্র নারায়ণ’। কথাটির অর্থ ‘দরিদ্র ও অনুন্নতদের মধ্যস্থিত ভগবান’। এই কথাটার মধ্যে যে কর্তব্যবোধের নির্দেশ রয়েছে তা হল—যদি কেউ ভগবানের সেবা করতে চায় তাহলে তাকে মানুষের সেবা করতে হবে। জাতিভেদ প্রথার সঙ্গে তাঁর ছিল আপসহীন শত্রুতা। অস্পৃশ্যতাকে তিনি সর্বদা ঘৃণা করতেন। ভারতীয় ইংরাজিতে ‘ডোন্ট টাচ ইজম’ শব্দটি তাঁরই সৃষ্ট।

   বিবেকানন্দ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ বা মার্কসবাদ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন কিনা বলা কঠিন। কিন্তু তিনি অবশ্যই মার্কসবাদের পূর্ববর্তী কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর জীবদ্দশায় ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানই তাঁকে রবার্ট ওয়েন, শার্ল ফুরিয়ে, সাঁ সিমো প্রমুখ সমাজতাত্ত্বিকদের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। সেই মতবাদের প্রভাবেই যুগ যুগ ধরে বহমান বর্ণ ও শ্রেণিভেদভিত্তিক সমাজকে বদলে দেবার পথ হিসাবে তিনি সমাজতন্ত্রকেই অগ্রপথে স্থাপন করেছেন এবং বলেছেন—‘আমি সমাজতন্ত্রী, কারণ এই নয় যে সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি মেলাও ভালো।—একই মানুষের দল সবসময় সুখ বা দুঃখ ভোগ করে যাবে; তার চেয়ে বরং সুখ-দুঃখের একটা পুনর্বন্টন হওয়াই ভালো।’

   এই বৈদান্তিক সন্ন্যাসী প্রচার করতে চাইলেন শঙ্কর-বেদান্ত কিন্তু ঘোষণা করলেন শোষিত মানুষের মর্মবাণী। আহ্বান জানালেন সাম্যবাদী শূদ্রবিপ্লবকে। নিজের উত্তরণ ঘটালেন ভক্তিযোগ থেকে কর্মযোগে, লৌকিক ধর্ম থেকে নিত্যধর্মে। তাই বিবেকানন্দ কেবল ধর্মীয় নেতার পরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন না। তিনি ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের নেতা। বেদান্ত দর্শনকে নিজের শ্রেণিচেতনা ও রাজনৈতিক চেতনার দ্বারা ব্যাখ্যা করে নবজাগরণের বিকাশে সাহায্য করেছিলেন। সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতাই তাঁকে বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যায় অন্য ধারার মৌলিকত্ব প্রদান করেছিল।

তাঁর কাজ সাদা চোখে হিন্দুধর্ম প্রচারের আন্দোলন রূপে প্রতিভাত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল বিদেশী শাসকদের পায়ের তলায় দলিত মথিত ভারত আত্মার পুনরুথ্থানের আন্দোলন, বিদেশী সংস্কৃতির আধিপত্যের বিপরীতে স্পর্ধিত ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ানোর আন্দোলন।