একেই বলে চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের মেজাজ! ২৯শে আগষ্ট বেলা সাড়ে বারোটা থেকে যাদবপুরের এইট বি বাসস্ট‍্যাণ্ডে ঝকঝকে ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত যখন ধীরে ধীরে বাড়ছিল মনে পড়ছিল ধর্মতলায় আনিস খানের মৃত্যুর বিচার চাওয়া ইনসাফ সভার মেজাজের কথা। না,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র র‍্যাগিংয়ের অত্যাচারে মৃত স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর সঙ্গে সি এ এ, এন আর সি বিরোধী আন্দোলনের তরুণ বামপন্থী নেতা আনিস খানের তুলনা করার প্রশ্নই নেই,কিন্তু ২০২২ সালের ২০শে সেপ্টেম্বরের ইনসাফ সভা যেমন তীব্রতর করেছিল তৃণমূল সরকারের দলদাস পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত যুব আন্দোলনকে, তেমনই এই বছরের ২৯শে আগষ্ট যাদবপুরের স্বপ্নের সমাবেশ বহুদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে এস এফ আইয়ের সুস্পষ্ট অবস্থান জানিয়ে দিল ক্যাম্পাস একইসাথে রাগিং মুক্ত এবং নৈরাজ্য ও বিদ্বেষের রাজনীতিমুক্ত রাখার জন্য জানকবুল লড়াইয়ের কথা। মেঘলা আকাশ টিপ টিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রাক্তন ও বর্তমান এস এফ আই কর্মীদের ভিড় জমছিল যাদবপুর এইট বি বাসস্ট‍্যাণ্ডের পাশে যাদবপুর কফি হাঊসের সামনের রাস্তায়।

লাল তারা আঁকা শাদা পতাকায় সাজানো মঞ্চ থেকে এস এফ আইয়ের রাজ‍্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বার বার ঘোষণা করছিলেন,”পুলিশ এই সভার অনুমতি দেয়নি,কিন্তু আমরা সভা করবই! “জমায়েত বাড়ছিল বলেই অ‍্যাসিস্ট‍্যান্ট কমিশনার পদমর্যাদার অফিসারের নেতৃত্বে মোতায়েন পুলিশবাহিনী প্রথম থেকেই কিছুটা দমে যায়। একে একে বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল ঢুকতে থাকে আর মঞ্চের সামনে বিছিয়ে রাখা পলিথিনের চাদর ছাপিয়ে ভরে যায় ফাঁকা চেয়ারগুলো। আধঘন্টার মধ‍্যেই এইট বির পাশে অটো স্ট‍্যাণ্ডের লাগোয়া লেনিনমূর্তি ছাড়িয়ে রাজা এস সি মল্লিক রোডে পৌঁছে যায় ভিড়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এফ আই নেতৃত্বের পাশাপাশি বিরাট সংখ্যক সমর্থক ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কথা বলে বোঝা গেল,তৃণমূল বিজেপি সহ মিডিয়ার একাংশের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ঢালাওভাবে নেশাখোর অপরাধমনস্ক হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার কারণে ক্ষোভে ফুটছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন প্রাক্তন ছাত্র মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী ও নীলোৎপল বসু বক্তব্য রাখবেন স্বপ্পের সমাবেশে সেই আকর্ষণেই বহুদিন আগে ছাত্রজীবন শেষ করেছেন এমন অনেকেই এসে অপেক্ষা করছিলেন সভাস্থলে।মেদিনীপুরে রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে মহম্মদ সেলিমের পৌঁছাতে দেরি হবে জেনেও অপেক্ষা করছিলেন ধৈর্য ধরে। র‍্যাগিংয়ে নিহত নদীয়ার বগুলার বাসিন্দা ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডু র খুনের বিচার চেয়ে “স্বপ্নের সমাবেশ “এর বিশাল আকার দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

এই সভা শুধু এস এফ আই নয় বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সম্মানরক্ষার জন‍্য জরুরি ছিল। ১০ ই আগষ্ট গত ১৪ ই আগষ্ট বেহালায় প্রকাশ‍্য জনসভায় স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন‍্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের “মার্কসবাদীদের “দায়ী করার পরেই, ছাত্রমৃত‍্যু নিয়ে রাজনীতি না করার উপদেশ দেওয়া বাজারি মিডিয়া নিমেষেই তাদের অবস্থান পাল্টে এস এফ আইয়ের সঙ্গে নকশালপন্থী এবং বামপন্থী মুখোশ পরা স্বাধীন ছাত্রসংগঠনকে একই বন্ধনীর মধ‍্যে রেখে তাদের ওপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাগিংয়ের দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করে। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের অধিকাংশের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের যোগাযোগ যত বেশি উন্মোচিত হয়েছে ততই টেলিভিশন চ‍্যানেলের সঞ্চালক ও সঞ্চালিকাদের বড়ো অংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং বন্ধ করার প্রচারের চেয়ে এস এফ আইয়ের ঘাড়ে ক‍্যাম্পাসে র‍্যাগিং সহ নেশা ভাঙের দায় চাপিয়ে দিতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। টক শো চলাকালীন এস এফ আই নেতানেত্রীরা এবং বামপন্থী মুখপাত্ররা যতই র‍্যাগিংকে ক্ষমাহীন অপরাধ এবং স্বপ্নদীপের মৃত্যুর তদন্ত করার সময় কেস ডায়েরিতে খুনের ধারা যুক্ত করার দাবি জানাচ্ছিলেন ততই সঞ্চালকরা তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে সব বামপন্থী ছাত্রসংগঠনকে কাঠগড়ায় তুলতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। একটি সংবাদ চ‍্যানেলের ডেপুটি এডিটর তো এস এফ আইয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান নেতা নেত্রীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় নিয়মিত জড়িয়ে পড়ছিলেন মুখ‍্যমন্ত্রীর লক্ষ্যভেদ না হওয়ার কারণে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক‍্যাম্পাসে টি এম সি পি ও এবিভিপির কমজোরি সংগঠন তাঁদের নিষ্ফল ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল সন্দেহ নেই। স্বপ্নের সমাবেশে যখন স্বপ্নদীপের খুনিদের বিচার চেয়ে যাদবপুর এইট বি বাসস্ট‍্যাণ্ডের পাশের রাস্তায় জনসভায় যখন সৃজন ভট্টাচার্য বলছিলেন “আমরা দুর্বলের ওপর সবলের অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে।

সে জন‍্যই বলছি যে বামপন্থী সে অন্তত র‍্যাগিংকে সমর্থন করতে পারে না। ” তখন সভায় উপস্থিত মিডিয়ার প্রতিনিধিদের অনেকের মুখেই অস্বস্তির ছায়া দেখা গেল। শুধু তাই নয় আগের দিন অর্থাৎ ২৮শে আগষ্ট ধর্মতলায় তৃণমূল ছাত্রপরিষদের সমাবেশকে লক্ষ্য করে চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন সমাবেশের সভাপতি এস এফ আইয়ের রাজ‍্য সভাপতি প্রতিকউর রহমান, ছাত্রসংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক দীপ্তজিৎ দাস, রাজ‍্যসম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নবনীতা চক্রবর্তীরা,হিম্মত থাকলে দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করুন। কলেজে ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্র ছাত্রীদের হুমকি ফতোয়া দিয়ে সমাবেশে নিয়ে যাওয়া সুস্থ ছাত্ররাজনীতির নিদর্শন নয়।