১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যাঁতাকলে ১৫০ বছর ধরে জোতদার-জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণের শিকার হতে হয়েছে কৃষককে। মাঝেমাঝে কৃষকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও সর্বাত্মক সংগঠিত চেহারা নিতে পারেনি সেইসব আন্দোলন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৩০-এর দশকে সংঘটিত আধিয়ার আন্দোলন। অর্থাৎ ফসলের অর্ধেক অংশের দাবিতে আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে আকাল ও আর্থিক দুর্দশা কৃষকের জীবনকে ছারখার করে দেয়। বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তরে সরকারি হিসাবে ৩০ লাখ ও বেসরকারি হিসাবে ৫০ লাখ মানুষ মারা যায়। যার সিংহভাগ গরিব বর্গা ও ভাগচাষি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অগণিত কৃষকের। বিগত ছয়-সাত বছর ধরে বাংলার ভূমি রাজস্ব কমিশনের ফসলের তিনভাগের দুইভাগ অংশ কৃষকের প্রাপ্য এই মর্মে সুপারিশ নিয়ে টালবাহানার শেষে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সিদ্ধান্ত ক্রমে ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে ফসল কাটার মরশুমে শুরু হয়ে যায় তেভাগার সংগ্রাম।ফসলের তিনভাগের দুইভাগ কৃষকের ও একভাগ জমিদারের এই দাবিতে আন্দোলন।তৎকালীন যুক্ত বঙ্গের ময়মনসিংহ থেকে দক্ষিণে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ১৯টি জেলায় প্রভাব পড়েছিল এই আন্দোলনের।

আন্দোলন চলেছিল পাঁচ বছর। কৃষকের দুর্বার সংগ্রামের বিপ্রতীপে জমিদারের বাহিনী ও প্রথম দিকে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী ও পরের দিকে স্বাধীন দেশের সরকারের পুলিশ বাহিনীর আক্রমণে সারা বাংলায় আশিজন কৃষক শহীদ হন। তার মধ্যে বাংলার শস্যভাণ্ডার বলে খ্যাত এক দিনাজপুরেই শহীদ হন চল্লিশ জন। তেভাগা আন্দোলন ছিল উত্তুঙ্গ শ্রেণি চেতনায় ভাস্বর একটি ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন। মুসলমান, আদিবাসী, নমঃশূদ্র গোত্রের ষাট লাখ কৃষক এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে অংশ নেয়। জোতদার, পুলিশ তথা রাষ্ট্রীয় কোনো নিপীড়ন তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। তেভাগা আদায় করে ছাড়ে চাষিরা। আন্দোলনের তুমুল প্রত্যয়ী চেহারা, ত্যাগস্বীকার ও শ্রেণিচেতনা উপজীব্য হয়ে ওঠে শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য স্রষ্টাদের। তাঁরা অসংখ্য অমর সৃষ্টি রচনা করেছেন এই আন্দোলনকে ঘিরে। খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেই আলোচনা তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা।গণসংস্কৃতিতে সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠাই স্বাভাবিক।

এই স্বাভাবিকতায় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নানা দিক ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সৃষ্টিতে। এর মধ্যে রয়েছে ছোটো গল্প, কবিতা, গান, চলচ্চিত্র, রিপোটার্জ ইত্যাদি। বিশিষ্ট মনস্বী গোপাল হালদার ওই সময়ের কালজয়ী সৃষ্টির কথাকে গণনায় রেখে একে আখ্যায়িত করেছেন ‘মার্কসবাদী রেনেসাঁ’ নামে। প্রথমে আসা যাক সাহিত্যের কথায়। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি অমূল্য সৃষ্টি ‘হারাণের নাতজামাই’ ও ‘ছোটো বকুলপুরের যাত্রী’। এই দুটি গল্পকে নিয়ে চলচ্চিত্র ও নাটক সবই হয়েছে। এছাড়াও মানিক বাবু তেভাগার ওপর আরো কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন।

এছাড়া ওই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘মন্ত্রশক্তি’,  মিহির ভট্টাচার্যের ‘দালাল’,নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’, অসিত ঘোষের ‘সামনে লড়াই’ এবং আরো কয়েকটি গল্প ‘জয়দ্রথ’, ‘চৈতালি আশা’, ‘ব্যান্ডেজ’ তেভাগার সময় গ্রামীণ গরিব মানুষের মানসিক টানাপোড়েন এবং অবশেষে আন্দোলনকারীদের পাশে এসে সামিল হওয়ার ঘটনাকে তুলে ধরে। অর্থাৎ সংগ্রামের পক্ষে মানুষের মনের বিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে। তেভাগা সংগ্রামের সবচেয়ে সফল নাটক অনিল ঘোষের একাঙ্ক ‘নয়ানপুর’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তৎকালীন যুক্ত চব্বিশ পরগনার সাম্যবাদী নেতা খগেন রায়চৌধুরী (খেপুদা) এই অনিল ঘোষ, রঘু চক্রবর্তী, সলিল চৌধুরী প্রমুখ তরুণদের গণ আন্দোলনে সামিল করে সাংস্কৃতিক সৃষ্টিতে প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন।

খেপুদার প্রেরণাতেই সলিল চৌধুরী বিদ্যাধরীর বন্যায় ত্রাণের কাজে অংশ নেন এবং গান রচনা করেন ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে’। সলিল আরো লেখেন ‘পৌষালী বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলো আকাশে’ এইসব গান। শহীদ স্মরণে সলিল লিখলেন কালজয়ী গান ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ণ খুঁজি এই আঁধারের রাতে’। বিনয় রায় রচিত ওই সময়ের একটি গানও সাড়া ফেলে ‘আর কতকাল বল কতকাল’। সেই সময়ের আর একটি নাটকের কথা উল্লেখযোগ্য —‘ মৃত্যু নেই’। সম্ভবত সেটির রচয়িতা সলিল চৌধুরী। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে কতকগুলি সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র হল ‘ছিন্নমূল’, ‘দো বিঘা  জমিন’ কাহিনী সলিল চৌধুরী, ‘রিকসা ওয়ালা’ ও ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’।   

 বিশিষ্ট চিত্রকর সোমনাথ হোড়ের ‘তেভাগার ডায়েরি’ ওই সময়ের একটি জীবন্ত দলিল। এছাড়া পূর্ণেন্দু পত্রীর তেভাগার রিপোর্টাজও একটি অনন্য দলিল, যা প্রকাশ পায় মাসিক সাহিত্যপত্র ‘নতুন সাহিত্য’ বৈশাখ, ১৩৬০ থেকে মাঘ,১৩৬০ পর্যন্ত ‘অন্য গ্রাম অন্য প্রাণ’ নামে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার পরে এই ধরনের সৃষ্টিগুলি সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মূল্য নিয়ে পাঠকের কাছে অন্য তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়।     

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, ননী ভৌমিক, সুশীল জানা, সমরেশ বসু, সৌরী ঘটক, মিহির আচার্য, মিহির সেন, আবু ইসহাক প্রমুখের রচিত অন্তত কুড়িটি গল্প বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের মাধ্যমে তেভাগা আন্দোলনের ধারাকে বহন করে চলেছে।   

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সমরেশ বসুর গল্প ‘প্রতিরোধ’, সৌরী ঘটকের উপন্যাস ‘কমরেড’,শিশিরকুমার দাসের উপন্যাস ‘শৃংখলিত মৃত্তিকা’ ,আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘বন্দোবস্তী  ‘ ইত্যাদির কথা। এই স্বল্প পরিসরে সবকিছুর উল্লেখ সম্ভব নয়।এর সাথে ছিল অল্প হলেও কবিতার সম্ভার। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষ্ণু দে’র কবিতা ‘মৌভোগ’, সুকান্তের কবিতা ‘দুর্মর’ ও ‘দুর্ভিক্ষ’ এবং অবশ্যই সলিল চৌধুরীর ঐতিহাসিক কবিতা ‘শপথ’।

   নিবন্ধে ইতি টানব সলিল চৌধুরীর কালজয়ী গণসংগীত প্রসঙ্গে দুয়েক কথায় আলোচনা উপস্থাপন করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে খগেন রায়চৌধুরী (খেপুদা)-র অনুপ্রেরণাতেই সলিলদার গণসংগীতকার হিসেবে গড়ে ওঠা। গণসংগ্রাম গণশিল্পীর জন্ম দেয় এক্ষেত্রে তাই এক অমোঘ সত্য হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।”হেই সামালো ধান হো/কাস্তেটা দাও শান হো” এবং ”আয় রে ও আয় রে/ভাই রে ও ভাই রে” দুটি উল্লেখযোগ্য গান। যদিও পরবর্তী সময়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রেকর্ড করা  গানটির সঙ্গে মূল গানটির অনেকটাই তফাৎ পরিলক্ষিত হয়।


আয় রে ও আয় রেভাই রে ও ভাই রেভাই বন্ধু চল যাই রেও রাম রহিমের বাছাও বাঁচা আপন বাঁচা চলো ধান  কাটি আর কাকে ডরি নিজ খামার নিজে ভরি, কাস্তেটাশানাই রে।এই চাষী হবে জমির মালিকস্বরাজ হলে শুনিএখন মালিক যত ঘুঘু শালিকপেশাদারি খুনীআর নেতা বড়ো বড়ো সব বক্তৃতাতে দড়এখন নিজ হাতে ভাগ্য গড়ারএসেছে সময় রে।লাল বাঁদরের পোষা হাতিরঅত্যাচারে কতএই ভেঙেছে ঘর মরেছে ভাই মা- বোন লক্ষ শতঐ কমলাপুর বড়া, আর কাকদ্বীপ ডোঙ্গাজোড়াএসেছে ডাক চলো না সবাই সোনা  তুলি ঘরে।ও গাঁয়ের যত মা- বোন আছে,তোমরা থেকো ঘরেঐ আশবঁটী আর কাটারিটা রেখো হাতে করেযেন দালাল বেইমান যত, পায় শিক্ষা উচিত মতোএই বাংলাদেশের মা-বোন কতশক্তি হাতে ধরে।