মানুষ খালি হাতে সিংহ মারে না, মারলে খবর হয়। মিডিয়ার কাজ খবর প্রকাশ করা। কেউ যদি ভাবে খালি হাতে সিংহ মারা সম্ভব, তাহলে মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়বে, যেটা খবর হয় না। মৃতদের কবর ভরাটের সংবাদে বাজার নেই বলে ব্যর্থতার নজির গোপনে থাকে। সৌরভ গাঙ্গুলির সাফল্যের পর প্রতি মহল্লায় ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের হিড়িক উঠেছিল, দ্বিতীয় সৌরভ পাওয়া যায়নি। কেবল মাত্র সফলের খবর হওয়া কিন্তু তাকে অনুসরণে পাহাড় প্রমাণ ব্যর্থতা আড়ালে থেকে যাওয়াই Survivorship Bias.

আমরা সবাই কম বেশী Survivorship Bias এ ভুগি। অনেকে প্রশ্ন করে, নিয়োগে বিপুল দূর্নীতি সত্ত্বেও তৃণমূলের ভোট বাড়ছে কী করে? মনে করুন, তিন বারে মাধ্যমিক পাশ করা ভোদাই নেতাকে ঘুষ দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষক হল। সকালে টেরি বাগিয়ে মাস্টার পড়াতে যায়। সেটাই বিজ্ঞাপন। নেতা কাউকে ঘুষের প্রস্তাব দেয় না। পাড়ার জগাইরা রাতে নেতার দুয়ারে হাজির হয় টাকার বান্ডিল নিয়ে। চাকরি তো সীমাবদ্ধ। নেতার খেতে খেতে পেট ফুলে যায়। চাকরি হয় না, টাকা ফেরৎও নয়।

জগাইরা গোপনে নেতার কাছে বিনিয়োগ ফেরতের আব্দার করে। সেটা কিন্তু খবর হয় না, খবর হয় ভোদাই। যেদিন জগাইরা পেদাইদের নিয়ে লাঠি হাতে নেতার বাড়ি যাবে, সেদিন শ্রীলঙ্কার মত খবর হবে। কারণ মানুষ সবচেয়ে সহজ পথে লাভের কড়ি গুণতে চায়। তাই বাজারে যতই দূর্নীতির কেচ্ছা থাক, Survivorship Biasএর তাড়নায় ভোদাইকে দেখে মানুষ তৃণমূলের পেছনে ছোটে। ঘুষের অঙ্ক বাড়ে। আসলে মানুষ নিজ ক্ষমতাকে বিচার না করেই সর্বাধিক সাফল্যের তাড়নায় নির্লজ্জ হয়ে ছোটে।

একজন মুখ্যমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনা করেন, কারণ তিনি একজন মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেখেছেন। সুতরাং Survivorship Biasএর মানসিকতা সমাজের নিম্নতম স্তর থেকে উচ্চতম শক্তিধরে বিদ্যমান। বস্তির একজন চোর, কোন চোরের সাফল্য দেখে বড় হয়েছে। কত চোর পথে অক্কা পেয়েছে তা জানে না। চাঁদের পাহাড়ে শঙ্কর যতই হীরের খনির দিকে এগিয়েছে, ততই নর কঙ্কালের সংখ্যা বেড়েছে। কোন লক্ষ্য স্হির করার আগে সাফল্যের ঐতিহাসিক ও বাস্তবিক হার বিচার করা উচিৎ।

০০২- Swimmer’s body illusion

আপনি প্রাত্যহিক সাঁতার কাটলে সাঁতারুর মত পেশীবহুল পেলব শরীর হবে না। জন্মগত শারীরিক আনুকুল্য এবং অভ্যাস সাঁতারুকে এই পেশায় সাফল্য দিয়েছে। প্রসাধন, পরিচ্ছদ থেকে অলঙ্কারে সুন্দর/সুন্দরী মডেল প্রদর্শন করা হয়। ওরা আদপেই সেই প্রোডাক্ট ব্যবহার করে সুন্দর/সুন্দরী হয়নি। বরঞ্চ ওদের সৌন্দর্য ব্যবহার করে আপনাকে আকর্ষণ করছেন বিক্রেতা। এই সহজ সত্যটা জেনেও আমরা বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিতে অভ্যস্ত। বিপননের এই ধাঁধাকে বলুন Swimmer’s body illusion.

এসব সহজ উদাহরণ। আমরা বলি, প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের মান খুব উন্নত। একটু ভেবে দেখুন, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ন্যুনতম মেধার মান অতিক্রম করতে হয়। সেই প্রাথমিক মেধাই ফারাক করে দেয়। এটাও এক ধরণের Swimmer’s body illusion. সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন যদি ভর্তিকে ঘুষের আওতায় আনতে পারে, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচিরে আরেক সাধারণ মানের কলেজ হয়ে যাবে। তাই আঁধারেও ভাল কলেজে বামপন্হী আন্দোলন আছে।

বামপন্হীরা সাম্যে বিশ্বাসী। দক্ষিণপন্হীরা স্তর-ভিত্তিক সমাজকে ভবিতব্য মানে। একজন পিতার বয়সী তৃণমূল কর্মী অনায়াসে ভাইপোর পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ ভিক্ষা করে। এক্ষেত্রে নেতার পদস্পর্শে সম্মানের চেয়ে দাসত্ব বেশী। আপনার মনে হতে পারে, তৃণমূল বা বিজেপির এটাই সংস্কৃতি। আসলে যাদের এই ক্রীতদাসত্বে অনীহা নেই, তারা ঘাস বা পদ্মফুলের যোগ্য কর্মী। এরা দাসত্ব স্বীকার করে, আবার প্রভূত্বেও অনীহা নেই। কেউ চাইলে বদলে যেতে পারে না, কারণ Swimmer’s body illusion।

বামপন্হীরা এই দোষমুক্ত? অনেক দাসত্ব-বিলাসী ছদ্মবেশে বামপন্হী সেজে থাকে। হুক্কা হুয়া শুনলেই প্রতিবর্ত প্রক্রিয়ায় চেয়ার পরিষ্কারে তৎপর হয়। কেউ যদি বলে, অমূক হতে না পারলে বৃথা বা তমূক হতেই হবে, তাহলে জানবেন, তার চেয়ে আপনার বড় শত্রু কেউ নেই। Swimmer’s body illusionর ফাঁদে পড়বেন না। আপনি যা, তাই আছেন। ইচ্ছা করলে প্রতি বাক্যে দলনেত্রী বা বানিয়ার স্তুতি করতে পারবেন না, কারণ আপনার পারিবারিক শিক্ষা, জিন আপনাকে সেই অভিযোজনের পাসপোর্ট দেয়নি।

০০৩- Clustering illusion

আপনি চলমান মেঘের দিকে তাকিয়ে হাতি-ঘোড়া দেখতে পান? বাথরুমের দেওয়ালে পলেস্তরা খসে ভারতের মানচিত্র তৈরী হয় না? সদ্যোজাতের মুখের দিকে তাকিয়ে দশ বছর আগে স্বর্গপ্রাপ্ত দাদুর মুখের আদল আবিস্কার করে ফেলেন। অসামঞ্জস্য কোন জিনিসের ভিতর সামঞ্জস্য খুঁজে ফেরা মানুষের আদ্দিকালের অভ্যাস। এমনকি মিশেল দ্য নোস্ত্রদামের কিম্ভূত ছড়া থেকে মার্কিণ টুইন-টাওয়ারের ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধার করে ফেলে। অসামঞ্জস্য বিষয়কে সামঞ্জস্য করাটাই Clustering illusion।

দ্য-ভিঞ্চি কোড নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। মিশরের ডঃ খলিফা কোরানকে rule of 19 দিয়ে ব্যাখ্যা করে ফেললেন। এমনকি কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম ও ১০৮টি পদ্মে কেন দুর্গাপূজা হয় তার গাণিতিক বর্ণনাও আছে। আসলে আজানা অনির্দিষ্ট বাস্তবকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবার Clustering illusion সহজ পদ্ধতি। ই ইকুয়ালটু এম সি স্কোয়ারের চেয়ে ধর্মীয় মাখন মাখানো অনেক সহজ পাচ্য। কংগ্রেস ছিল, ফেরেনি। বাম ছিল। তৃণমূল এসেছে। কংগ্রেস ফেরেনি তাই বাম ফিরবে না। এবার রামের যাত্রা।

মিডিয়া ঠিক এই ভাবে এগারো বছর ধরে খাওয়াচ্ছে। অথচ কেরলে এই সমীকরণ কাজ করছে না। এই Clustering illusion ব্যবহার করা হচ্ছে তৃণমূল সরকারকে নিরাপদ করার জন্য। যদি মর্মান্তিক কোন খুন বা ধর্ষণ অথবা জন-অহিতকর কোন কাজ হয়, কৌশিক সেন, অপর্ণা সেন, সমীর আইচ মাথা নাড়িয়ে বলবেন, এই ঘটনা বাম আমলেও হয়েছে। অর্থাৎ দু-একটি বিচ্ছিন্ন দুঃখজনক ঘটনাকে সামনে রেখে Clustering illusion সৃষ্টি করে জনতাকে আচ্ছন্ন করে বর্তমান সরকারের পাশে থাকেন।

অসামাজিক কাজ বাম আমলে কেন, কংগ্রেসের যুগেও ছিল। গুপ্ত, পাল, সেন, নবাবী, ইংরেজ রাজত্বে উদাহরণ পাওয়া যাবে। আমরা সভ্যতার সাথে দুর্ঘটনার তীব্রতা বিচার করব না? তাহলে মধ্যমগ্রাম, হাঁসখালির ঘটনায় বলা যায়, হ্যাঁ, নারীদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তবে সতীদাহের সময়ে বেশী হত। এই সামঞ্জস্য পেয়ে গেলে প্রকৃত অসামঞ্জস্যকে গলঃধকরণ সহজ হচ্ছে। মিডিয়া ও সরকার বিভিন্ন উপায়ে সাধারণ মানুষের মনঃস্তত্বের উপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আঘাত করে মানতে বাধ্য করছে।