১০ ই মার্চের তৃণমূল কংগ্রেসের ” জনগর্জন ব্রিগেড” দেখার পর ভোটের অঙ্কের বাইরে বেরোতে বাধ‍্য হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের অনেকেই। কারণ তার মাত্র মাস দুয়েক আগেই এ বছরের ৭ ই জানুয়ারি আরও একটা ব্রিগেড দেখেছেন বাংলার মানুষ। সরকার ও শাসক দলের সর্বাত্মক বিরোধিতা এবং অসহযোগিতা অতিক্রম করে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য কমিটির উদ‍্যোগে ইনসাফ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেদিন। কোন ভয় ভীতি প্রলোভন ছাড়াই সেই সমাবেশের জমায়েতের সঙ্গে কোন তুলনায় যেতে চাননি বাংলার কোন মিডিয়ার সাংবাদিক। কিন্তু নিজেদের মধ‍্যে তাঁরা স্বীকার করতে বাধ‍্য হয়েছেন জমায়েত এবং জনগণের মধ‍্যে সাড়া জাগানোর নিরিখে বামপন্থী যুব সংগঠন রাজ‍্যের শাসক দলের ঘোষিত দুই সর্বভারতীয় নেতা নেত্রীর ডাকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আয়োজিত জন গর্জন সভার জমায়েত বেশ পিছিয়ে। অথচ একুশে জুলাই য়ের মত মঞ্চে চোখ ধাঁধানো চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের তারকা সমাবেশ না থাকলেও স্বয়ং মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী ও তাঁর ভাইপো ডায়মণ্ডহারবারের অভিষেক ব‍্যানার্জীর উদ‍্যোগে চমকের অভাব ছিল না।লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার জন‍্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব বেছে নিয়েছিলেন ব্রিগেডের মঞ্চ যার সঙ্গে নির্মিত হয়েছিল ফ‍্যাশন শো র আদলে একটি র‍্যাম্প! ব্রিগেডের রাজনৈতিক সমাবেশের মঞ্চের লাগোয়া র‍্যাম্প এবং ব্রিগেডের মঞ্চে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী ঘোষণা দুটোই বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে অভূতপূর্ব।

নিজের দলের প্রার্থীদের সঙ্গে র‍্যাম্পে হাঁটছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বাধিনায়িকা – এমন দৃশ্য বোধহয় তাঁর দলের অন্ধ সমর্থকরা স্বপ্নেও কখনও ভাবেন নি। কিন্তু ১০ ই মার্চ বাংলার মানুষ তেমনই দৃশ্য দেখলেন। দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যকলাপের বাইরে থাকা বিনোদন জগতের তারকাদের ঢালাও ভোটের টিকিট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে জনসাধারণের জীবন জীবিকার লড়াই ও সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বাইরে টেনে নিয়ে এসেছিলেন মমতা ব‍্যানার্জী। গত তেরো বছরে জনগণকে কেবলমাত্র সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তায় পরিণত করার কৃতিত্বও তাঁর। তৃণমূল কংগ্রেস এখন ভোট চায় ভাতার লোভ দেখিয়ে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের দশ বছরের কার্যকালে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে ব‍্যর্থ হয়েছে,তিনবারের মুখ‍্যমন্ত্রীত্বে পশ্চিমবঙ্গ কে আরও এক ধাপ এগিয়ে মমতা ব‍্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতির আখড়া তথা যোগ‍্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে টাকার বিনিময়ে চাকরি কেনা দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করেছে। বস্তুত আদালতের নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়েই ধরা পড়ে রেশন কেলেঙ্কারি। যে কেলেঙ্কারির তদন্তে সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা তথা উত্তর চব্বিশ পরগণার জেলাপরিষদের সদস্য শেখ শাহজাহান ই ডি কে বাধা না দিলে সন্দেশখালির জমি দখল নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসত কিনা সন্দেহ। এই যাবতীয় কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও জনগর্জন ব্রিগেড থেকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বিয়াল্লিশটি আসনে তাঁদের দলকে জয়ী করার ডাক দিয়েছেন মমতা ব‍্যানার্জী ও অভিষেক ব‍্যানার্জী। বিজেপি কে বাংলা বিরোধী বহিরাগত দলের তকমা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে বিজেপি কে পরাজিত করার ডাক দিয়েছেন তাঁরা। প্রধান প্রধান বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় রঙিন বিজ্ঞাপন পশ্চিমবঙ্গের কোন আঞ্চলিক দল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই রাজ‍্যের মানুষ আবার বুঝলেন ঠিকই। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনে কিউ আর কোড স্ক‍্যান করে বঞ্চনার তালিকা পড়ার ধৈর্য কতজন তৃণমূল সমর্থক পাঠক দেখাবেন এবং ক জন টিভি চ‍্যানেলে সভা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করেছেন যে, অভিষেক ব‍্যানার্জী থেকে শেখ শাহজাহানের কারাবাস ঠেকাতে এতবার যে সরকার আদালতে দৌড়াতে পারে তারা কেন্দ্রীয় সরকার পাওনা টাকা আটকে রাখার জন‍্য আইনি লড়াইয়ে নামছে না কেন -তার তুলনামূলক বিচার একপাশে সরিয়ে রাখলেও বুঝতে অসুবিধা হয়না যে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এখন মরীয়া। মরীয়া নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে এবং পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপির সামনে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সম্ভাবনা দূর করার জন‍্য। কলকাতার রাজভবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জীর শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল গত ২রা মার্চ।

মুখ‍্যমন্ত্রী কথিত নিয়মরক্ষার সেই বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী কোন সাংবাদিক সম্মেলন না করলেও মুখ‍্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন এই সাক্ষাৎ নেহাতই সৌজন্যমূলক কোন রাজনীতির কথাবার্তা নাকি তাঁদের মধ‍্যে হয়নি। তাহলে বরং বিশ্বাস করা যাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐ সাক্ষাতের পরেই দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা এবং বরানগরের বিধায়ক তাপস রায়ের দল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া এবং অমিত শাহ কর্মীসভায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন সংখ‍্যার লক্ষ্য পঁচিশে নামিয়ে দেওয়া নেহাতই কাকতালীয়! যেমন কাকতালীয়ভাবে নরেন্দ্র মোদি নির্যাতিতাদের মুখোমুখি হতে কখনও মণিপুরে যান নি,সন্দেশখালি যান নি মমতা ব‍্যানার্জীও। এই বোঝাপড়ার কারণেই কি তাঁদের প্রবল আত্মবিশ্বাস এখনো অক্ষুন্ন রয়েছে যে, চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি, নারদার স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে নেতা নেত্রীদের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরেও যখন ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় এবং সেই সব কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলে দেওয়া বামপন্থীদের সমর্থন কমে যাওয়া নিশ্চিত করা গেছে তখন যতই নিয়োগ দুর্নীতি,রেশন কেলেঙ্কারি,নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসুক মমতা ব‍্যানার্জীর নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা বিন্দুমাত্র কমবে না,ভোট বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটবে! বিশেষত গত বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা একটি আসনেও না জিততে পারার পাশাপাশি বিজেপির সাতাত্তর টি আসনে আটকে যাওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের সমর্থনভূমির দৃঢ় ভিত্তি সম্পর্কে প্রায় নিঃসন্দেহ হতে পেরেছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ২২শে জুলাই রাজ‍্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জী গ্রেফতার হওয়ার পরে ছবিটা বদলাতে থাকে।

দুর্নীতি আড়াল করে তৃণমূল নেতা নেত্রীরা যত বেশি মিডিয়াতে গলা ছেড়ে তর্ক করেন ততই বেআইনি নিয়োগ, নারী নির্যাতনের মত অপরাধ সামনে চলে আসছে। জনগর্জন সভা কখনও ভুলিয়ে দিতে পারবে না ঝালদা পুরনির্বাচনে বিজয়ী কংগ্রেস প্রার্থী তপন কান্দুকে গুলি করে খুন করা হয়, পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী ভোটে হার নিশ্চিত বুঝে গণনা চলাকালীন এক তৃণমূল প্রার্থী ব‍্যালট পেপার গিলে ফেলেন, সাগরদীঘির বিধানসভা উপ নির্বাচনে বাম কংগ্রেস জোটের জয়ী প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসকে দল বদল করিয়ে ফেলা হয়। গণতন্ত্র ও মূল‍্যবোধের রাজনীতির মৃত্যু ঘন্টা অনেক আগেই বাজিয়ে দিয়েছেন মমতা অভিষেক। জনগর্জনের ব্রিগেড তাকে মুছে দিতে পারেনি।