মুখে দুর্নীতির ব‍্যাপারে জিরো টলারেন্সের বার্তা দিয়ে সিপিআই এম এর মার্কসীয় সাহিত্য বিক্রয়কেন্দ্রে “আমরা বই বিক্রি করি, চাকরি বিক্রি করিনা এবং  “চোর ধরো জেল ভরো” শ্লোগান লেখা পোস্টার দেখেই গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনা যখন একদিনের ব‍্যবধানে হাওড়ার চ‍্যাটার্জীহাট এবং দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী মোড়ে ঘটে যায় অথচ একই সঙ্গে রুবি পার্কে পুলিশের  অনুমতি ছাড়া হিন্দু মহাসভার  দুর্গাপূজার আয়োজনে বিনাবাধায় গান্ধীজিকে অসুর সাজানো হয়। তখন সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক সমর্থক সরকার যে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন পরিচালনা করছে এ নিয়ে বিশেষ সন্দেহ থাকে না। সিবিআই ও ইডি কে দিয়ে দুর্নীতির তদন্ত করে তৃণমূল কংগ্রেসকে বিব্রত করতে চাইছেন আসলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ,প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ব‍্যাপারে কিছুই জানেন না, মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর এমন দৃঢ় বিশ্বাসের কথা সংবাদ মাধ‍্যমেও প্রচার করেছেন।


কিন্তু  শারদোৎসবে এমন বীভৎস রাজনীতি আমরা অন্তত এর আগে দেখিনি। মহালয়ার আগে থেকে পুজো উদ্বোধন করতে গিয়ে বামপন্থীদের বিশেষত সিপিআইএম নেতাদের ব‍্যক্তিগত আক্রমণ করছেন স্বয়ং মুখ‍্যমন্ত্রী এমন দৃশ্য দেখতে হবে বোধহয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও ভাবেন নি। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে পরেই একদল বঞ্চিত শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের মামলায় তাঁর প্রতারণা ও মিথ‍্যাচারের রাজনীতি ধরা পড়ে যাওয়ার পরেই মুখ‍্যমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদবর্গ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। মুখ‍্যমন্ত্রীর  শরীরী ভাষায় আত্মবিশ্বাসের অভাব ফুটে উঠলেও মুখের ভাষা ও বক্তৃতার ভঙ্গিতে ফুটে বেরোচ্ছে,” দুর্নীতি মানে ভুল আর ভুল করার অধিকার আমাদের রয়েছে”। আর স্পষ্ট ভাষায় বলছেন “তুমি দুর্নীতি করলে সাধুপুরুষ আর আমরা করলে সিবিআই!” অর্থাৎ ঘুরিয়ে স্বীকার করেই নিচ্ছেন তিনি ও তাঁর দল দুর্নীতিতে যুক্ত। ফলে আত্মরক্ষার জন‍্য বিরোধীদের আক্রমণ করে বক্তব্য রাখার রাস্তাই নিয়েছেন মমতা ব‍্য‍ানার্জি। এবং বেছে নিয়েছেন তাঁর অনুগত বিভিন্ন পূজাকমিটির মণ্ডপ। নিঃসন্দেহে সেই মুখ‍্যমন্ত্রীর ভাষণ শোনার জন‍্য পুজোমণ্ডপে যাঁরা উপস্থিত থাকছেন,তাঁরা পুরাণ কথিত  মা দুর্গা র চেয়েও আর এস এসের দুর্গা র প্রতি বেশি অনুগত। যে কারণে কেউ হাত তুলে বলছেন না,” পুজো মণ্ডপটা আপনার দুর্নীতির সাফাই গাওয়ার রাজনৈতিক মঞ্চ নয়”। দুষ্টু লোকে বলে, এই  আনুগত্যের উৎস  পুলিশি হেনস্থার ভয় আর ষাট হাজার টাকা পাওয়ার লোভ মিলিয়ে মিশিয়ে।


ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি মুখে “ধর্ম যার যার উৎসব সবার ” বললেও পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদলের নেতা কর্মীরা বিশ্বাস করেন না এই রাজ‍্যে কোন ধর্মীয় উৎসব বা মহামানবের জন্মদিন মৃত‍্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান তাঁদের সর্বোচ্চ নেত্রীর অনুপ্রেরণা ছাড়া সম্ভব। মুখ‍্যমন্ত্রীর প্রিয় এক মন্ত্রীকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বলতে শুনেছি, “বাম সরকারের চৌত্রিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে  রবীন্দ্রনাথ নজরুল কে তো ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মমতা ব‍্যানার্জীর সরকার এসে আবার মনীষিদের জন্মদিন পালন  চালু করেছেন।”


এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদলের নিষ্ঠাবান কর্মী ও নেতারা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  নোবেল প্রাপ্তি থেকে সত‍্যজিৎ রায়ের অস্কার প্রাপ্তি হয়ে দুর্গাপূজার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কোনটাই মমতা ব‍্যানার্জির অনুপ্রেরণা ছাড়া সম্ভব হত না। ফলে নয় বছর আগে চিটফাণ্ডের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল নেতা মন্ত্রীদের একে একে নাম উঠে আসার পরে পথসভায় বক্তৃতায় যখন সেই প্রসঙ্গ স্থানীয় বামপন্থী নেতারা উল্লেখ করতেন তখন তাঁদের হুমকি দিত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা বেশী মস্তানেরা। সেই ট্র‍্যাডিশন এখনো চলছে এবং বড়ো আশ্চর্য মিল  তখনকার এবং এখনকার তদন্ত ও গ্রেফতারিতে। চিটফাণ্ডের টাকায় ছবি কেনার তথ‍্য সম্বলিত ফাইল সিবিআইএর হাত থেকে চলে গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সেখানে হিরণ্ময় নীরবতা বলেই এখনো যেকোনো পাড়ার  বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় বাতিল হতে পারার মত  আঁকা  ছবি বিক্রি করা শিল্পী সপার্ষৎ বহাল তবিয়তে থাকেন এবং যোগ‍্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে মোটা টাকায় চাকরি বিক্রি করার ষড়যন্ত্রের অন‍্যতম নায়ক বিধায়কের নামে লুক আউট নোটিশ জারি করার পরেও তাকে যাদবপুরের বাড়ি, নয়াদিল্লির বঙ্গভবন অবধি অবাধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। গরুপাচার কয়লা পাচারে অভিযুক্ত বিতর্কিত  এম বি এ ডিগ্রিধারী  স্মার্ট যুব তৃণমূল আইকন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দপ্তর থেকে বেরিয়ে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুকরণে হুংকার দিয়ে বলেন “আমি মাথা নীচু করে বাঁচব না। আমায় সিবিআই ইডি কিচ্ছু করতে পারবে না”,তখন কোন সর্বভারতীয় মিডিয়ার পক্ষ থেকেও জিজ্ঞাসা করা হয়না, সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ না পেলে আপনি কি জেরার মুখোমুখি হতেন? 


অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই দুই ফুলের  গড়াপেটা খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে প্রশ্ন করছেন গায়ের জোর নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে বামপন্থীদের আইনসভার বাইরে রাখা কি এই জন‍্যই যে সরকারে বা প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বামপন্থীরা ফিরে এলে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপদ বাড়বে?