“মুখের কথা একলা হয়ে/ …রইল পড়ে গলির কোণে/  ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/  ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।” রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মদিন পালনের বিজ্ঞাপন দেননি। পঃবঃ সরকার অতীতে তর্পণ করেছে রবি-ছবিতে। এখন ছবিতে ব্যতিক্রমী শিক্ষামন্ত্রীর আরেক নিরলস কবি- এপাং ওয়াং ঝপাং। “কে কাকে ঠিক কেমন দেখে/ …বুঝতে পারা শক্ত খুবই/  হা রে আমার বাড়িয়ে বলা/  হা রে আমার জন্মভূমি।” কে তুমি শঙ্খ কবি? তোমার নাম কেউ শোনে নাই। দেখতে পাওনা রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে? আজ কবি নেই, কথাগুলো কি কেউ ভোলে? সেই বীর তৃণমূল নেই, তিনি গেছেন তিহাড় জেলে। গুণ ভাগের যে অবশিষ্ট থাকে, ইতিহাস যেন সব পুষিয়ে দেয়। ১লা এপ্রিল নামী সংবাদপত্রের জোড়া পাতা জুড়ে তাঁর বিজ্ঞাপন। বোকা বানাতে দুয়ারে সরকার। এই বুঝি ব্যতিক্রমী সরকারী চাকরির মেনু কার্ড নিয়ে এল। গ্রুপ ডি পাঁচ, সি সাত, প্রাথমিক দশ, মাধ্যমিক পনেরো… বাড়ির ভাত খেয়ে গেলে ২০% ডিম্ভাত চার্জ। বাড়ির দলিল, চাষ জমি, বউয়ের বাউটি… উন্নয়নে সাঁতার কাটবে মা, মাটি খুঁজে পাবে না মানুষ।

বিজ্ঞাপন মানে, দুজন মানুষের সম্পর্ক স্হাপন করা। আপনি কেমন আছেন রামবাবু? হেঃ হেঃ ভাল আছি। আপনার কুশল তো শ্যামবাবু? শ্যামবাবু আর রামবাবুর এই সম্পর্কের আদান প্রদান উভয়মুখী। বিজ্ঞাপন একমুখী। মন কি বাত যিনি বলছেন, বলা তাঁর অধিকার। আপনার অধিকার শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞাপন দুই প্রকার- বিজ্ঞপ্তি ও প্রভাবিত করা বা স্বীকৃতি আদায়। দঃ বঃ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ ভাঙা চোঙে বিজ্ঞপ্তি দিল, দিঘা যাবার সাড়ে আটটার বাস অনিবার্য কারণে বাতিল হল, পরবর্তী বাস সাড়ে নটায়। আপনার একটা কাজ, যদি ভেবে থাকেন কোলাঘাটে ব্রেকফাস্ট করবেন, সেটা ধর্মতলার লুচি-ডালে সারতে হবে। বিজ্ঞাপন প্রভাবিত করে। ফিল্ম ফেস্টিভালে অদ্রে হেপবার্নের পাশে দাঁত বার করে আরেক সফল অভিনেত্রী। আপনার ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গ্রেগোরি পিকের পাশ স্হান ছিনিয়ে নিয়েছেন। বাদশাহের মজলিশে আগমন। সবাধান শাহেনশাহ ইমবিরাতুর অল অবাতিরা বাদশাহ্ পধার রহাঁ হ্যাঁয়- আপনাকে একতরফা ঝুঁকে যেতে হবে, নচেৎ গর্দান গড়িয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপনদাতার প্রোডাক্টের যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী থাকে তা কেবল বাগাড়ম্বর। কোকাকোলা-পেপসি অথবা কলগেট-পেপসোডেন্ট কিংবা হরলিক্স-কমপ্ল্যানের ডার্বি ম্যাচ দেখেছেন? বিজ্ঞাপনদাতার মূল উদ্দেশ্য প্রোডাক্টের পরিচিতি, প্রভাব বিস্তার ও বাজার দখল করে মুনাফা বৃদ্ধি করা। সে দাঁতনের বাজার হোক বা ভোটের। উদ্দেশ্য খরচ উশুল করে লাভ আদায় করা। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন সেলিব্রিটি মডেল বা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার ভাড়া করে। কোন দলের নেতা-নেত্রীরাই রামদেবের মত নিজেরাই মডেল। তারপর বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যায়। উন্নয়ন যদি রাস্তায় চাক্ষুষ দেখা যেত, তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হত না। বিজ্ঞাপনের আরেক হাতিহার শ্লোগান। “এবার নয় নেভার”, “উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে” ফ্লপ করার পর “পরিবর্তন চাই” কাজে লেগে গেছে। সেখান থেকে “বাংলা নিজের মেয়েকে চায়।” এগুলো “চুমুকে চমক”, “মেড ফর ইচ আদার”, “ডানলপ ইজ ডানলপ, অলওয়েজ অ্যাহেডের” মত বানানো শ্লোগান। কখনও লোককথার মত শোকগাঁথা শ্লোগান মাটি থেকে উঠে আসে।

বিদ্যাসাগর, বিশ্বকবি, দেশবন্ধু, বিদ্রোহী কবি উপাধিগুলো মজলিশে পাঁচ মাথা এক হয়ে শিরোপা দেননি। কোন অস্ফূট উচ্চারিত শব্দ কান থেকে কানে প্রতিধ্বনীত হয়ে মন থেকে মনে গেঁথে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী যতই পাটকেলের ভয় দেখান বা সাইকেলের ছবি দিন, সরকারের শিক্ষা দপ্তর শিকড় উপড়ে জেলে নিয়ে গেছে। বিপুল কলেবরের জেলা সভাপতি সপার্ষদ তিহাড়ে। দেশ ইতিমধ্যে মধ্য প্রদেশের শিবরাজ চৌহান সরকারের ব্যাপম কেলেঙ্কারি দেখেছে। “ব্যবসায়িক পরীক্ষা মন্ডল” বা ব্যাপমকে ব্যবসা করে ফেলেছিল ভক্ত সরকার। মমতা তখন কেন্দ্রে এউ.পি.এ-টুর রেলমন্ত্রী। ব্যাপমের আদ্যান্ত তাঁর জানা। প্রধানমন্ত্রী নীরব ছিলেন। ২০১৩ তে কংগ্রেসের দিগ্বিজয়ী সিংএর সি.বি.আই তদন্তের দাবী নাকচ হয় এবং নরেন্দ্র মোদী মসনদে বসার পর মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টও কেন্দ্রীয় তদন্তের পথ বন্ধ করে দেয়। অপরাধের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে নির্মূল না হয়, তাহলে সমাজে ক্যান্সারের মত ফিরে আসে। নন্দলালরা অপরাধ জগতের হালহকিকৎ দ্রুত শেখে। তাঁরা জানেন, প্রধানমন্ত্রীর হাত পা বাঁধা ব্যাপমে।

তেমন ভাবেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল লক্ষ যুবক-যুবতীর স্বপ্ন। চিটফান্ডের তদন্ত হয়নি, নারদের মামলায় লোকসভার লোলচর্ম বৃদ্ধ লালকৃষ্ণের এথিক্স নড়েনি, নোটবন্দীর কালাধন সাফাই অজানা রয়ে গেছে, আদানির বিচার হবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপর নন্দলালদের অগাধ ভরসা। অকষ্মাৎ বাদ সাধলেন কলকাতা হাইকোর্টের কতিপয় দৃঢ়চেতা উন্নতশির মাননীয় বিচারপতিরা। বিনা মেঘে বজ্রপাত হল সাজানো বাগানে। নারী-সুরা-আলিবাবার গুহা সমেত মাতব্বররা বেফাঁস ধরা পড়ে গেলেন। ওরা যে চোর, নারদে মানুষ দেখেছে, মোদী বাঁচিয়েছেন। এবার মাননীয় বিচারপতি সি.বি.আই, ইডি তদন্তে সটান জেলে পাঠালেন। তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই দুর্নীতির গভীরতা আবিষ্কার হচ্ছে। কেবল চাকরির নিয়োগে নয়, বালি-কয়লা-পাথর-গরু পাচারের চাম্পিয়ান। ভিলেন মোদী ঠিক যে কারণে ২০২২এর নির্বাচনে ধরাশায়ী, ঠিক সেই কারণে আদালত ও বামপন্হী উকিল থেকে কর্মীরা ভগবান হয়ে উঠলেন। ফিসফিস কথা, কলরব হল। নেত্রী সরকারী কর্মীদের চোর ডাকাত বলতে, তুফান উঠল একটা শব্দে-  

একটা মাত্র শব্দ শ্লোগান হয়ে গেল। পরিচিতি হয়ে গেল। নেত্রীর ইতিহাসের মুখবন্ধ হয়ে গেল। দুর্নীতি গ্রস্ত সরকারের পরিচয় হয়ে গেল – “চোর”। অসহায় নিরস্ত্র মানুষের আর্তনাদের মাটির শব্দ- “চোর”। বেসামাল হয়ে গেল নেত্রীর কোটি কোটি টাকার ছবির বিজ্ঞাপন। এই ভাবেই ইতিহাস লেখা হয়। যুদ্ধ বাকি আছে। যুদ্ধের দুটি পক্ষ। মানুষ এবং চোর। মানুষ বলছিল, তৃণমূল মানেই চোর। তৃণমূলের জবাব ছিল, সবাইকে চোর বললে জিভ ছিঁড়ে নেব। স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে, কারা চোর নয়, শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক সরকার। জীবনানন্দ বলেছিলেন, সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কারা কবি নন? আমি নই। আমার বন্ধু রাখাল নয়, এমনকি রাখালের মামাও নয়, ওনার নাম কবি হলেও নয়। তৃণমূল ঠারেঠোরে বলল, নেত্রী কিছু জানেন না, তিনি চোর নন। তিনি সততার প্রতীক পদবী ত্যাগ করছেন, তারপরেও স্ফটিকের মত স্বচ্ছ্ব? সাগরদিঘি নির্বাচনে ফল বলে দিল, জনতা ইতিবাচক ভাবছে না। চাপে পড়ে তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। অকথা কুকথায় ভয়ার্ত নিষ্পেষিত জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেললেন।

আপোষকামী, সেটিংবাজ নরেন্দ্র মোদী ২০২২এ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বঙ্গবিজয় করতে পারেননি। ২০২৪এ রাহুল গান্ধীকে রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ বুঝছেন। ওরা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিতে ভরসা করতে বাধ্য হবেন। বাম ও কংগ্রেসের জোট একমাত্র বিকল্প পথ। নেত্রী বেপরোয়া আক্রমণ করবেন বামপন্হীদের। গত বছর ২১শে জুলাই সব ফাইল বার করার কথা বলে ২৯শে অগাষ্ট আলমারি হারাবার মর্মান্তিক সন্দেশ দিলেন। চিরকুটের গল্পে কি বিজ্ঞাপনের চোরকে আড়াল করা যাবে! অটোওয়ালা সিগনালে বিরক্ত হয়ে হোর্ডিংএর ছবিকে বলছে চোর। মহার্ঘ ভাতা চুরি যাওয়া সরকারী কর্মচারী খবরের কাগজ খুলেই ছবি দেখে বলছে, চোর। ঘরণী দুপুরে প্রশাসনিক বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার দেখে রিমোট ঘুরিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন, চোর। গাঁয়ের লোককে প্রশ্ন করুন, বাংলা আবাসের বাড়ি পাননি? তিনি বলছেন, চোর। তিনি বলেছিলেন, সব কেন্দ্রের প্রার্থী একা তিনি। এখন দলে কাউকে আলাদা করে চিনতে পারছে না কেউ, একটা মাত্র চোর।

সমস্যা কোথায়, তদন্তকারী সংস্হাগুলোতে নাকি পুতুল নাচের কারিগরের আঙুলে জনগন ঠাহর করতে পারছে না। ২০২২এর ২৩শে জুলাই প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জীকে গ্রেপ্তার করে উদ্বোধন। তারপর পার্থর ডান, বাম হাতের পর দালাল পাড়ায় ঘোরাঘুরি করছে তদন্ত। বাড়ি, গাড়ি, রিসর্টের নিশি যাপনের ছবি। আকর্ষণ ধরে রাখতে টলি নায়িকাদের অতিথি শিল্পী করে আনছে। মদনদার টিপ্পনী অনেকটা কাসুন্দির মত। আদালত বারবার ভর্ৎসনা করছে। তবু তদন্তের গিয়ার বদল হচ্ছে না। পাশের চ্যানেলে গরু পাচার, তার পাশে কয়লার ময়লা। চাকুরি প্রার্থীদের রাস্তায় ধর্না ৭৪৩দিনে পড়ল। পার্থ মূল মাথা হতে পারে না। তৃণমূলে অনুপ্রেরণা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। ২০১৯এ স্বরাষ্ট্র দপ্তর নীলাদ্রি দাসকে জামিন দিয়েছিল কার আদেশে? মানুষ পর্দাটা খুলতে চাইছে। কারণ, মানুষের খাতায় উত্তর লেখা হয়ে গেছে। সে কেবল যথার্থতা যাচাই করতে চায়। বিরক্তিকর অপেক্ষার পর মানুষ তার রায় জানিয়ে বলছে, চোর। হ্যাশট্যাগ ঘুরছে #ChorTmc। TMC কোন দল নয়, কোন্দল নয়, শুধু একজন।

লোকমুখে নিখরচায় তাঁর নাম। বিজ্ঞাপন দিতে দিতে আর বিজ্ঞাপন দিতে হয় না। ওনাকে আর বলতে হবে না, তিনিই একা প্রার্থী। সেখানেই তো সমস্যা। কেষ্টাকে ছাড়লেও কেষ্টা ছাড়বে না, পার্থ বলবেই, তিনিই নেত্রী। কুন্তল আদালত চত্ত্বরে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলবে, অভিষেক আমার নেতা। সায়নী মাইক হাতে বলেন, ভারতে একমাত্র মহিলা বিরোধী নেত্রী। পার্থ-কেষ্ট-কুন্তলদের জেল যাপন মানুষের বিনোদন হয়ে গেছে। শ্বাশুড়ি বউয়ের খুনসুটি সিরিয়াল ফেলে মানুষ নিউজ পোর্টালে ক্রাইম থ্রিলার দেখছে। এই মানুষ কিন্তু শেষ দৃশ্যে ভিলেনের পতন দেখতে অভ্যস্ত। গোবেচারা ভীরুও পকেটমার ধরা পড়লে বেমক্কা থাপ্পর মেরে চলে যায়। এই পাবলিক কিন্তু গোপনে বোতাম টিপে দেবে। সুশীলরা বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে ফেলেছে। শেষ পাতে লাল দইয়ের মাথা গিলে মিষ্টি পানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলবে, রাত হল, যাই। মাতাল বেঁহুশ ক্লাবঘরে। জেলের ভিতর অপার সাপ লুডো খেলা বিধাতার সাথে। ঝিঁঝিঁ ডাকে। নিশুতি রাতে একা জাগে বিজ্ঞাপনের ফটোশপে সেই হাসি। ক্যানিং লোকাল আসে, ভোর হয়।