দণ্ড কমণ্ডলু হাতে এক নবীন পরিব্রাজক চলেছেন ভারত পরিক্রমায়। ভারত-আত্মার যথার্থ স্বরূপ সন্ধানই সেই দৃপ্ত-চরিত্র সন্ন্যাসীর অভীষ্ট। কিন্তু এ কোন ভারতবর্ষকে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন? কোথায় গেল ভারতের সেই শৌর্যবীর্যের অতীত গৌরব-ইতিহাস? কোন অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো সনাতন ভারতের এক উজ্জ্বল মানবপ্রেমের আদর্শ? ভারতের সর্বত্রই আজ সীমাহীন দারিদ্র্য, পরাধীনতার গাঢ় অন্ধকার, পরানুকরণ-মত্ততা, দাসসুলভ দুর্বলতা, অস্পৃশ্যতার রাহুগ্রাস। সন্ন্যাসীর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। কে এই মহাসন্ন্যাসী, যিনি দরিদ্র মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করলেন? কে এই তাপস-শ্রেষ্ঠ, যিনি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করলেন উদার মানবিকতায়? উজ্জীবিত করলেন নবজীবনের অগ্নিমন্ত্রে? কে সেই মহাসাধক, যিনি বজ্রকণ্ঠে ভারতবাসীকে শোনালেন, ”ভুলিও না, নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই?” কার উদাত্ত বজ্র-ঘোষণা জাতির নিস্তরঙ্গ জীবনে আনল দুর্বার যৌবনতরঙ্গ? তিনি হলেন অমিত শক্তিধর, নবজাগরণ-মন্ত্র উদ্‌গাতা, বীরেশ্বর বিবেকানন্দ।

১৮৬৩ সাল। উত্তর কলকাতার সিমলাপাড়ার বিখ্যাত দত্ত পরিবার। সেখানে জন্ম নিলেন নবজাগৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ ভারত-পথিক স্বামী বিবেকানন্দ। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত। হাইকোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ, বিখ্যাত এটর্ণি। মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। মাতৃদত্ত নাম বীরেশ্বর। ডাক নাম ‘বিলে’।
শৈশবেই বীরেশ্বর ছিলেন দুরন্ত, সাহসী। সব বিষয়েই ছিল তাঁর জানার অদম্য কৌতূহল, একাগ্রতা। তাছাড়া তাঁর সব কিছুই যাচাই করে নেওয়ার ছিল এক আশ্চর্য মানসিকতা। তিনি ও শৈশব ও শিক্ষা- ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ছিলেন প্রখর বুদ্ধির অধিকারী। আর ছিল
তাঁর অদ্ভুত এক ধ্যানের খেলা। তিনি বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপোলিটন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখানে তাঁর নাম নরেন্দ্রনাথ। প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করলেন। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সী কলেজে। পরে তা ছেড়ে দিলেন। এলেন জেনারেল এসেমব্লি কলেজে। বর্তমানে তা স্কটিশ চার্চ কলেজ। এখান থেকে এফ- এ পাস করলেন। দর্শনশাস্ত্র নিয়ে সেখানে ভর্তি হলেন। তিনি ছিলেন মধুর কন্ঠের অধিকারী। সঙ্গীত খেলাধুলো বক্তৃতায় ছিল তাঁর সুগভীর আগ্রহ। শরীর চর্চার প্রতি ছিল তাঁর অনুশীলন-নিষ্ঠা।
প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি। একদিন রামকৃষ্ণ এলেন সেখানে। ধর্মমূলক গান গাইবার জন্যে ডাক পড়ল নরেন্দ্রনাথের। প্রথম দর্শনেই রামকৃষ্ণ বিস্ময় বিমুগ্ধ হলেন। অভিভূত হলেন নরেন্দ্রনাথও। তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন রামকৃষ্ণ।

নরেন্দ্রনাথের মনেও তখন ঈশ্বর জিজ্ঞাসার নানা প্রশ্ন বেধে উঠেছে। কোথাও তৃপ্তি পাচ্ছেন না। লাভ আকুল হয়ে তিনি খুঁজছেন যথার্থ সত্যের স্বরূপ। তারপরই রামকৃষ্ণের দিব্য-সান্নিধ্য লাভ। দক্ষিণেশ্বরের আকর্ষণ তার কাছে তীব্র হয়ে উঠল। সেই সময়ই পারিবারিক বিপর্যয়। পিতার আকস্মিক মৃত্যু ঘটল। চরম অর্থ-সংকট। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে মাতৃমূর্তির কাছে অর্থ চাইতে গিয়েও তিনি প্রার্থনা করলেন শ্রদ্ধা ও ভক্তি।

১৮৮৬ সাল। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহাপ্রয়াণ ঘটল। নরেন্দ্রনাথ ও তার সহকর্মীরা সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। নাম হলো ‘বিবেকানন্দ’। ভারত-পথিক বিবেকানন্দ বেরোলেন ভারত-পর্যটনে। পরিক্রমা করলেন হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা। মিশলেন হিন্দু-মুসলমান চণ্ডাল দরিদ্র অজ্ঞ সাধারণ মানুষের সঙ্গে। অনুভব করলেন নির্যাতিত মানুষের হৃদয়-যন্ত্রণা। ব্যথিত হলেন শত শত যুগের
সামাজিক-ধর্মীয়-রাষ্ট্রীক অত্যাচারে বিনষ্ট-মনুষ্যত্ব ভারতীয়দের জন্য। তার অগ্নিগর্ভ বাণীতে স্পন্দিত হলো আকুমারিকা হিমাচল। জেগে উঠল সুপ্তিময় ভারত। ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা, অনাগত দিনের পথ-প্রদর্শক, ভারত-পথিক বিবেকানন্দ শোনালেন নবজীবনের জাগরণ-মন্ত্র। তিনি বললেন, ‘নতুন ভারত বেরুক লাঙ্গল ধরে, কুটির ভেদ করে জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনোনের পাশ থেকে।”

তারপর এলো ইতিহাসের সেই স্মরণীয় দিন। ১৮৯৩ সাল। আমেরিকার শিকাগো শহর। সেখানে বিশ্ব-মহাধর্ম সম্মেলন। বিবেকানন্দের কাছেও এলো সেই সংবাদ। সেখানে তিনি অনাহূত। কিছু ভক্তের অনুরোধে তিনি আমেরিকার পথে পাড়ি দিলেন।
উদ্দেশ্য বেদান্ত ধর্মপ্রচার। সন্ন্যাসীর বেশ। পরনে গৈরিক পরিধান, গৈরিক শিরস্ত্রাণ। এলেন শিকাগো শহরে, কিন্তু প্রবেশের
ছাড়পত্র নেই তাঁর কাছে। শেষ পর্যন্ত মহৎ-হৃদয় কিছু আমেরিকাবাসীর সহায়তায় তিনি পাচ মিনিটের জন্যে বক্তৃতা দেবার অনুমতি নিয়ে ধর্মসভায় প্রবেশ করলেন। মুহূর্তের জন্যে তিনি স্মরণ করলেন গুরুদেবকে। তারপর শ্রোতৃবর্গকে আত্মীয়তার উষ্ণ আবেগে সম্বোধন করলেন, ‘আমেরিকাবাসী ভাই ও বোনেরা।’ মুহূর্তে উচ্ছ্বসিত করতালি ধ্বনিতে অভিনন্দিত হলেন প্রাচ্যের এই সন্ন্যাসী। তিনি ভাষণে বললেন, ‘খৃষ্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না, হিন্দু ও বৌদ্ধেরও খৃষ্টান হবার প্রয়োজন নেই। আধ্যাত্মিকতা, পবিত্রতা এবং দাক্ষিণ্য কেবল বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের একচেটিয়া বস্তু নয়। প্রত্যেক ধর্মের পতাকায় লিখিত হবে, যুদ্ধ নয় সাহায্য, ধ্বংস নয় আত্মস্থ করে নেওয়া, ভেদ দ্বন্দ্ব নয়, সামঞ্জস্য ও শান্তি।’
ধর্মসভায় তিনি বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে ঘোষণা করলেন ভাবীকালের মহামিলন বার্তা। অভিভূত হলেন সমবেত শ্রোতামণ্ডলী। দিকে দিকে প্রশংসার বান ডাকল। শিষ্যারূপে পেলেন মিস মার্গারেট নোবেলকে। তিনিই ভারতের মাটিতে হলেন ‘ভগিনী নিবেদিতা’। ১৮৯৬ সালে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন।

স্বদেশে ফিরেও বিবেকানন্দ ক্লান্তিহীন কর্মী। বিবিধ সাংগঠনিক কাজে তিনি ডুবে গেলেন পরমুখাপেক্ষী, পরানুকরণ-প্রিয়, ভীরু ভারতবাসীকে নবজীবনের আদর্শে অনুপ্রাণিত,
আত্মশক্তিতে বলীয়ান করার ব্রত নিয়ে গড়ে তুললেন একদল আদর্শ সন্ন্যাসী। তাঁর স্বামীজীর বাণী-বিগ্রহ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। ১৮৯৭ সাল। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মানবসেবার অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘রামকৃষ্ণ মিশন’। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠল তাঁর পরিকল্পিত ব্রহ্মচর্যাশ্রম। ১৮৯৯ সাল। তাঁর নিরলসপরিশ্রমে গঙ্গার পশ্চিম তীরে প্রতিষ্ঠিত হলো নবযুগের অন্যতম পুণ্য পীঠস্থান বেলুড় মঠ। ১৯০০ সালে প্যারিসে বিশ্বধর্ম সম্মেলন। সেখানে যোগদানের জন্যে তার কাছে এলো সাদর আমন্ত্রণ। আবার তিনি ইউরোপের পথে পাড়ি দিলেন। বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করলেন তার বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনায়। ফিরে এলেন স্বদেশে। অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভগ্ন হলো। ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই। এই মহাতাপস হলেন সমাধি মগ্ন। সেই সমাধি আর ভাঙল না। মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়েসেই এই মহাজীবনের ঘটল মহাপ্রয়াণ।

শুধু কর্মের জগতেই নয়, চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন নতুন যুগের বাণীবাহক। তাঁর ‘পরিব্রাজক’, ‘ভাববার কথা’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘বর্তমান ভারত’, নানা টুকরো প্রবন্ধে, আর ৮ সাহিতাকৃতি অজস্র চিঠিপত্রে সেই বাণীই মুদ্রিত হয়ে আছে। সেখানে রয়েছে তাঁর জ্বলন্ত দেশপ্রেমের আদর্শ। রয়েছে সমাজ-বিশ্লেষণের অভ্রান্ত বিজ্ঞান-বুদ্ধি। আছে বাংলা ভাষার বিজ্ঞান-ভিত্তিক আলোচনা। তিনি বাংলার চলিত গদ্যে সঞ্চার করেছেন দুরন্ত গতি। শব্দ প্রয়োগে তিনি ছিলেন দুঃসাহসী। যেমন ভাব তেমন ভাষা। তাঁর রচনা ছিল যুক্তিনিষ্ঠ।

বিবেকানন্দ ছিলেন আধুনিক ভারতের ভগীরথ। ছিলেন নবযুগের চালক। তমসাচ্ছন্ন, আদর্শভ্রষ্ট জাতিকে অভিশাপ মুক্ত করতেই তাঁর পুণ্য আবির্ভাব। দুর্বল, হীনপ্রাণ জাতিকে ১ উপসংহার মানবতার কল্যাণমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর জীবনসাধনা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শত শতাব্দী ধরে সামাজিক অত্যাচারে, দারিদ্র্যে, অস্পশ্যতায়, ভারতবর্ষ আজ হীনবল, ঐতিহ্যচ্যুত, আদর্শভ্রষ্ট। তিনি ধর্মান্ধ জাতিকে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, দরিদ্র নিপীড়িত আর্ত মানুষের সেবাই ঈশ্বর-সাধনা। অসহায় মানুষই আমাদের ঈশ্বর। বলেছিলেন, স্বদেশবাসীই আমাদের প্রথম উপাস্য। এক বলিষ্ঠ ভারত গঠনই ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর ব্রত। তিনি আদর্শহীন জাতিকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আজ থেকে পঞ্চাশ বছর কাল আর কোন দেবদেবী তোমাদের উপাস্য নয়, উপাস্য শুধু জননী জন্মভূমি-এই ভারতবর্ষ।’ যথার্থই স্বামীজী ছিলেন ভারত-আত্মার জ্যোতির্ময় বিগ্রহ। ছিলেন নবযুগের প্রাণপুরুষ।

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন, এমিন একজন মানুয় একদিন তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে সর্বধর্মসমন্বয়ের কথা বলেছিলেন। উচ্চারণ করেছিলেন শান্তির বাণী। মহামিলনের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁর বাণী বিস্মৃত হয়েছি। আদর্শ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছি। এখন দেখা যাচ্ছে, ধর্মের নামে কত উন্মত্ততা। এখনও কত রক্তস্রোত বয়ে যায়। অন্ধ তামসিকতা এখনও আমাদের আচ্ছন্ন করে। ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা আজও আমাদের বিভ্রান্ত করে। আজও আকাশে বাতাসে হিংসার প্রমত্ততা। দেশের বিভিন্ন স্থানে আজ বিবেকানন্দের জন্মদিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু এই পুণ্য মুহূর্তে আমরা যেন আবার নতুন করে স্বামীজির উদার, কল্যাণমুখী, সমন্বয়ের ধর্মনীতির কথা স্মরণ করি।

“মানবজাতির সেবা ও আত্মার মুক্তি-এই ছিল তার জীবনের আদর্শ। মানবজাতির সেবা বলতে বিবেকানন্দ স্বদেশেরও সেবা বুঝেছিলেন।”-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।