দেশটির সরকারি নাম ভারত প্রজাতন্ত্র। জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি। এই জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হল নারী।

ভারতীয় সংবিধানের ১৪ থেকে ৩৫ নং ধারাতে নাগরিকদের জন্য সাতটি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৩৬ -৫১ নং  ধারায় ভারত রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার নির্দেশাত্মক নীতি রয়েছে। এরপর ৪২ তম সংশোধনের মধ্য দিয়ে বেকারী, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধার কথা বলা হয়েছে। আমাদের আলোচনায় নারীর অধিকারের বিষয়টি থাকবে।

সংবিধানে সব ভারতীয় নারীকে সাম্য, রাষ্ট্রের দ্বারা কোন বৈষম্যের মুখোমুখি না হওয়া, সমান সুযোগ লাভ, সম কাজে সম বেতনের জন্য সুপারিশ করা আছে। নারীর প্রতি অবমাননামূলক আচরনের বিরোধিতা করে এবং কাজের জায়গা অনুকূল সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় সহ মাতৃত্বকালীন সুযোগ সম্পর্কিত আইন গ্রহণ করা হয়েছে। হেপাজতে থাকাকালীন ধর্ষণ নতুন অপরাধ নথিভুক্ত হয়।

শিশুকন্যা হত্যা, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর স্বাস্থ্য, নারী নিরাপত্তা ও নারী শিক্ষার মত বিষয়গুলি আইনের দ্বারা সুরক্ষিত করার দাবি সংগঠিত হয়। এই দাবীগুলো নিয়ে নারী সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। দাবী ওঠে নীতি নির্ধারণের জায়গায় মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের।                              

“নারীর ক্ষমতায়ন”সংবিধানে মহিলাদের জন্য অনেক রক্ষাকবচের সুযোগ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই কথার কথা থেকে গেছে। ভারত সরকার ২০০১ সালকে নারীর ক্ষমতায়ন বা সশক্তি বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু বাস্তবে ছবি কি কথা বলছে?

থমসন রয়টার্সের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত মহিলাদের জন্য বিশ্বের চতুর্থ বিপজ্জনক দেশ। জি-২০দেশগুলির মধ্যে নারীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর দেশ  হিসেবে উল্লেখিত হয়। স্বাস্থ্য,শিক্ষাকর্মসংস্থাননিরাপত্তা সবক্ষেত্রেই এক ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি নারীসমাজ।                            

ভূমি সম্পত্তির অধিকার– বেশির ভাগ ভারতীয় পরিবারে মহিলাদের নামে কোন সম্পত্তির মালিকানা নেই এবং পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ২০০৫সালে (Hindu Succession Amendment) হিন্দু উত্তরাধিকার (সংশোধন) আইন করা হয়।

মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ -ধর্ষণ ,এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের কারণে হত্যা ,পারিবারিক সম্মান এর নামে হত্যা, বলপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার মতো অপরাধ সংগঠিত হয়ে চলেছে । তাই এক্ষেত্রে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো এই ঘটনাগুলো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছে অর্থাৎ আইনে নারীদের জন্য রক্ষাকবচের কথা বললেও বাস্তবে কোন জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা আমাদের বুঝতে হবে।

মানবাধিকারের যে শাখাটি নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় হচ্ছে তা হলো মহিলাদের সম-অধিকারের প্রশ্নটি। আমাদের দেশেও সংবিধানে নারীর সম-অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে নানা কারণে পুরুষের তুলনায় নারীদের হীন অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করছি।

এমনকি জনসংখ্যার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কম। যার প্রধান কারণগুলো হলো-পরিণত বয়সে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে, নারী জন্ম সমাজের বোঝা এই কারণে কন্যা ভ্রূণহত্যা, শিশুকন্যা হত্যা, অপুষ্টিজনিত কারণে মাতৃত্বকালীন মৃত্যু, পণপ্রথার কারণে হত্যা ইত্যাদি। 

ধর্ষণ আমাদের রাজ্যের সাথে সাথে বর্তমান ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধগুলোর মধ্যে প্রধান বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “একশন ইউকের “একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতে ৮০% নারী যৌন হয়রানির শিকার। পরিবার, শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র, পরিবহন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়রানির শিকার সর্বক্ষেত্রেই আইন থাকা সত্বেও রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং হতাশাজনক।

অনৈতিক পাচার প্রতিরোধ আইন পাস হয় 1956 সালে। অল্পবয়সী ও যুবতী পাচার করা হচ্ছে পতিতাবৃত্তি ,গার্হস্থ্য কাজ ও শিশুশ্রমে। আইন এ ক্ষেত্রে কার্যকরী হচ্ছে না।

কর্মজীবী মহিলাদের জন্য বিশেষ আইন- মাতৃত্বকালীন সুবিধা আইন, গর্ভপাতের কারণে  সবেতন  ছুটি, সমমজুরি আইন( ইকুয়াল রেমুনারেশন act 1976 ) সংবিধানের 39 নম্বর অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের একই কাজে সমান মজুরি কথা বলা হয়েছে।

ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রাটিক রাইটস অফ ইন্ডিয়া- সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারকে সামনে রেখে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় ও নির্দেশ দেন তা হল- ১)সমকাজে সমমজুরি দিতে হবে। ২) মালিকের হাতে অর্থ নেই তাই এই অজুহাতে দায়িত্ব থেকে মুক্তি হতে পারবেনা। ৩) নিয়োগের প্রশ্নে নারী-পুরুষের বৈষম্য হবে না। কোন মালিক পদোন্নতি-বদলি প্রশ্নে লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য করতে পারবে না।

এইসব কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য পরামর্শমূলক কমিটি হবে যার সদস্য ৫০ শতাংশ মহিলা হবে। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন হেনস্থা আইন(২০১৩)বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া আছে। যে কথাগুলো বলা আছে তা হল- সুস্থ ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তা দেখা। সংবিধানে শিশু ও নারীদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে নানাবিধ আইন থাকলেও বাস্তবে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না।

শিক্ষা ক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন- মহিলাদের সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেলেও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। স্কুল ভর্ত , স্কুলছুট হয়ে যায় মেয়েরা। বিশেষজ্ঞদের মতে কেরালার নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রধান কারণ হলো নারী শিক্ষার অগ্রগতি কর্মক্ষেত্রের মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় অনেক কম বর্তমানে তা ভয়াবহভাবে কমেছে। নারীদের প্রকৃত অবস্থা ১০ জন নারীর মধ্যে চারজনের নিজের ব্যাপারে কিছুই বলার থাকেনা। ১০ জনের মধ্যে ৮ জনকে চিকিৎসার অনুমতি নিতে হয় ৪৮% মহিলার ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হচ্ছে মহিলাদের স্বাধিকারের বিষয়টি এখনও অধরাই থেকে গেছে এমনকি বিয়ের প্রশ্নে নিজস্ব মত দেওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। একটি সমীক্ষা- ১০ ভাগ মহিলা জানিয়েছেন বড় কিছু কেনার প্রশ্নে তাদের মত নেওয়া হয়। ২০ ভাগের কম নারীর নাম বাড়ির দলিলে আছে। একটা বড় অংশের মহিলাদের জীবন কাটে ঘোমটা বা হিজাবের মধ্যে।          

বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতা— আমাদের দেশের জনগণ বিশেষ করে মহিলারা ভয়াবহ সংকট ও বিপর্যয়ের মুখে এসে পড়েছে। ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর আক্রমণ ক্রমবর্ধমান। জীবন-জীবিকাও আক্রান্ত। মহিলারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নারীর ওপর হিংসা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আইন মজুদ থাকলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না।

মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি  দ্বারা পরিচালিত শক্তির কারণে আক্রান্ত মহিলা সমাজ। ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ভারতীয় জনগণের জন্য জন্য সমান অধিকারের কথা বলা হলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি তাকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার হয়ে আজও আমরা নারী সমাজ আমাদের নিজস্ব অধিকারের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই অধিকার আমরা ছিনিয়ে আনবই। আমাদের শপথ “রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিড়ে আনব ফুটন্ত সকাল। “