১) ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থা           

                          
     ভারতীয় সমাজ সহ বিশ্বের সব সমাজ ব্যবস্থায় ছিল নারী-পুরুষের বৈষম্য। মানবসভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন স্তরে নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রবহমান এই ধারনায় আমরা বিশ্বাসী। এটা কি চিরন্তন সত্য? কখনোই না। আদিম যুগের শেষ ভাগে জননী বিধির অবসানের মধ্য দিয়ে নারীজাতির পরাধীনতা শুরু হয়। সামাজিক উৎপাদনের কাজ থেকে নারীদের বঞ্চিত করার ফলে পুরুষের নারীর উপর প্রভূত্ব স্থাপন শুরু হয়। সমাজ বিজ্ঞানী কার্ল মার্কস দেখালেন সমাজ বিকাশের চালিকাশক্তি হল দুই বিপরীত শ্রেণীর সংগ্রাম। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে দুই শ্রেণী শোষক ও শোষিত। এই দুই শ্রেণীর লড়াইয়ের মধ্যেই সমাজ ক্রমশ এগিয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পূরুষ শাসিত সমাজ ধরেই নিয়েছে নারী-পুরুষের বৈষম্য, পুরুষের প্রাধান্য, নারীর বশ্যতা এটাই শ্বাশ্বত। কিন্তু মার্কসবাদ প্রমাণ করল না, এটা চিরন্তন সত্য নয়। সমাজে আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থায় নারী পুরুষের বৈষম্য  ছিল না। ছিল সকলের সমান অধিকার। এমনকি এই সমাজে নারীর অধিকার ছিল উল্লেখযোগ্য। আবার মার্কসবাদ এটাও দেখালো মানবসমাজের অবশ্যম্ভাবী উত্তরণ ঘটবে শ্রেণীহীন সমাজে। সমস্ত শ্রেণী বৈষম্যের অবসান ঘটবে ও সেই সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। যে কোন দেশ কালের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা কতটা উন্নত, কতটা মানবিক আর কতটা গণতান্ত্রিক তা পরিমাপের মাপকাঠি হল সেই সমাজে মহিলাদের অবস্থা। ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একথা বলা যায়  , আমাদের দেশে নারীরা তিন ভাবে শোষিত। ১) নাগরিক হিসেবে। ২) শ্রমিক হিসেবে। ৩) নারী হিসেবে। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করেও ভারতীয় নারীরা আজও অবহেলিত ও বঞ্চিত।

২) পরাধীন ভারতে নারীর অবস্থা ও অধিকারের লড়াই        


        পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয়রা ভারতে যখন আসেন, তখন এদেশ ছিল আদিবাসী উপজাতি সমাজ ও গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজ এই দুই ব্যবস্থা। একদিকে রাজতন্ত্র অন্যদিকে সামন্ততন্ত্র। এই দুই ব্যবস্থায় নারীরা ছিলেন চূড়ান্ত ভাবে নিষ্পেষিত। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল নিরঙ্কুশ।ব্যতিক্রম ছিল আদিবাসী ও কৃষি ভিত্তিক সমাজের, মহিলারা। এই দুই সমাজের মহিলারা একদিকে কৃষি শ্রম এ যুক্ত হতেন আবার আদিবাসী মহিলাদের কাজ ছিল গভীর বন ভিত্তিক। এই মহিলারা সামন্ত সমাজের মহিলাদের থেকে বেশ কিছুটা স্বাধীন ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এরপর অষ্টাদশ- উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতে প্রভূত্ব স্থাপন করে। তারা যে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলল তার চরিত্র হল ধনতান্ত্রিক বা পূজিবাদ। এই ব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে কলকারখানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা গড়ে তুলল। এসবের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিন্তা ও মতবাদের বিস্তার ঘটে। এর ফলে নারী শিক্ষার, ক্ষুদ্র প্রকাশ্য শ্রমে নারীদের অংশগ্রহণ শুরু হয়। শিক্ষিত নারীদের মধ্যে অধিকার বোধের জন্ম হয়। ভারতীয় সমাজে নারীদের প্রতিবাদ অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের অজ্ঞাতে যুগ যুগ ধরে চলা লৌকিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। এই সময়কালে গড়ে ওঠে নারীসমাজের পক্ষে প্রগতির লড়াই।    

          
. ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আন্দোলনে নারী প্রসঙ্গ —   সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, বহু বিবাহ, কন্যা বিক্রয়, রক্ষিতা ব্যবস্থা, বিধবা বিবাহে নিষেধাজ্ঞা এর বিরুদ্ধে বিরোধিতা, আইন প্রণয়নের জন্য লড়াই ও নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রযাস গড়ে ওঠে। শুরু হয় রক্ষণশীলতা বনাম প্রগতির লড়াই।

 

৩) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীসমাজের জন্য অধিকারের লড়াই


     ১৯১৭ সালে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা।সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। নারী পুরুষের বৈষম্যের অবসান।সামাজিক উৎপাদনের কাজে নারীদের যুক্ত করা হল। নারীরা অর্থনৈতিক মুক্তির আস্বাদ পেলেন।এই ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বের জনগণের সাথে সাথে ভারতীয় জনগণ ও আগ্রহী হল। দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ের পাশাপাশি নিজ নিজ ক্ষেত্রের অধিকারের লড়াই আন্দোলন গড়ে তুললেন। ১৯৪৫সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর বিশ্বের রাষ্ট্র গুলি সম্মিলিত হয়ে রাষ্ট্রসংঘ গঠন করে। অন্যান্য কর্মসূচির সাথে নারীজাতির স্বার্থে বিভিন্ন সুপারিশ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নারী পুরুষের সমতা স্থাপনের লক্ষ্যে সি এস ডব্লু -“কমিশন অন দি ষ্ট্যাটাশ অফ উইমেন ” গঠন হয়। ৪৬টি দেশের প্রতিনিধিরা এর মধ্যে ছিলেন।এদের কাজ ছিল দুনিয়া জুড়ে নারীদের অসহনীয় পরিবর্তন, তাদের অগ্রগতির তত্বাবধান ও তাদের অধিকারের বিকাশ ঘটানো।নারীদের বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংগঠিত হয়। ১৯৭৫ এ মেক্সিকো শহরে,১৯৯৫ সালে বেজিং সম্মেলনে নারীর সম অধিকার ও মর্যাদার বিষয়গুলি গুরুত্ব আরোপ করলেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া নারীসমাজ বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার । আমাদের দেশ তার বাইরে নয়। 


৪) পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম  


      ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ভারতের আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছিল অপ্রতিরোধ্য। দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে নারীদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। সমস্ত ধারার লড়াইয়ে নারীসমাজ অংশগ্রহণ করেছিলেন।অবশেষে ১৯৪৭সালের ১৫ই আগষ্ট দেশ স্বাধীন হল। ভারতীয় জনগণের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল জমি, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান যা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমান হোক। স্বাধীন দেশের নারীরাও এই আকাঙ্খায় দল তাকিয়ে ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক দের  ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার দিকে।জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি ভারত প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রর ঘোষণা হয়। ভি আর আম্বেদকর, জহরলাল নেহেরু সহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে (যাঁদের মধ্যে মহিলারাও ছিলেন) রচিত হয় ভারতীয় সংবিধান।               

                 
      বিগত কয়েক সহস্রাব্দে ভারতীয় নারীদের অবস্থা বহূ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। ভারতীয় নারীদের বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে যে অধিকারের কথা বলা হল তার মূল বিষয় হল সাম্য, মর্যাদা, বৈষম্য থেকে মুক্তি। এছাড়াও নারীদের অধিকার সহ নানা ধরনের বিধি প্রযোজ্য হয়েছে এই সংবিধানে।
                                                                                                                   to be continue..