আজ ১৬ ডিসেম্বর ,মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরাজয় বরন করেছিল, এই দিনে। দীর্ঘ নয়মাস রক্তনদী পেরিয়ে, ৩০ লক্ষ শহীদ আর দুলক্ষ মা-বোনের উপর পাশবিক নির্যাতনের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল, একমাত্র বাংলা ভাষার রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দেখতে দেখতে সেদিনকার শিশু রাষ্ট্র আজ পঞ্চাশ পেরিয়েছে।

যে মুক্তি যুদ্ধের অবিনাশী চেতনা বুকে আজো তরুণ প্রজন্ম রাতজাগা স্লোগান দেয় শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে,আলপনা দেয় একুশের অলৌকিক প্রভাত ফেরীতে, পঞ্চাশ পেরনো বাংলাদেশ কতটা সেই তরুনের,কতটা কৃষকের, কতটা নারীর -আজ সেই হিসেবের খাতা না খুললে চলবে না।

ভাষা ধরলে বাঙালির ইতিহাস,হাজার বছরের। তার আগে কয়েক হাজার বছর ছিল বাঙালি হয়ে ওঠার প্রস্তুতিকাল। বাঙালির ইতিহাস বাংলা র হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের সম্মিলিত ইতিহাস। ইতিহাসে র এই পরিক্রমায় বাংলাকে বহুবার বুকের রক্ত ঢালতে হয়েছে অধিকার আদায়ে। আবার সে অধিকার বেহাত ও হয়েছে। এই সংগ্রামী পদযাত্রায় বাঙালি কখনো ক্লান্ত হয়নি, বরং সহযোদ্ধা র লাশ কাধে নিয়ে সে বারে বারে মিছিলে নেমেছে,অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্লোগান দিয়েছে। নীল বিদ্রোহ থেকে তেভাগা, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা র আন্দোলন পার হয়ে ৫২র ভাষা আন্দোলন, তারই ফল্গুধারায় পদ্মার পূর্বপারে একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠেছিল। আমরা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের সেই কালজয়ী বিজয়কে খন্ডিত চোখে দেখতে রাজি নই।

বাঙালির পাজর ভেঙেছে

সাতচল্লিশের দেশভাগে। ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্বের লোভনীয় অস্ত্রকে শাসকশ্রেণী ব্যবহার করতে পেরেছিল এই কাজে। পূর্ব বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ, মূলত বাঙালি মুসলমান সেদিন পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল।বিশ্বাস ছিল পাকিস্তান আদায় হলে জমিদার-জোতদারের শোষণ থেকে সে মুক্ত হবে। যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত কৃষক জনতা কে এই স্বপ্ন ই দেখানো হয়েছিল। দেশভাগের অল্পদিন পরেই,এই ভুল ভেঙেছিল তাদের। বাংলার কাচামাল কে আত্মসাৎ করা, অর্থনৈতিক শোষন এসবের হাতধরেই এসেছিল জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার স্বৈরাচারী মনোভাব। মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গর্জে উঠল তামাম পূর্ববাংলা। ভাষা আন্দোলনে শহর গিয়েছিল গ্রামে, বুদ্ধিজীবী গিয়েছিল শ্রমজীবি র কাছে। ঢাকার আকাশে সেদিন মেঘ ছিলোনা। কিন্তু কালো পিচের রাস্তা লাল হয়ে গিয়েছিল ছাত্রদের রক্তে।মাতৃভাষা র মর্যাদা চাইতে গিয়ে শহীদ হল সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর ,জব্বার। এই লড়াইকেই বদরুদ্দীন উমর বলেছেন-“বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ যাত্রা”। বলা হয় ৫২ র ভাষা আন্দোলন ই ৭১র বাংলাদেশের ভিত্তিমূল রচনা করেছিল।তাই একুশের অসাম্প্রদায়িক বাঙালিচেতনা থেকেই উৎসারিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। দেশভাগের সময়ে বারশো মাইল দূরের পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়াই ছিল অবাস্তব বিষয়। সংসদীয় ভাগাদারিতেও বঞ্চিত হয়েছিল পূর্ববাংলা। গোটা জনগোষ্ঠী কেই নিকেশ করতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী সরকার। শাসক ইয়াহিয়া খানের সদর্প ঘোষনা ছিল পূর্ব বাংলা র মানুষ চাইনা,মাটি চাই। প্রয়োজনে রক্তে লাল করার ঘোষনা ও দিয়েছিলেন।তাই করেছিলেন শেষ পর্যন্ত।ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রান গেছে এই লড়াইতে। দু লক্ষ মা-বোনকে ধ্বর্ষন করেছিল পিশাচরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মৌলানা ভাসানী,তাজুদ্দিন আহমেদ কমরেড মনি সিংহরা যার যার অবস্থান থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতা র এই লড়াইতে। প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান। এই লড়াইয়ে ভারত ছিল সহযোগী।সেটাও ভারত পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বলে।

কি পেল বাংলাদেশ,কি পেলোনা এই প্রশ্ন আজ ক্ষতিয়ে দেখা জরুরি।

খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে নানা খন্ডে বিভক্ত বাংলা র ভূগোলকে জুড়ে যে পলিটিক্যাল বঙ্গভূমির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ,সেটাই অনেক টা পূর্ণ তা পেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। পৃথিবীর বুকে একমাত্র বাংলা ভাষার রাষ্ট্রের আবেগ ধারন করে আছে বাংলাদেশ। স্বীকার করি আর নাই করি বাঙালির ভাষা,সংস্কৃতি চর্চার বাতিঘর হয়ে দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। আজও মৌলবাদী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতাদর্শ গত মূল রসদ তো আসে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই। নইলে স্লোগান উঠবে কেনো “একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার”,হিন্দু-মুসলিম জনতা/গড়ে তোলো একতা”।

একটা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছিল বলেই তো সুদীর্ঘ কালব্যাপী ইতিহাসে পদদলিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এত দ্রুত একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যবিত্ত গড়ে উঠতে পেরেছে।

হেরেছিল ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ব।কিন্তু আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন করেছেন বাংলাদেশের প্রয়াত লেখক,বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা-একাত্তরের বাংলাদেশ শুধু দ্বিজাতিতত্ব কে ভ্রান্ত প্রমাণ করেনি,ভারতীয় উপমহাদেশের একজাতি তত্ত্বকেও ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিল।

কিন্তু বাংলাদেশ কি সব অর্থে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষের কাছাকাছি পৌছাতে পেরেছে?যতটা অঙ্গীকার আর স্বপ্ন ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ? হ্যাঁ স্বাধীনতা যুদ্ধ ই বলতেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক।তাঁর মতে মুক্তিযুদ্ধের নানা মাত্রা এখানে অনুপস্থিত। নিপীড়িত শ্রমিক-কৃষকের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি বাদ দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ হয়না। অর্থাৎ শ্রেণী বৈষম্যের অবসান।সে তো সুদূর পরাহত। দুর্নীতি, লুটপাট, রাজনৈতিক সন্ত্রাস,ভোট ডাকাতি, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস এসব ই দেখতে হচ্ছে।এমনকি নব্যধনীদের ইংরেজি প্রীতির চাপে বাংলা ভাষাও কোনঠাসা হতে শুরু করেছে। সংখ্যালঘুর উপরে আক্রমণ, নারীর উপর শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক আক্রমন চলছে। মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানার চাপে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিঃশ্বাস নেওয়ার আরও পরিসর দরকার।

অপরদিকে একাত্তরের পরাজিত শক্তি গণতন্ত্রের মায়াকান্না কাঁদছে।মাঝে মাঝেই দাতনখ বের করছে। জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন।

আসলে বুর্জোয়া দলগুলোর কাছে বড় বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এর বেশি কী দেওয়ার আছে তাদের।স্বাধীনতা যুদ্ধ কে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হলে মেহনতি র অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। সেই রাস্তা বামদিকে।সেই রূপালীরেখা কালো মেঘ ভেদ করে এখন ই দৃশ্যমান হয়নি বাংলাদেশে।

ভারতীয় প্রেক্ষিতে ১৬ডিসেম্বর:ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ব, বৈচিত্র্য কে অগ্রাহ্য করে একভাষার আগ্রাসন, একদিন ইসলামের নামে চালাতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে র শাসকশ্রেণী।পারেনি।ভারতে সরাসরি সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায়।হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান রথের চাকায় উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ব দিয়ে চূর্ণ করতে চায় ভারতের বৈচিত্র্য কে।প্রধান টার্গেট সংখ্যালঘু এবং বামপন্থী রা।পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৪ডিসেম্বর ৭১সালে হত্যা করেছিল অগনিত বুদ্ধিজীবী দের।বিজেপি ও বুদ্ধিজীবী দের জেলে পচাচ্ছে।একমাত্র হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার পায়তারা করছে।বাংলাভাষী মানুষ কে টার্গেট করে

NRC বানিয়েছে।বাঙালি কেনো মাছ খায় সেটাও নির্বাচনী ইস্যু।ভারতীয় বলে জাতি হয়না।ভারত বহু জাতির দেশ।যদি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর পরিনতি দেখে শিক্ষা না নেয় ভারতের বিজেপি সরকার, তবে কে বলতে পারে ১৬ডিসেম্বর উপমহাদেশে আবার আসবে না,নতুন তাৎপর্যে ?