এখনো ভাবতে শিহরণ জাগে।আমার দিদিমার বাড়ার বিরাট উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় ওঠার সিঁড়িতে বসে দাদুকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছি; বামপন্থী জোটের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন জ্যোতি বসু– তখন ব্যালটে গোটা হত ভোট।আজকের মত এত খবর পাওয়ার উপকরণ ছিল না সেদিন।সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজ ও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।’৭৭ এর সেই জুন মাস– আমাদের নবজন্মের মাস।

  শৈশব পার হয়ে শৈশোরের ভরন্ত বেলায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জায়গায় জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন- এটা কেন আমাদের কাছে নবজন্ম বলে মনে হয়েছিল? কারন, সেই শৈশবকাল পার হয়ে বোধশক্তির বিকাশের লগ্নেই আমরা দেখেছিলাম, শাসক মানেই যুব কংগ্রেস।আমরা যারা মফসসলি মানুষ, আমাদের কাছে সোমেন- সুব্রত- নুরুল- কুমুদ- প্রিয় দের দেখবার দুর্ভাগ্য না হলেও আমরা দেখেছিলাম সন্টু দত্তদের।যে সন্টু দত্ত তার দিদির স্বার্থ হানি ঘটতে পারে বলে সমরেশ বসুর পত্নী গৌরী বসুর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কোনো ডেকরেটারকে মাইক ই দিতে দেয় নি।আমরা দেখেছিলাম ডাবু গুন্ডাকে।পাশের শহরের কংগ্রেসী এম এল এ।একটা পোষাকি নাম ছিল তার।ভয়ে ভক্তিতে লোকে তাকে ডাকনামেই ডাকত।কিন্তু আমাদের বাড়ির লোকেরা কখনোই ‘ ডাবু’ কে ‘ গুন্ডা ‘ বিশেষণে বিশেষিত না করে ছাড়ত না।অনেককাল পরে প্রফুল্লচন্দ্র সেন যখন আমাকে ‘ গোলকেশে’ র খবর জানতে চেয়েছিলেন  সেই উঠতি যুবার স্পর্ধায় বলেছিলাম; ও , তুমি ‘ ডাবু গুন্ডার কথা জানতে চাইছ?’    সি পি আই ( এম) কে খতম করবার জন্যে ইন্দিরা- সিদ্ধার্থের যৌথ মদতে তৈরি সঙ্কীর্ণতাবাদীদের গুন্ডামো, একাংশের রিফাইন্ড জেন্টলম্যানরা যাদের শুদ্ধ কেতায় বলে থাকে,’ নকশাল’ তাদের অভব্যতা দেখবার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, যুব কংগ্রেসের সঙ্গে এই নকশালদের যৌথভাবে ‘ কংশাল’ সেজে সি পি আই ( এম) খতম করা দেখবার সামান্যটুকু অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে ,তাঁরাই বুঝবেন, সাতাত্তরের একুশে জুন কে কেন আমি আমাদের প্রজন্মের ‘ নবজন্ম’ বলছি।খুন ,রাহাজানির জন্যে অবাধ যৌনাচার– এটা ছিল কংশাল এবং একটা বড় অংশের সঙ্কীরাণতাবাদী রাজনৈতিক পরগাছাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কালে যেমন বাংলাদেশের মানুষ হানাদার পাক বাহিনী আর রাজাকার- আলবদর- আলশামস দের যৌথভাবে নারীমাংস ভক্ষণ দেখেছে, তেমন ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কংগ্রেস আর নকশালদের যৌথ নারী মাংস ভক্ষণের ‘ উৎসব’ দেখেছে।তাই যুবক থেকে প্রবীণ তো দূরের কথা, আমাদের মত সেই সময়ের কিশোরেরাও ওই নারী মাংসলোলুপদের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুক্তি পাওয়াকে নবজন্মলাভ ই বলে মনে করেছিল খুব আন্তরিক ভাবে।

 অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বোঝবার মত বয়স তখন ও আমাদের সেভাবে হয় নি।তবে বয়সের নিরিখে একটু বেশি রকম ই আমরা সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম তখন পারিপার্শ্বিকতাকে ঘিরে।মেয়েরা যে সন্ধ্যে হয়ে গেলে আর বাড়ির বাইরে নিরাপদ নয়, এমন কি ভরদুপুরে ইস্কুল- কলেজ ছুটির পর ও হয় তাদের অভিভাবকেরা সঙ্গে করে নিয়ে আসত, নতুবা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে পরে তাদের জন্যে বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ– এইসব কেউ আমাদের বলে না দিলেও , আশেপাশের অবস্থা দেখে , কেমন করে কে জানে আমরা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে শিখে গিয়েছিলাম। 

  তাই যখন আমাদের  কাছে প্রথম এটা পরিস্কার হলো যে, নতুন কেউ একজন মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন  , এই সিদ্ধার্থ শংকর রায় আর আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না ,তখন আমাদের কাছে এটাই প্রথম উঠে এসেছিল যে ,আমার- আমাদের  মা মাসীরা  অফিস শেষ করে, কলেজ শেষ করে নিরাপদে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন। তাঁদের ফিরতে দেরি হলে বাড়ির গুরুজনেরা, দাদু, ঠাকুমা, দিদিমারা বারবার ঘর বাইরে করবেন না। তখন তো আর ঘরে ঘরে ল্যান্ডফোনের ব্যবস্থা ছিল না ।আর যাওবা দু-একটি বাড়িতে ল্যান্ডফোন ছিল ,সেগুলিতে কানেকশন পাওয়া ও ছিল  দুষ্কর ব্যাপার। তাই যদি বোমাবাজি থেকে অন্য কোন ধরনের বিপদের কবলে চাকুরিরতা মেয়েরা বাইরে গিয়ে পড়তেন, সেইসব খবর বাড়িতে জানিয়ে, বাড়ির লোকদের  নিশ্চিন্ত করবার কোন উপায় ছিল না তখন ছিল না।সেই কারণে বাড়ির লোকদের ভয়ঙ্কর টেনশন। আর সেই টেনশন যে যুব কংগ্রেস থেকে শুরু করে ,একটা বড় অংশের নকশালদের ঘিরে ই বেশি হত, সেটা বুঝতে , সেই ছোট বয়সে আমাদের কোনো অসুবিধা হতো না। কারণ, আশেপাশের ,পাড়া-প্রতিবেশীদের ,কারো না কারো ঘর থেকে ,কখনো না কখনো, আর্তনাদের শব্দ ,তা তাঁদের  বাড়িতেই হোক বা তাঁদের আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যেই থেকে হোক, অঘটন টা  তখন যেন কেমন একটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল ।মধ্যবিত্ত তখন প্রতিবাদের জায়গাকে অতিক্রম করে ধীরে ধীরে প্রতিরোধের একটা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছিল।                 

এমনই একটা সময় কিন্তু ‘৭৭ এর নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে বামফ্রন্টের জয়লাভ ,  জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ।এইসব সেইদিন  যদি না ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করত , সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের অপশাসন, যুব কংগ্রেস একটা বড় অংশের সঙ্গে নকশালদের এই যৌথ সামাজিক ব্যভিচার  চলতেই থাকত,  আজ পরিণত বয়সে এসে মনে হয় ,সাধারণ মধ্যবিত্তের  ভেতর থেকে প্রতিবাদটা, প্রতিরোধের জায়গায় পর্যবসিত করা হত।সেই যে প্রতিরোধের আগুন জ্বলত,  সেটা কে সামাল দেওয়া, সেটাকে প্রতিহত করা শাসকের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।   

জরুরি অবস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কংগ্রেস এবং তাদের সেই সময়ের সমস্ত ধরনের সহায়ক শক্তি ,যাদের একমাত্র কাজ ছিল যে কোনো উপায়ই সিপিআই(এম) কে প্রতিহত করা, তারা গোটা পশ্চিমবঙ্গে যে অরাজক পরিস্থিতি শুরু করেছিল ,বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে অমানুষ রাজকে  তারা ডেকে এনেছিল, তা একটি শিশুর মনস্তত্ত্বের উপরে সেদিন কিভাবে রেখাপাত করেছিল, তা সেই সময়ের শিশু ,যারা আজ প্রায় প্রৌঢ়ত্বের দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই স্মরণে আছে।             

   আজ যে তৃণমূল বাহিনী এবং তাদের সহযোগিতা করতে বিভিন্ন জায়গায় অদৃশ্যভাবে আরএসএসের নানা ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংগঠনগুলি একটা সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে শুরু করেছে, সিভিক ভলেন্টিয়ার থেকে শুরু করে ,   সিভিক সেনা, তার  ভেতর দিয়ে  ভবিষ্যতের যে ভয়াবহ  হাতছানি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দিচ্ছে ,ঠিক সেই পরিস্থিতিই  কিন্তু সেই দিন, কংগ্রেস নেতাদের  ছত্রছায়ায় থাকা সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক শিবির অত্যন্ত নগ্নভাবে সমাজের বুকে নিজেদের চিহ্ন রাখতে শুরু করে দিয়েছিল। এই কাজে শ্রেণী সহযোগিতাবাদীদের থেকে শুরু করে  সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত,  সি পি আই(এম)কে খতম করতে মরীয়া  নকশাল বাহিনী ,কোথাও প্রত্যক্ষ, কোথাও পরোক্ষভাবে কংগ্রেস এবং তার নেতৃত্বাধীন সুশৃংখল সমাজবিরোধীদের সমস্ত ধরনের অরাজকতা র সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছিল ।                 

এই পরিস্থিতি থেকে আমরা যে পরিত্রাণ পাবো সেই ভাবনাটা পরিণত বয়সের মানুষদের সেদিন যে রাজনৈতিক পরিণতির ভেতর দিয়ে উঠে এসেছিল, ঠিক তেমনভাবে উঠে আসার মত মানসিক অবস্থা তো শিশু-কিশোর মনে ছিল না। কিন্তু সেদিনের শিশু-কিশোর মনে কংগ্রেস, শ্রেণি সহযোগিতা বাদী বামপন্থী এবং সংকীর্ণতাবাদীদের যৌথ সাঁড়াশি  আক্রমণের ফলে সামাজিক বিধি-বিধান, সমস্ত ধরনের শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম– এসব সম্পর্কে একটা সচেতন মানসিকতা তৈরী করে দিয়ে, শিশু-কিশোরদের, তাদের বয়সের থেকে যেন অনেক বেশি পরিণত করে তুলতে পেরেছিল। সেই জায়গা থেকেই জ্যোতি বসুর কি রাজনৈতিক অবদান বা আগামী দিনের আর্থ-সামাজিক- সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার কতখানি কি ইতিবাচক সাড়া ফেলতে পারবে, এই  সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি কিশোর মনে তৈরি না হলেও ,সিদ্ধার্থ শংকর এবং তার আশেপাশের পরিমণ্ডলের তৈরি করা অরাজকতা থেকে, সামাজিক ব্যভিচার থেকে যে আমরা মুক্তি পেতে চলেছি, শিশুর জন্য বাসযোগ্য একটা পৃথিবীতে তৈরি হওয়ার উপক্রম সৃষ্টি হতে চলেছে সে সম্পর্কে সম্যক বোধ সেদিনের প্রায় প্রতিটি কিশোরচিত্তকে আলোড়িত করেছিল।