২০২২ সালের ২১ শে জুলাই তৃণমূল কংগ্রেস আহুত “শহীদ দিবস “পালনের জন্য হৈ হৈ শুরু হয়েছে ।২০২১ সালে কোভিড এর জন্য “ভার্চুয়াল ” সভা হয়েছিল ।ঠিক মত জমেনি।তার জন্যই এই বৎসর বাড়তি উদ্যোগে ভাই এর দল আসরে নেমেপড়েছে ।বক্তৃতা ,প্রতিশ্রুতি যেমন থাকবে তেমনি থাকবে নাচা গানা ।শহীদ দিবস না আনন্দ দিবস এ বোঝা খুব কঠিন ।তবে ঐদিন যাঁরা মঞ্চ আলো করে থাকেন তাদের শারীরিক ভাষাই বলে দেয় এটা আনন্দ দিবস।১৯৯৩ সালের ২১ শে জুলাই কলকাতার রাজপথে কি ঘটেছিল এখনকার ছেলে মেয়েরা জানে না সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো? বিশেষ করে ১৯৯৩ সালের আগে পিছে যাদের জন্ম আজ তারা ভরা যৌবনে ।তাদের উদ্দেশ্যেই তখনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখাগুলো আমি সংকলন করার চেষ্টা করেছি ।ঐ সময়কার সংবাদপত্রে সংগতভাবেই যে প্রশ্নগুলো তুলে ধরা হয়েছিল তা আজও প্রাসঙ্গিক ।ওনার পরিবর্তন কিছুই হয়নি ।কোন এক সময়ে উনি বলেছিলেন, “আমি গুণ্ডা কন্ট্রোল করি ।” তখনও তাই করেছেন ।কথাটা গর্ব করে বললেও বাস্তবের সাথে মেলানো যাচ্ছে না ।অর্থাৎ গুণ্ডারা তখনও ওনাকে  কন্ট্রোল করেছিলেন এখনও তাই করছেন ।সরকারে থাকলেও ওনার বৈশিষ্ট্যগুলো একটুও বদলায়নি ।দেখা যাক  তখনকার সংবাদপত্রে কি লেখা হয়েছিল ।*১৯৯৩ সালের ২১ শে জুলাই মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে মহাকরণ দখলের অভিযান –“বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন “

আনন্দবাজার ২৩ শে জুলাই ‘৯৩ তাদের সম্পাদকীয় “সন্ত্রাসের বাঁকা পথ “– এ লিখেছিল* —” মমতা বন্দোপাধ্যাযের এই আন্দোলনের নিট ফল কি, সে প্রশ্ন উঠিতে পারে ।এতগুলো প্রাণের বিনিময়ে যুব কংগ্রেস কি পাইল ?রাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে মমতা ফিরিয়া আসিলেন, ইহাই কি প্রাপ্তি? কংগ্রেস রাজনীতিতে প্রান্তিক অবস্থান হইতে তিনি কাঙ্খিত আসনটি আদায় করিয়া লইলেন, ইহাই কি প্রাপ্তি? ——-দেশের সমূহ সমস্যাগুলি কিন্তু তাহার দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়াইয়া গিয়াছে ।বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রাণের তাঁহার সাড়া মেলে নাই। —–স্ল্যাম, হর্ষ মেটা ইত্যাদি লইয়া দেশ যখন তোলপাড় ,রণরঙ্গিনী বেশে তখন তিনি মহাকরণ অবরোধে অবতীর্ণ ।এই রাজনীতি অভিনব নয় ।কিন্তু এই রাজনীতি সমর্থনযোগ্যও নয় ।বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিয়া যদি কোনও দল রাজনীতির আসন দখল করিতে চায়, যদি কোনও দল চায় কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগে তাহাকে ব্র্যাকমেল করিয়া নিজেদের আখের গুছাইতে, তাহা যেমন নান্দনিক, তেমনই নিন্দনীয় জবরদস্তি করিয়া মহাকরণ দখলের উদ্যোগ ।অসংখ্য মানুষের মিছিল সাজাইয়া অভিযানে বাহির হইলেও এই পথ গণতন্ত্রের পথ নয়, সন্ত্রাসের বাঁকা পথ “।টেলিগ্রাফ পত্রিকা ২২ শে জুলাই ‘৯৩ প্ররোচনার দায় পুরোপুরি মমতা ব্যানার্জির উপর চাপিয়ে ওই ওই সম্পাদকীয়তে ওরা লিখেছিল  ‘”এখনও পর্যন্ত তাঁর কোনও আন্দোলন বা সমাবেশ থেকেই ওই কংগ্রেস নেত্রী জনতাকে খেপিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও সাফল্যই পাননি ।জ্যোতি বসুর সরকারকে বিব্রত করা ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি এই মহিলার নেই ।তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর যে খামতি,তা তিনি মেটাতে চান তাঁরা উদ্যম দিয়ে ।তাঁর সে উদ্যম বিশেষত হিংসাকে জাগিয়ে তুলতেই সক্রিয় ।প্রশাসনের মূল কেন্দ্র অবরোধ করার আন্দোলন প্রতিবাদের ভঙ্গি হিসাবে বেশ সম্ভাবনাময় প্রতীক।কিন্তু এই ধরনের কর্মসূচি যখন পুলিশের সঙ্গে খোলাখুলি সংঘর্ষে পর্যবসিত হয়, তখন এর কোনও রাজনৈতিক বৈধতাই থাকে না ।বিশৃঙ্খল দলীয় কর্মী ও লুম্পেনদের দ্বারা গঠিত একটি কংগ্রেসী সমাবেশকে অহিংস থাকার ব্যাপারে যে ভরসা করা যায় না, এই রাজনৈতিক পরিপক্কতা থাকা উচিত ছিল মমতা ব্যানার্জির ।—–স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আগ্রহহীন একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন নেত্রী হিসাবেই  কুখ্যাতি অর্জন করছেন তিনি ।”*হিন্দুস্তান টাইমস তার ২৩ শে জুলাই ‘৯৩ সংখ্যায় “মমতার চিন্তা করা উচিত “শিরোনামে লিখেছিল*, “

বারেবারেই দেখা গেছে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন আন্দোলন হাঙ্গামাকারীদের হাতে চলে যায় ।তারা জনগণের সম্পত্তি নির্বিচারে ধ্বংস করে ।—–কিন্তু দাঙ্গা হাঙ্গামার পথ পরিহার করা কংগ্রেসের পক্ষে সহজ হবে না ।বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জি ঠিক এই ধরণের সমর্থনই আকর্ষণ করেন বলে দেখা যাচ্ছে ।তিনি বিশ্বাস করেন, কেবলমাত্র এই জাতীয় শক্তিকে জড়ো করেই তিনি দলের মধ্যে তাঁর বিরোধী তথা সিপি আই  (এম)-র বিরুদ্ধে  লড়াই করতে পারেন ।প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে উত্তপ্ত নির্বাচনে সোমেন মিত্রের কাছে হেরে যাবার পর মমতা ব্যানার্জি আগের চেয়ে বেশি মারমুখী হয়েছেন ।নিশ্চিতভাবেই এর লক্ষ্য হলো মিত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠিত দলীয় নেতৃত্বকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া ।

কিন্তু মস্তানবাহিনীর নেত্রী হিসাবে চিহ্নিত হওয়া তাঁর পক্ষে ভালো হবে কি?”*২৩ শে জুলাই ‘৯৩ তারিখে টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার আলোচনায় লিখেছিল*,”পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির জেহাদে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের বেশি আগ্রহ না থাকায় শ্রীমতী ব্যানার্জি নিশ্চিতভাবেই মনস্থির করেছিলেন ‘”মহাকরণ অবরোধ “এর কর্মসূচি কে এমনভাবে ব্যবহার করবেন, যাতে নয়াদিল্লি তাঁর প্রতি কিছু মনযোগ দিতে বাধ্য হয় ।বুধবার মধ্য কলকাতায় তাঁর সমর্থকরা যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল ,তা থেকেই এই কথা প্রমাণিত হচ্ছে ।ওই নৈরাজ্য ই  পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে ।

প্রথম থেকেই ওই বিক্ষোভ মমতা ব্যানার্জির কর্মসূচির অতি পরিচিত ধাঁচে শুরু হয় ।দোকান লুঠ ,সরকারি যানবাহন ও গাড়ি পোড়ানো, কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের গালিগালাজ করা ।অন্যান্য বারের তুলনায় বুধবারের ঘটনার তীব্রতা অনেক বেশি ছিল, এই যা ।

খুব শীঘ্রই বোঝা যায় ,ইঁট ,পাথর ও বোমা নিয়ে আক্রমণের মোকাবিলায় পুলিশ গুলি চালাবে ।কখন চালাবে, সেটাই একমাত্র প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ।ওই ঘটনায় মৃত্যু আরো বেশি দুঃখজনক কেননা একজন নেত্রীর অহংবোধের তৃপ্তি ছাড়া গোটা বিক্ষোভটির অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না ।”*দ্য স্টেটসম্যান তাদের ২৩ শে জুলাই ‘৯৩ এর সম্পাদকীয়তে লিখেছিল*, “এখন একথা বলার সময় এসেছে যে ,যদি দলের মধ্যে নিজেকে জাহির করা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির কোন সমস্যা  থেকে থাকে, নির্দোষ নাগরিকদের উপর তার দায় তিনি চাপিয়ে দিতে পারেন না।

যার পক্ষে যুক্তি হাজির করা অসম্ভব, তা হল কংগ্রেস (আই ) দলের যুব শাখার অপরিণত নেতৃত্বের দ্বারা সংঘটিত পূর্ব পরিকল্পিত হিংস্রতা ও রাজ্য কংগ্রেস দলের সম্পূর্ণ অসহায়তা।—–যদি মমতা ব্যানার্জি নিজের পথ সংশোধন না করেন ,তবে তিনি এই কঠোর শিক্ষাই পাবেন যে ,মৃতদেহ কোনমতেই সেই সোপান হতে পারে না, যেখানে পা ফেলে তিনি ক্ষমতার দিকে অথবা যেদিকে যাচ্ছেন বলে তিনি নিজে ভাবেন ,সেই পথে চলে যাবেন ।”২৪ শে জুলাই ‘৯৩ ‘দি হিন্দু ‘ পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়, ‘একটি খারাপ উদ্দেশ্যের আস্ফালন ‘শিরোনামের লেখায় বলেছিলেন, “—–মমতা ব্যানার্জি নিশ্চয়ই জানতেন যে কয়েকহাজার যুবককে নিয়ে গোটা আন্দোলনটিই ভ্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ও তা শান্তিপূর্ণ থাকবে না ।

গন্ডগোল তৈরিতে সদাব্যগ্র  সমাজবিরোধী শক্তিও গুণ্ডারা অবাধ বিচরণের দিন পেয়ে গিয়েছিল এবং তাদের উপর কংগ্রেস নেতাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না ।পুলিশ এমন অনেককেই খুঁজে পেয়েছে যাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট বোমা এমনকি পাইপগান ব্যবহার করেছে ।যেহেতু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, গুলি চালাতে হয ,যার পরিণাম হয় মারাত্মক ।দুরভাগ্যজনকভাবে মমতা ব্যানার্জি মূর্ছা যান এবং তাঁকে  হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় ।মহাকরণের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে নেতৃত্ববিহীন জনতা । পুলিশ যদি দ্রুততার সঙ্গে তৎপর না হতো ,কী যে হতো তা ভালোভাবেই আন্দাজ করা যায় ।যদি ধরেও নেওয়া হয় যে বামফ্রন্ট সরকারের তথাকথিত দুর্বলতা  তুলে ধরার জন্যই মমতা ব্যানার্জি আন্দোলনের কর্মসূচি নিচ্ছেন ,এই জাতীয় বিক্ষোভ সংঘটিত করে তিনি একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছেন।নিজের দলের সম্পূর্ণ সমর্থনও তাঁর পিছনে নেই ।

—-মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস  (আই )সভাপতি সোমেন মিত্রসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দীর্ঘদিনের বিরোধের ঘটনা সুপরিচিত ।মমতা ব্যানার্জি এমনভাবে তাঁর সংগঠন চালাচ্ছেন যেন তা একেবারেই স্বাধীন ।—-মহাকরণ ছাড়াও  বিক্ষোভকারীরা কলকাতা পৌরসভার দপ্তরেও হামলা চালায় ।একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগও রক্ষা পায়নি ।এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিবেকবর্জিত ব্যক্তিদের ছড়ানো হিংসা মোকাবিলা করতে গেলে সরকারের কাছে খুব বিকল্প কিছু খোলা থাকে না ।”*পাওনিযার পত্রিকা ২৩ শে জুলাই ‘৯৩ তারিখে তাদের বিশেষ আলোচনায়  লিখেছিল*, ” সেই একই অপরিণামদর্শিতার পুনঃ প্রদর্শনী হয়ে গেল গত বুধবার, যখন তিনি হাজার হাজার যুব কংগ্রেস কর্মীদের কলকাতা পুলিশের সঙ্গে এক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেন ।দিনের শেষে রেড রোড ও চৌরঙ্গী হয়ে রইলো মমতা ব্যানার্জির দায়িত্বজ্ঞানহীন তার নীরব সাক্ষী ।কলকাতার বুকে যাঁরা যুব কংগ্রেস কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস  (আই)-র ডাকা বনধের দিনগুলোতে, তাঁর সম্ভবত বুধবারের “অ্যাকশন “এ নিহত বা আহত ব্যক্তিদের প্রতি খুব একটা সহানুভূতিশীল হবেন না ।কিন্তু ঘটনা হল, ১৯৭৭ সালের পর থেকে এই প্রথম কলকাতার বুকে একদিনে এতগুলি প্রাণ চলে গেল পুলিশের গুলিতে ।

তবে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে, মমতা ব্যানার্জির অনুগামীরা যে উচ্ছৃঙ্খল ও পরিকল্পনামাফিক তুমুল হিংসায় লিপ্ত হয়েছিলো, তাও এর চাইতে কোনও অংশেই কম নিন্দনীয় নয় ।হঠাৎই সত্তর দশকের সেই দুর্দিনগুলিকে আর সুদূর অতীত বলে বোধ হচ্ছে না । তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠিত হবার পর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন ।কমিশনের জন্য কয়েকলক্ষ টাকা খরচ হয়েছে ।আজ পর্যন্ত কমিশনের রিপোর্ট জানা যায়নি ।কমিশন কি  সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিবেচনার মধ্যে রেখেছেন? ?? (তথ্য সংগৃহীত )তারিখ –৩০৷৬৷২২