ঠিক তিরিশ বছর আগে আজকের দিনেই বাবরি ধ্বংসের ঘটনা। গোটা দেশ দেখলো ধর্মীয় উন্মত্ততার চরম বহিঃপ্রকাশ,”আধি রোটি খায়েঙ্গে মাগার মন্দীর উহাপারই বানায়েঙ্গে”। তারপর থেকেই বামপন্থীরা বিশেষত আমাদের পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী) এই দিনে বিভিন্ন রকম কর্মসূচী নিয়ে থাকে গোটা দেশ জুড়ে।

যখন এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি রাষ্ট্র চালনা করছে তখন আজকের দিনের গুরুত্ব আরও বেশি। এখন রাজনৈতিক ভাবে আরও গভীরে আমাদের ভাবনা চিন্তা করার সময়। কারণ ইতিহাসের পুননির্মাণের নামে ইতিহাস কে ধ্বংসের সম্মুখীন করা হচ্ছে এই সময়ে। অর্থাৎ ইতিহাস বর্তমানে বিকৃতির সম্মুখীন।

আমার লেখার উদ্দেশ্য সেই ইতিহাসের বিকৃতির জায়গাটি কে ধরা।

সহজ কথায় ইতিহাস হল অতীত অনুসন্ধান ও ধারাবাহিক পর্যায়ক্রমিক বিবরণের জীবন্ত দলিল। যার মেরুদণ্ড সত্য ঘটনা। কৌতুহলী মানুষ অতীতকে অনুসন্ধান করেছে নানা প্রমাণ সাক্ষ্যকে ভর করে।  ইতিহাস মনগড়া কোনো থ্রিলার বা ফিকশন নয়। এর উপাদান বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু, নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ, বিভিন্ন গুহাচিত্র, শিলালেখ,স্থাপত্য, ভাস্কর্য্য এবং অবশ্যই লিখিত পুঁথি,দলিল দস্তাবেজ। প্রতিটা উপাদানই বহুমাত্রিক বিশ্লেষক। বহুস্তরীয় ও বহুরৈখিক এই উপাদানগুলিই মানুষের ফেলে আসা সময়, বিবর্তন,সমাজের পট পরিবর্তন কে ব্যখ্যা  করে। সেই সময়ের সমাজ, অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি, লোকসংস্কৃতি, সমাজের শ্রেনীগত ভারসাম্য এবং জীবনাভ্যাস সম্পর্কে ধারণা নির্মাণ করে।

ইতিহাসের অনেক ঘরানা রয়েছে। ইতিহাস কে কেমন ভাবে দেখা হবে অর্থাৎ ঐতিহাসিক পদ্ধতি ঠিক কেমন হবে সেই নিয়ে দায়িত্বশীল ইতিহাসবিদদের মধ্যে খুব সামান্যই মতপার্থক্য রয়েছে। ইতিহাস নির্মাণের প্রথম শর্তই হল “ন্যূনতম আগাম অনুমান”। মানে অতীতের কোনো বিষয় নিয়ে যদি আলোচনা শুরু করতে হয় তাহলে তার সূত্রের কাছে পৌঁছাতে হবে যতটা সম্ভব আগাম অনুমান ছাড়া। দ্বিতীয়ত, যেকোনো ঐতিহাসিক সূত্র সম্পর্কে বিচার বা বিশ্লেষণ করতে হবে অত্যন্ত সমালোচনামূলক হাতিয়ার সঙ্গে নিয়ে। অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে।

যেহেতু ইতিহাসকে সরাসরি দেখা যায় না। ইতিহাস জানতে হলে কালের ধারা অনুসন্ধান করতে হয় তাই স্বাভাবিকভাবেই তা নানা সময় বিকৃত করা হয়। অন্য কোনো একটি এজেন্ডা কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সত্য বিবরণটিকে ভুলভাবে ব্যখ্যা বা অর্ধসত্য ভাবে উপস্থাপনা করা হয়।

আমাদের দেশ ভারতের ইতিহাসের শুরু নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার সময় থেকে। সিন্দু নদ ও তার অববাহিকা অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেই সভ্যতা ছিল সেই অববাহিকার স্থানীয় মানুষদের সভ্যতা।

বর্তমানে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ইতিহাস অন্যতম আলোচনার বিষয়। এবং যেক্ষেত্রে পাইকারি ভাবে মিথ্যার নির্মাণ হচ্ছে। আসলে “হিন্দু” শব্দটাই পারস্য-আরবি শব্দ। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে কেউ নিজেকে হিন্দু বলতো না। এই হিন্দু শব্দটা এসেছে প্রাচীন ইরানীয় “সিন্ধু” শব্দ থেকে। যা আসলে সিন্ধু নদের নাম। এই হিসেবে যারা সিন্ধু নদের কাছে থাকতো তারাই ছিল ওদের কাছে হিন্দু,কারণ গ্রীকরা শব্দের শুরুতে “হ” উহ্য রাখতো। তাই সিন্ধু থেকে হিন্দু।চীনারাও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। যখন হিউ এন সাং “ইন্ত” অথবা “ইন্দু” শব্দটি উচ্চারণ করতেন তখন তিনি লক্ষ্য করেছিলেন ভারতীয়রা তাদের দেশকে ওই নামে চেনে না। কারণ সংস্কৃত ভাষায় ইন্দু শব্দের অর্থ হল চাঁদ। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলাই যায় ভারতীয় দের হিন্দু বলতো কেবল বিদেশীরা। পারস্য দেশের মানুষ এবং আরব থেকে আসা মানুষেরা। সেখান থেকেই এই অর্থ দাঁড় করানো হয় ভারত দেশে যারা বসবাস করে তারা মুসলমান নয়,হিন্দু।

পরবর্তীতে ইরান থেকে আর্যরা এদেশে আসে। পশুপালক আর্যদের ভারতে আসার কারণই ছিল পশুখাদ্য ঘাসের সন্ধান। মূলত এ সময় থেকেই বৈদিক সভ্যতার শুরু। এসময় থেকে ভারতের ইতিহাসে লিখিত ঐতিহাসিক উপাদানের প্রমাণ মেলে। এর আগের ইতিহাসের উপাদান ছিল কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।  এসময়ের লিখিত ইতিহাসে অর্থাৎ বেদে  কোথাও ভারত শব্দটি নেই। তখন এই ভুখন্ডের ধারণা ছিল বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত এবং আর্যরা বিদেশ থেকে এসে এদেশে বসতি স্থাপন করে। এরপর ভারতের সভ্যতার ইতিহাসে আঞ্চলিক বিভিন্ন শক্তির উদ্ভব হয়। ষোড়শ মহাজনপদ। তার ব্যাপ্তি ছিল কাবুল থেকে বিহার অব্ধি। মনুস্মৃতিতে যা আর্যাবর্ত নামে উল্লেখ করা আছে। এর পর ভারতের ইতিহাসে মৌর্য,গুপ্ত যুগ, আবার নানা আঞ্চলিক রাজাদের উত্থানের ঘটনা যুক্ত হয়।

এবং এর পর ইতিহাসের অধ্যায়ে যুক্ত হল সুলতানী যুগ। এবং এই সময় থেকে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়, মুসলিম শাসনাধীন ভারতকে অন্ধকার যুগ বলে। বলা হয়, বিদেশী বিধর্মীরা এদেশে এসে শাসন করে।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, যেকোনো দেশের বা যেকোনো রাজার বা রাজতন্ত্রের কোনো ধর্ম থাকে না। রাজার সাথে প্রজার সম্পর্ক শোষণের এবং রাজস্ব আদায়ের। মানচিত্র ততটাই বিস্তৃত যতটা রাজার তলোয়ার রক্ত ঝরাতে পারত। অর্থাৎ সাম্রাজ্যই ছিল মানচিত্র। এবং হিন্দু রাজা হিন্দু প্রজাকে শোষণ করেনি বা হিন্দু প্রজার থেকে রাজস্ব আদায় করেনি এবং মুসলিম রাজা মুসলিম প্রজাকে শোষণ করেনি বা তার থেকে রাজস্ব আদায় করেনি এই প্রমাণ কোনো যুগেই নেই। রাজা, শাসক ধর্ম নির্বিশেষে শোষণ করেছে।

ভারতের ইতিহাস তিন ধরণের মতামতের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। এক, হিন্দু সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকদের দ্বারা বিকৃত ইতিহাস। যারা বলেন, মুসলিম রাজারা বিদেশ থেকে এসেছেন এবং লুঠপাট করেছে এদেশের সম্পদ। তারপর পালিয়ে গেছে দেশ ছেড়ে বা আরো লুঠ করার জন্য রাজত্ব করেছে। দুই, মুসলিম সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকদের দ্বারা বিকৃত ইতিহাস। তারা বলেন, হিন্দু রাজা  মুসলিম প্রজাদের ধর্মচারণে বাধা দিয়েছে, তাদের ধর্মচ্যুত করেছে।

এই দুই ধারণাকেই তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে দুই ধারণাই আসলে বস্তুনিষ্ঠ উপাদান বিহিন। কেবল মুসলিম রাজারা লুঠ করেনি। প্রতি বছর শিবাজীর মারাঠা সৈনিকরা বাংলা লুঠ করতে আসতে। যাদের প্রাচীন বাংলা লোককথায় বর্গী বলে ডাকা হত। কিংবা আকবরের নবরত্ন এর রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বে ছিল হিন্দুধর্মী টোডরমল যিনি সম অত্যাচার করে হিন্দু মুসলিম দুই প্রজার থেকেই রাজস্ব আদায় করতেন। ঔরঙ্গজেব কে ইতিহাস কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংসকারী হিসাবে মনে রেখেছে। আর ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে ঔরঙ্গজেব আসলে বহু মন্দিরে দানধ্যানও করতেন।  এই ইতিহাস গুলো পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ের উদারমনস্ক, বাম মনস্ক ঐতিহাসিকদের দ্বারা বর্ণিত সত্যভিত্তির ইতিহাস। যা ভারতের ইতিহাসের তৃতীয় চর্চিত ধারণা।

ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে তাকে লালিত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। এতদিন হিন্দু মুসলিম ছিল দুটো ধর্মের নাম। সুকুমারী ভট্টাচার্য এর গ্রন্থে উল্লেখ আছে ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের সত্যমঙ্গল তাম্রলিপ্তে প্রথম হিন্দু শব্দটি একটি ধর্ম এর নাম হিসাবে বর্ণিত আছে। সেই শব্দটি এদেশে ব্রিটিশরা আসার পর বদলে গেল একটি রাজনৈতিক শব্দে-হিন্দুত্ব- যা একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক শব্দ। ভারতের রাজনীতিতে যুক্ত হল হিন্দুত্ব ও ইসলামী।

এখানে আমরা আগেই আলোচনা করলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গর্ভে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ। ইতিহাসে একে communal historiography বলে। ইতিহাসের নির্মাণ সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে।আর এস এস এর জন্মও ব্রিটিশ ভারতে। আর এস এস তার জন্মলগ্ন থেকেই তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো শুরু করেছে। আর এস এস এর মুল কথাই হল ভারত আর্যদের পবিত্র বাসভূমি। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে “আর্য” শব্দ ব্যবহারে RSS এর আপত্তি আছে। কিন্তু যেহেতু তা অস্বীকার করা যায়না।যেহেতু ইন্দো ইওরোপীয় দেরই আর একটা অংশ ইন্দো ইরানীয়রা এবং এই ইতিহাসকে যেহেতু বাতিল করা যায়না,তাই বারংবার এই দেশ থেকেই আর্যদের আবির্ভাব হয়েছিল,এই সত্য নির্মানের চেষ্টা চলছে। যদি এতেও সাফল্য না আসে তখন বলা হচ্ছে আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে বললে ভারতীয় মুনি ঋষী রাজরাজাদের অসম্মান করা হয়। এই আর্যরা ঠিক ততটাই বিদেশী যতটা বাবর বিদেশী। মুসলিম বাবরকে হিন্দু রাজা,রাজপুত রাজা রানা সঙ্ঘ ভারত আক্রমণ করতে আমন্ত্রণ জানায় ইসলাম ইব্রাহিম লোদীকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। মুসলিমরা কেবল এদেশে লুঠ করেনি। বরং এদেশের পরিবহন ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি,রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি, স্থাপত্য ভাস্কর্য সব দিক থেকেই ইসলামী শাসকরা এবং শাসনকাল গুরুত্বপূর্ণ। এসব ইতিহাসকে বিকৃত করে একদিকে আর এস এস হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে তেমনই মুসলিম লিগ তার ইসলামী সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক ভাবেই।

ইতিহাসের বিকৃতি মানেই বিকল্প সত্যের নির্মাণ। যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আসলে ভারতের ইতিহাস বা অতীত মুসলমানদের লুঠপাঠের অতীত, শোষণের অতীত- এই মিথ্যাকে সত্য হিসাবে নির্মানের মাধ্যমে অহিন্দুদের আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে হিন্দুদের হায়ার্কি স্থাপন করা হচ্ছে। হিন্দুদের মধ্যেও আর এস এস বিভেদ করছে। বর্ণ এর ভিত্তিতে। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা উত্তর প্রদেশ বা রাজস্থানে  দলিত বা নম:শুদ্র নিম্ন বর্ণ হিন্দুদের খুন করছে। খুনিও হিন্দু। যাকে খুন করা হচ্ছে সেও হিন্দু। আসলে হিন্দু হিন্দুত্ব বলে আর এস এস সনাতন প্রাচীন ভারতের ধারণার বিকৃতি করে এক উচ্চবর্ণ হিন্দুদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

মোদী জমানায় রোমিলা থাপার একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন,”To question or not to question, that is the question”..অর্থাৎ কি প্রশ্ন করা যাবে আর কি প্রশ্ন করা যাবে না। ঠিক এই মুহূর্তে আমরা এক মতাদর্শগত সংঘাতের মাঝে আছি। এই প্রশ্নে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতেই হবে। আমাদের সংবিধানে একসময় বলা হয়েছিল মিশ্র সংস্কৃতির কথা। এখন তা নিষিদ্ধ শব্দ।আসতে আসতে সিলেবাসের পাতা থেকে জাতীয় আন্দোলন বাদ যেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বিপ্লবী বামপন্থী আন্দোলন। তাই সরাসরি বলা যায় একটা মতাদর্শগত লড়াই শুরু হয়েছে।

এই মতাদর্শগত লড়াই এর ময়দানে দুটো পক্ষ।এক পক্ষে চিরকালীন শাসক গোষ্ঠী যারা,তারা আছে। আর এক পক্ষে আছে শোষিত মানুষ। যারা এই দেশ তৈরি করেছে। তাদের ইতিহাসই মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আদতে লড়াইটা তাদের জন্যই। তাদের জন্যই মোদী-শাহর এই এজেন্ডা কে রুখতে হবে।

লড়াই কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।