স্বাধীনতার পঁচাত্তর। ঘর ঘর তেরঙ্গা অথবা অমৃত মহোৎসব। সেসব না হয় হবে। কিন্ত স্বাধীনতা ঠিক কী? কেমন? কার? কীভাবে? কোন লক্ষ্যে ?
মজার ব্যাপার হোলো স্বাধীনতার আগে, বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের সময়েও এই উত্তর স্পষ্ট ছিলো না। এত এত ইতিহাস বই, এত গবেষণা — কোথাও দেখেছেন কেমন স্বাধীনতা তখনকার নেতৃত্ব চেয়েছিলেন ? স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব ছিলো কংগ্রেসের। কংগ্রেস ছিলো মূলত একটা মঞ্চ। সব ধরণের মতের মানুষ তাতে ছিলেন। ছিলেন কমিউনিস্টরা, সোস্যালিস্টরাও। স্বাধীনতার স্বরুপ নিয়ে তো মতাদর্শগত বিরোধ থাকার কথা ছিলো কমিউনিস্টদের সাথে কংগ্রেসের বাকি অংশের। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের আগে এই সংঘাত তো দেখা যায়নি।


এ এক অদ্ভুত বিষয় নয় কী? ভারতের মতো দেশ — কত ভাষা, ধর্ম, শ্রমিক কৃষক জমিদার জোতদার, নব্য পূঁজিপতি, মধ্যবিত্ত — সব ধরণের স্বার্থ আছে। সব অংশের মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। পরস্পর বিরোধী স্বার্থ রয়েছে। তবু স্বাধীন দেশ কেমন হবে, তার অর্থ ব্যবস্থা কেমন হবে, কী হবে তার অভিমুখ– তা নিয়ে কোনও বিরোধ নেই? এটাইতো মতাদর্শগত বিরোধ। অথচ গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনে শেষের দু এক বছর ছাড়া সেই মতাদর্শগত বিরোধ দেখাই গেলো না। তাহলে কী কমিউনিস্ট এবং অ-কমিউনিস্ট সবাই এই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন ?
স্বাধীনতা আন্দোলনে বাস্তবে একটাই মতাদর্শ কাজ করেছে। তা হোলো জাতীয়তাবাদ। যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতাই তার লক্ষ্য ছিলো। সব কর্মসূচির বৈধতা এর ভিত্তিতেই স্থির হতো। স্বাধীনতা অর্জন অবধি অন্য সব প্রশ্ন, স্বাধীন দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামো কেমন হবে — সব কিছু মুলতুবি ছিলো। এমনকি দেশভাগ মেনে নিয়েও যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতাই আমরা মেনে নিলাম।


বিরোধ ছিলো। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ,বাইরে। নরমপন্থি চরমপন্থি বিরোধ, অহিংস ও সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধ, গান্ধী সুভাষ বিরোধ। কিন্ত লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এই বিরোধ কোনও মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে ছিলো না। এই বিরোধ ছিলো স্বাধীনতা অর্জনের পথ নিয়ে– এখানে কোনও মতাদর্শগত বিরোধ ছিলো না।
একমাত্র কমিউনিস্টরা এই মতাদর্শগত প্রশ্ন ও সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্ত নানা কারণে তাঁরা সেটা পারেননি। বস্তুত ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে গত শতকের দ্বিতীয় দশকে। কিন্ত গড়ে ওঠার কিছুদিন পর থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতা আন্দোলনে মতাদর্শের কথা সামনে আনতে থাকে। তারাই প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেন। পরে কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবি গৃহীত হয়।


এখানে বুঝতে হবে স্বাধীনতা আর পূর্ণ স্বরাজের মধ্যে পার্থক্য আছে। কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের কথা অধিবেশনে গ্রহণ করলেও, তা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
কমিউনিস্টদের সামনে পরিস্থিতি তখন সহজ ছিলো না। কারণ– ১)আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অস্বীকার করা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সম্ভব ছিলো না সেই সময়ে।
পৃথিবীতে তখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আন্তর্জাতিক স্তরে কমিউনিস্টদের ডাক ছিলো , পৃথিবীর স্বার্থেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলা। এর ফলে কমিউনিস্টদের পক্ষে স্বতন্ত্র মতাদর্শের ভিত্তিতে কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না।


২) কংগ্রেসের বিকল্প মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার মতো শক্তিও কমিউনিস্টদের তখন ছিলো না। তাঁদের প্রভাব ছিলো কিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
৩) চশ্লিশের দশক থেকে কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিকল্প মতাদর্শ তুলে ধরতে চেষ্টা করে এবং সেই ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে। শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করে। কিন্ত এটাও সীমাবদ্ধ ছিলো। এমনকি ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭ সালেও স্বাধীনতার স্বরুপ নিয়ে কিছুটা দোদ্যুল্যমানতা ছিলো কমিউনিস্টদের। এর কারণ রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জন হয় ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে। এ ছিলো পৃথিবীতে নজিরবিহীন ঘটনা। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে — এমন অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে ছিলো না — কমিউনিস্টদের কাছেও তা ছিলো নজিরবিহীন। ওই সময়ে বিকাশমান ব্যবস্থার শ্রেণি চরিত্র নির্ধারন করে কর্মসূচি গ্রহণ করা ছিলো কঠিন।


কিন্ত এর অর্থ এই নয় যে কমিউনিস্টরা মতাদর্শগত বিষয়কে উপেক্ষা করেছে। বস্তুত, কমিউনিস্ট পার্টির কাছে ক্রমশ কংগ্রেসের শ্রেণি চরিত্র স্পষ্ট হতে থাকে। কংগ্রেস ক্রমশ স্বাধীনতা আন্দোলনের মঞ্চ থেকে শাসক দলের চরিত্র নিতে শুরু করে। ১৯৩৭ সালে বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার ভূমিকা থেকেও স্পষ্ট হতে থাকে কংগ্রেসের শ্রেণি চরিত্র। ওইসব প্রদেশে বিকল্প শাসন পদ্ধতির বদলে ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকেই অনুসরণ করতে থাকে। এমনকি গণঅন্দলোনের উপর বৃটিশদের মতোই দমনপীড়ন চালায়।
চল্লিশের দশক থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে কংগ্রেসের উপর। সামনে আসতে থাকে মতাদর্শগত প্রশ্ন, যা স্বাধীন ভারতে আর্থ সামাজিক কাঠামো কেমন হবে, শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ শোষণণুক্ত ব্যবস্থা পাবে কিনা — এইসব প্রশ্ন দূর্বলভাবে হোলেও সামনে আসতে থাকে কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে।


চল্লিশের দশক থেকেই কমিউনিস্টরা বিকল্প পথের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৪৫ সালের শেষ অবধি কমিউনিস্ট পার্টি মতাদর্শের সংগ্রামেও রাজনৈতিক মুক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্ত কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের থেকে ভিন্ন পথে জঙ্গি আন্দোলনের দিকে জোর দিতে থাকে। কমিউনিস্টরা মনে করতো ইংরেজ শাসনের অন্যতম ভিত্তি পুলিশ এবং রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে থাকা ভারতীয়দের ক্ষোভ অসন্তোষকে ব্যবহার করা দরকার। তার সাথেই আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলন, নৌ বিদ্রোহে শ্রমিকশ্রেণির উত্থানকে ভিত্তি করে ব্যাপক জঙ্গি আন্দোলন সংঘঠিত করা যেতে পারে বলে তারা মনে করতো। এখানেই কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের শ্রেণি চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। এই দুই অংশের জাতীয়তাবাদী নেতারা জঙ্গি আন্দোলনকে ভয় পেতে শুরু করে। এমনকি বিদেশী শাসনের থেকেও তাদের কাছে কমিউনিস্টদের এই জঙ্গি আন্দোলন ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। বস্তুত কংগ্রেস বুঝতে পারে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি আন্দোলন সফল হোলে, (যা সেই সময়ে সম্ভব হতে পারতো) এই সংগ্রাম শোষনমুক্তির সংগ্রামে রুপান্তরিত হবে।


১৯৪৫ সালে কংগ্রেস কমিউনিস্টদের বহিষ্কৃত করে। কারণ হিসেবে তারা বলেছিলো ভারত ছাড়ো এবং করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে কর্মসূচিতে কমিউনিস্টরা অংশগ্রহণ করেনি। কিন্ত বাস্তবে যে নেতৃত্ব এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলো, তারা কেউই সামনে থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়নি। যারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো, তারা কংগ্রেসের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ক্রমশ জঙ্গি আন্দোলনের পথে গিয়েছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি সেই সময়ে জন বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জনযুদ্ধের লাইন নিলো।


এখানে মনে রাখতে হবে ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটে, সোভিয়েত এক বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ দেশে দেশে ছড়াতে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি এবার স্বতন্ত্র কর্মসূচি নিতে শুরু করে। সামনে আসে স্বাধীন ভারতে আর্থ সামাজিক কাঠামো কেমন হবে, শ্রমিক কৃষক মেহনতির পক্ষে এই স্বাধীনতা হবে কিনা — এইসব বিষয়। যদিও মনে রাখতে হবে এই সময়েও কমিউনিস্ট পার্টি দূর্বল, তাদের প্রভাব কিছু অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
১৯৪৬ থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি মতাদর্শগত বিষয়কে সামনে রেখেই গড়ে তুলতে থাকে জঙ্গি আন্দোলন। তেভাগা, তেলেঙ্গনার আন্দোলন, কেরলের কৃষক বিদ্রোহ, ডাক ও তার বিভাগে সর্বভারতীয় ধর্মঘট, বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক ধর্মঘট, ছাত্র যুবদের স্বতন্ত্র বিশাল আন্দোলন– কমিউনিস্টদের এই পর্বের অভিমুখ। দেশব্যাপী এর বিস্তৃতি না থাকলেও, স্বাধীনতা আন্দোলনে মতাদর্শগত সংঘাতের শুরু এখান থেকেই। শাসনমুক্তির সংগ্রাম কমিউনিস্টরা শোষণণুক্তির সংগ্রামে পরিনত করার চেষ্টা শুরু করলো।


কিন্ত দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর শোষণণুক্তির সংগ্রামকে অমীমাংসিত রাখে।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসেই ক্ষমতা হস্তান্তর আর শাসক কংগ্রেসকে নিয়ে, নতুন অবস্থার মৌলিক পরিচয় উত্থাপন করে। আপোষ ক্ষমতা হস্তান্তরের এই প্রক্রিয়া ভারতের জনগনের মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করে দেয় বলে কমিউনিস্ট পার্টি স্পষ্ট অভিমত জানায়। তবে স্বাধীনতা সম্পর্কে মূল্যায়নে সেই সময়ে কিছুটা ভুল কমিউনিস্ট পার্টি করেছিলো, তা অস্বীকার তারাও করেন না। “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়” শ্লোগান সেই সময়েরই। কিন্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো ভারত পেয়েইছে। তাছাড়া স্বাধীনতা নিয়ে তখন ভারতে গণ উন্মাদনা। ফলে কমিউনিস্টদের এই শ্লোগান জনপ্রিয় হওয়ার পরিবর্তে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো।


কিন্ত মৌলিক প্রশ্নটা তো রয়েই গেছে। কমিউনিস্টদের কাছে তাই এই সংগ্রাম অসমাপ্ত সংগ্রাম। এখনও তো ক্ষুধা থেকে আজাদি, বেকারী থেকে আজাদি সত্যিই আসেনি। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি অবশ্যই এসেছে– কিন্ত আসেনি শোষণ থেকে মুক্তি।


মতাদর্শগত লড়াই তাই মূলত স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই শুরু বলা যায়। সে সংগ্রাম চলছে। কীভাবে, কোন পথে সেই আলোচনার সুযোগ এই নিবন্ধে নেই। পরবর্তী সময়ে সেই আলোচনা করার সুযোগ এলে করা যাবে।