“ছিলাম খাঁচায়, বসিয়াছি দাঁড়ে। পায়ের শিকল কাটিল না।” (রবীন্দ্রনাথ)

ঝাঁ চকচকে মেন রাস্তা থেকে ডানদিকে বেকে একটু এগোলেই যে রুক্ষ মাঠটা ছিল জালোর জেলার সুরানা গ্রামে, সেটা একটু একটু সবুজ হয় বছরের এই সময়টা, তার ঠিক পাশের স্কুলবাড়িটা। প্রাইভেট স্কুল। তেমন আহামরি দড় কিছু না। আর পাঁচটা স্কুলের মতই। কিন্তু গোটা দেশের অজানা ছিল এই স্কুলেই রয়ে গেছেন এক ভীষণ দড় ভাবনার একখানি “সমাজের/জাতির মেরুদণ্ড”। মেরুদণ্ডখানি কড়া হতে হতে এমনি হয়ে গেছেন যে ঘাড় শুদ্ধ দেহ এদিকওদিক আর হয় না – সেই শিক্ষকের নাম চাইল সিং। আর সেই ভীষণরকমের শিক্ষিকের পাল্লায় পরে গেল “স্বাধীন” ভারতের ইন্দ্র মেঘওয়াল। মাত্র ন’বছর বয়েস ছিল জানেন। মানে ন’বছর ধরে উইদাউট পারমিশন জন্মেছে তো বটেই, দেশের আলো জল খাবার শ্বাস নিয়ে নিয়ে নটা বছর আগাছার মত বাড়তে বাড়তে এতটা বেড়ে গেছে যে “স্যারেদের” জগ থেকে একঢোক জল খেয়ে ফেলেছিল গত ২০ জুলাই। চাইল সিং স্যার তখন মারতে শুরু করেন তাকে, মারতেই থাকেন, মারতেই থাকেন, মার চলতেই থাকে। “ইন্দর” শুরুতে “এইসা কাদেই নেহি হোগা স্যাডজি” বলেছিল, তারপর আর বলতে পারছিল না, হাপ লাগছিল, আশপাশের ক্লাসরুমটায় হলুদ বলের মত কত কি দৌড়ে বেড়াচ্ছিল যেন চোখের সামনে, সেগুলো ধীরে ধীরে কালো বল হয়ে বড় বড় হতে লাগল, তারপর ক্লাসরুম, করিডোর, স্কুলবাড়ি, স্যার, স্যারের হাতের বেত সব কালো হয়ে গেল মার কিন্তু চলতে লাগল। অনেকক্ষণ নড়ছে না দেখে সন্দেহ হয় সিং জির। মটকা মেরে পরে আছে মারের ভয়ে নির্ঘাত, তারপরেও মার। কিন্তু সাড়া মেলে না আর। কেজানে হয়ত বা চোখে লংকা গুড়ো দিয়ে দেখাও হয়েছিল তারপর সত্যি ভান করছে কিনা। তারপর অন্য লোকজন জাগাতে এলে পর কত কি হয়ে যায়। ১৩ই আগস্ট রাতে আমেদাবাদ হাসপাতালে আবার ইন্দরের খুব ফোলা ফোলা চোখ দুটো একবার খুলেই বুজে নিয়েছে। আর খুলবে না। এত বাজে চারপাশটা দেখতে ইচ্ছে করছে না তার আর। জন্মের মত তার তৃষ্ণা মিটে গেছে৷ স্যার ছাত্রখুনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন। আমাদের ট্যাক্স এর পয়সায় তারিখ পে তারিখ বিচার চলবে।

সব স্কুলের মত তার স্কুলেও স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে আজ। পতাকা উঠছে৷

এমন শিশু বৃদ্ধ মহিলা অসংখ্য হত্যা চলে যাচ্ছে রোজ, খবর আর হচ্ছে কটা।

জাতের কারণে, ধর্মের কারণে, মুক্তচিন্তার কথা বিজ্ঞানের কথা বলার কারণে, মেয়ে হওয়ার কারণে, অকারণে খুন হচ্ছে শুধু মানুষই না চিন্তাভাবনা, প্রতিবাদের ভাষা।

হর ঘর পে তেরেঙ্গা উঠবে না কেন, ভালোই তো লাগে জাতীয় পতাকা ওড়াতে। কথা হল – ঘর কই! এতগুলো ঘরহীন মানুষ যেখানে আকাশের নীচে , ফুটপাতে রাত কাটায় সেখানে এব্যবস্থা করা যাবে কিকরে সবার জন্য। এত অপুষ্টি, অশিক্ষা, রোগ-মারি-মড়ক, লোকক্ষয়, হিংসা, লুটমার, খুন, নির্যাতনমাখা ছত্রাকার একটা দেশ, “আমার দেশ নয়” বলে পাশ কাটাই না, “এখানে ফুল ফোটানোর কাজ নি”। এদেশে নিশ্চিত পূর্নস্বরাজ এসেছে বিরাট আন্দোলন,প্রদেশে প্রদেশে অসংখ্য জীবনদান , স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে।


কিন্তু তা বড় বেশি করে পয়সাওয়ালাদের বা তার ভাইবোন – প্রতিপত্তিশীল, ক্ষমতাবানদের হয়ে রয়ে গেছে, ইন্দরদের পাড়া দিয়ে সে বড় একটা আসে না, তাদের ছায়া বাঁচিয়েই চলে। ইন্দরদেরও সাধ যায় তাকে দেখতে, হাতের তালুতে ছুতে, গায়ে মাখতে, তবে তা যে ঘটে এমনটা নয়। আসলে এত ঢক্কানিনাদ, ফুলমালা, হইহই চারপাশে যে স্বরাজের আর ইন্দরের কথা ভাবার সময় থাকে না। আম্বেদকারের বইয়ে ফুলমালা চড়ে, ভোট আসে সেখানেও বিত্তবানদের বাজনায় কান পাতা দায়। ভোট যায়, আবার স্কুলে স্কুলে আলাদা জলের জগ রাখা হয়।
তবে স্বাধীন ভাবে ফুরিয়ে যাওয়ার অধিকার ই একমাত্র সম্বল ইন্দরদের এটা হতে না দেওয়ার লড়াই জাড়ি আছে। মারের ভয়ে জনগন গাইবার, পান করার জল ইচ্ছেমত খাবার, যে কোন প্রদেশে আইনানুগ ভাবে নিরাপত্তার সাথে বাস করার অধিকারের লড়াই চলছে। একটা ইন্দরকে লড়াই শুরুর আগে শেষ করে ফেলা হল, দেশ জুড়ে কয়েক লাখ ইন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের উঠোনে ঝকঝকে রোদ্দুর মেখে তেরেঙ্গা উঠবে আগামীতে।

পৃথা তা