সলিল চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামী।
তিনি নিজে এমন দাবি করেননি। সচরাচর কেউ বলেন না। কারন — সংগ্রামে সৃষ্টির অবদান সমাদৃত হলেও শিল্পীর স্বীকৃতি অনেকটাই অনুচ্চারিত থাকে। অন্তত আমাদের দেশে। আমাদের মগজের ডিকশনারিতে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ মানে গান্ধী, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র, মহিলা তথা গণ আন্দোলন।
কিন্তু এই সবকটি উপাদানে জড়িয়ে আছে গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস। এবং এই ক্ষেত্রে যা বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, তা হল — জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে গান, কবিতা, নাটককে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি।
গান ছিল সংগঠক। হ্যাঁ, সংগঠক। অনবদ্য সংগঠক।
উদাহরণ? সলিল চৌধুরীর জীবন।


আসুন — আমরা ১৯৪৬-এ পৌঁছোই।
অবিভক্ত দেশজুড়ে রেল ধর্মঘটের ডাক। বামপন্থীদের। দেশ দাঙ্গার মুখে দাঁড়িয়ে। সলিল চৌধুরীর কথায়,‘‘কমরেড বীরেশ মিশ্র আমায় ডেকে পাঠালেন। গোাটা উত্তরবঙ্গ থেকে সারা আসাম উনি পরিক্রমা করবেন বিভিন্ন স্টেশনে রেলশ্রমিকদের মিটিং করে করে। আমাকে সঙ্গী হতে বললেন, প্রত্যেক মিটিং-এর আগে রেলশ্রমিকদের সংগ্রামের ওপর গান লিখে আমায় গাইতে হবে। একটা ইঞ্জিনের লাগোয়া বগিতে চেপে শুরু হল বীরেশদার সঙ্গে আমার যাত্রা। সাথী শুধু আমার সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম।’’
প্রত্যেক স্টেশনে সেই ‘সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম’ কাঁধে নিজের লেখা গান গেয়েছেন সলিল চৌধুরী। তাঁর কথায়,‘‘সেসবও কোথায় লুপ্ত হয়ে গেছে, বেঁচে আছে শুধু একটি গান। চলন্ত রেলগাড়ির চাকার শব্দের ছন্দে রচিত…’’
কোন্‌ সে গান, যা রেলের চাকার শব্দের ছন্দ থেকে জনকল্লোলে পরিণত হয়েছে? হয়েছে কালান্তর?
‘ঢেউ উঠছে/কারা টুটছে/ আলো ফুটছে/ প্রাণ জাগছে, জাগছে, জাগছে’ — হল সেই গানটি।
১৯৪৬-র ২৯ জুলাই সারা দেশব্যাপী ধর্মঘটের ঠিক আগের দিন ময়দানে বিশাল সমাবেশে গানটি গাওয়া হয়েছিল — ‘‘শোষণের চাকা আর ঘুরবে না ঘুরবে না/ চিমনিতে কালো ধোঁয়া উঠবে না উঠবে না/ বয়লারে চিতা আর জ্বলবে না জ্বলবে না…./ আজ হরতাল, আজ চাকা বন্‌ধ..’’
এই গান যদি পরাধীন ভারতে মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত গণ আন্দোলনের ধারার সংগঠক না হয়, যদি এই গানের লেখক, সুরকার স্বাধীনতা সংগ্রামী না হন — তাহলে ভারতে স্বাধীনতার কোনও সংগ্রামই হয়নি!
১৯৪০-’৪১-এ সলিল চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। রংপুরে ছাত্র আন্দোলনের সম্মেলনে গান গেয়েছেন তিনি। সে গানেও লড়াইয়ের কথা। কিন্তু তার বেশ কিছুদিন আগে সলিলের সঙ্গে একজনের পরিচয় হয়। তিনি বেশ ভালোবাসতেন সলিলকে। সেই ব্যক্তি বলেছিলেন,‘‘সলিল তুমি শুধু গান লিখে যাও — যা মনে আসবে তাই নিয়ে গান গান লেখো, সুর করো।’’ অর্থাৎ সবসময়েই লড়াইয়ের গান, যন্ত্রণার গান লিখতে হবে — তা নয়। যা মনে আসবে লেখো, সুর করো, গাও। একজন শিল্পীকে চেনা এবং তাঁকে সৃজনশীলতায় অনুপ্রাণিত করার এর থেকে সঠিক এবং প্রসারিত ভাবনা হয় না।
কিন্তু স্বাভাবিক প্রশ্ন — লোকটি কে?


লোকটি এক বিস্ময়। ছিলেন শ্রমিক সংগঠক। কিন্তু কারখানার গেটে সভার আগে নিজের পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গান গাইতেন। তারপর বক্তব্য। রাজশাহী জেলার নাটোরে এক গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম তাঁর। ১৯০৭-এ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৩২-এ উত্তরবঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সংগঠক হওয়ার ‘অপরাধে’ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হল। তার মধ্যে এমএ পাশ করা। সেই লোকটিকেই ১৯৩৬-এ দেখা যাচ্ছে বর্ধমানের কয়লাখনি অঞ্চলে। তখন কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য। যদিও মার্কসবাদে ততদিনে অনুপ্রাণিত। বাঁকুড়ার মেজিয়ায় ‘কৃষক সংগ্রাম সমিতি’-র সংগঠক তিনি। পশ্চিম বর্ধমানের হীরাপুরে কৃষক আন্দোলনের নেতা — তিনিই। পরবর্তীকালে সেই তাঁকেই পাওয়া যাচ্ছে অবিভক্ত ২৪ পরগনায় — বসিরহাট থেকে কাকদ্য়ীপের কৃষক সংগ্রামে।


আশ্চর্য লাইফ-রুট! উপন্যাসের মত — মহাকাব্যিক জীবন একেই বলে।
মন্বন্তরে আছেন রিলিফের কাজে। বন্যায় আছেন উদ্ধারকার্যে।আবার কুষ্ঠিয়ার মোহিনী কটন মিল থেকে মেটিয়াবুরুজের কারখানার গেটেও তিনি হাজির। ১৯৩৪-এ ডক শ্রমিকদের ধর্মঘটের অন্যতম সংগঠক — তিনিই। রানীগঞ্জের কাগজকলের ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতাও তিনি। সঙ্গে কমরেড বিনয় চৌধুরী এবং অন্যান্যরা। গ্রেপ্তার হন তিনি। ৩ মাস রাখা হয় আসানসোল জেলে। ১৯৩৯-এ তাঁকে বর্ধমান থেকে ব্রিটিশ সরকার বহিষ্কার করে। চলে আসেন ২৪ পরগনায় — পার্টির নির্দেশে।
সেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে পায়ে ঘুঙুর বাঁধা। পাঞ্জাবীটা কোমরে ধুতির শক্ত গাঁটে বাঁধা। কারখানাগুলি থেকে শ্রমিকরা বেরোচ্ছেন। শুরু হচ্ছেতাঁর প্রায় নেচে নেচে গান। ক্লান্ত, রিক্ত শ্রমিকরা জড়ো হচ্ছেন তাঁর কাছে। একসময় গান থামছে। পা স্থির। ঘুঙুর বিশ্রাম নিচ্ছে। শুরু হচ্ছে বক্তব্য — শ্রেণী সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার লড়াই মিশে যাচ্ছে তাঁর বাক্যে বাক্যে।
১৯৪২-এ মেটিয়াবুরুজে সিপিআই-র ২৪ পরগনার প্রথম সম্মেলন। পার্টির শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার সেই উদ্যোগে প্রভাস রায়, সত্যনারায়ণ চ্যাটার্জি, অমূল্য সেনের সঙ্গেই সেই লোকটির ভূমিকা অবিস্মরণিয়।


কে তিনি? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষকদের সংগঠিত আন্দোলনের ধারায় অবিচল স্বাধীনতা সংগ্রামী কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী।


তিনিই সলিল চৌধুরীকে গান বাঁধতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বলেছিলেন,‘‘সলিল তুমি শুধু গান লিখে যাও — যা মনে আসবে তাই নিয়ে গান গান লেখো, সুর করো।’’ তিনিই মেটিয়াবুরুজ ক্লাইভ জুট মিলের শ্রমিক, দক্ষিণপন্থী শ্রমিক সংগঠনের কর্মী গুরুদাস পালকে পরিণত করেছিলেন ‘সংগ্রামী সনাতন কবিয়াল’-এ।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকারদের সংগঠিত করার উদ্যোগ দেখিয়েছিল কমিউনিস্টরাই। তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে গণনাট্য, লেখক শিল্পী সঙ্ঘের মত সংগঠনগুলির ইতিহাসে। তার বিস্তৃত বিবরণে যাবো না। শুধু হৃদয়ে খুব যত্নে অধিষ্টিত এক সাহিত্যিকের কথা উল্লেখ করব।


বিশিষ্ট কমিউনিস্ট সংগঠক, প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিজীবী চিন্মোহন সেহানবীশ জানাচ্ছেন যে, ১৯৪৫-এর মার্চে মহম্মদ আলি পার্কে ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক সঙ্ঘ’ একটি সম্মেলন আয়োজন করে। লেখকদের সম্মেলন। সেই সম্মেলনের অন্যতম সভাপতি হিসাবে ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।


সভাপতির ভাষণের শেষপর্বে ‘গণদেবতা’র স্রষ্টা বলে ওঠেন,‘‘দেশের গণচেতনায় নব স্পন্দন সূচিত হচ্ছে। মূহ্যমান আশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কোটি কোটি মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় অধিকারে নূতন স্তরে উঠে এসে এক অভূতপূর্ব গণমিছিলে অভিযানের স্বপ্ন দেখছে। বাঙলার কৃষক, বাঙলার শ্রমিক, বাঙলার শিক্ষিত অশিক্ষিত জনসাধারনের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে নবজীবনের পথে যাত্রা করবে। তার জীবনরূপ, তার কথা, তার কাহিনী বাঙালী সাহিত্যিক রচনা করবে বৈকি। সময় আসছে, সময় হয়েছে, বাঙালী সাহিত্যিকবৃন্দকে আমিও আহ্বান জানাচ্ছি — রচনা কর, রচনা কর নবজীবনের গান।’’


নবজীবনের গান! অর্থাৎ নতুন সমাজের আবাহন। যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্ন — স্বাধীন, সার্বভৌম স্বদেশ নিয়ে।