প্রশান্ত কিশোর মোদী থেকে মমতাকে উদ্বৃত্ত বুদ্ধি বিক্রী করেছেন। মোদী ও মমতা দুজনেই তৃতীয়বারের মত মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি ফেরৎ পেয়েছেন শকুনির পাশার চালে। দিদিকে বলো, দুয়ারে সরকার থেকে লক্ষ্মী ভান্ডার পিকের ভেল্কি। ২১এ দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্ফোরণ না হলেও রুগীকে কড়া মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া বাঁচানো যেত না। সেই দাওয়াটাই ‘লক্ষ্মী ভান্ডার’। মোট ৩.৬২ কোটি মহিলা ভোটারের মধ্যে ২৫-৬০ বছর বয়সী মহিলার সংখ্যা খুব বেশী হলে ৩ কোটি। তাদের মধ্যে ২ কোটি লক্ষ্মীর জন্য বছরে খরচ ২০ হাজার কোটি- এটা লোক দেখানো মোড়ক মাত্র। দুই-তৃতীয়াংশ মহিলার রোজগার নেই, দানপ্রার্থী। সেই প্রশান্ত কিশোর বিহারে “জন সূরজ” নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে মা, বোনদের বললেন, কখনও প্রতারক রাজনীতিবিদের ফাঁদে পড়ে পাঁচশ বা হাজার টাকার বিনিময়ে নিজের ভোট এবং ইজ্জত বিক্রী করবেন না। খল রাজনীতিবিদরা ভয়ানক ফাঁদ পাতবে। বাংলায় যা পাঁচশ টাকা ছিল, গোয়ায় গিয়ে পাঁচ হাজার টাকার ফাঁদ। নীলকর সাহবদের দাদনে কৃষককে বেঁধে, সর্বশান্ত করার ইতিহাস সবাই জানেন।

গল্পটা লক্ষ্মী ভান্ডারে শেষ নয়, বরঞ্চ সেখানে শুরু। শিকড় গেছে চিংড়ি চাষের নোনা ভেড়ির মাঝে রাতের আলাঘরে। সন্দেশখালিতে যেটা আলাঘর বা মাননীয়ার ছবি টাঙানো পার্টি অফিস, বলাগড় বা ভাঙড়ে সেটাই রাতের রিমঝিম রিসর্ট। মুখ্যমন্ত্রী থেকে সুশীল, পুলিশ থেকে জুতো পালিশ, নেতা থেকে জুতোর ফিতা, এমনকি প্রশাসন থেকে দুঃশাসন, তৃণমূলের সবাই জানতেন। একটা রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ ২৫-৬০ বছরের মহিলা মাসে মাত্র পাঁচশ টাকার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবেন কেন? তাঁদের কর্মক্ষম পিতা, স্বামী, সন্তান নেই? প্রথমতঃ লক্ষ্মী ভান্ডারের সাফল্য নির্ভর করবে, কর্মহীন দারিদ্রের উপর। বিগত ১৩ বছরে রাজ্যে বিনিয়োগ নেই, নতুন বৃহৎ উদ্যোগ নেই। বেসরকারী শিল্প বলতে মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন, চপ ভাজা, ঘুগনী শিল্প। অভিরূপ সরকার বা সুগত মার্জিতরাও তাই বোঝান। সরকারী ক্ষেত্রে অপরিহার্য নিয়োগ চড়া মূল্যে বিক্রী হয় নয়ত ঠিকা শ্রমিক দিয়ে চালায়। এর পর পায়ের নিচের জমিটা কেড়ে নিলে, কিংবা চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে চিংড়ির ভেড়ি করলে মহিলারা লক্ষ্মী ভান্ডারী হতে বাধ্য হবেন।

প্রোডাক্ট বাজারে নামালেই হল না, মার্কেটিংটাও দরকার। হোম ওয়ার্ক দরকার। ভূমি সংস্কারে যে দরিদ্র কৃষক জমির পাট্টা পেয়েছিলেন, সে জমি লুন্ঠিত হলে জনগন রাজ্যের কোথাও সুরাহা পাবেন না। থানার বড়বাবু থেকে পঞ্চায়েত সদস্য, ব্লক ল্যান্ড রেকর্ড অফিসের আধিকারিকরা মিলিত ভাবে মালিকের নাম থেকে জমির চরিত্র রাতারাতি বদলে দেবে। জানাজানি রুখতে বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত লুঠে নিতে হবে পিসিপ্রিয় নির্বাচন কমিশনার ও নরেন্দ্র মোদীকে দিয়ে। যদি কেউ বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখায় তবে লাশ ভাসবে তেখালির গাঙে। বামেদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। এমনকি ধর্ম-দলের ক্যারিওকর্তাদের চোখে গুলি করে ভাসিয়ে দেয় শেখ শাহজাহানেরা। নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহরা চোখে দেখতে পান না। বাংলা থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে রুজি রুটির সন্ধানে বেহদিশ হয়ে গেছে। ভিটায় আছে নিরন্ন পরিবার। ভাতের হাড়ি পৃথক হলেই অধিক অর্থের প্রয়োজন। তদুপরি আছে ধর্মকর্মে বাড়িতে যাতায়াতের খরচ। সেই সব বাড়ির মহিলারাও বাধ্য হয়ে লক্ষ্মী ভান্ডারের কাস্টমার হয়ে যান।

স্টিভ জোবস যখন অ্যাপেল ফোন বাজারে এনেছিলেন, তখন অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, এত দাম দিয়ে খদ্দের কেন কিনবেন? স্টিভ জোবস তখন বলেছিলেন, মার্কেটিং প্রয়োজন সৃষ্টি করে দেবে। ঠিক সেরকম, প্রথমটায় শুনে মনে হয়েছিল, মাত্র পাঁচশ টাকায় মানুষ কিনে ফেলা যায়? আপনি টাকার অঙ্কটা দেখলেন, কিন্তু প্রয়োজনের প্যারামিটারটাও যে বদল করা যায়, সেটা ভাবেননি। প্রশান্ত কিশোর মমতাকে বোঝাতে পেরেছিলেন, মহিলার মেধাবী সন্তানের বসন্তগুলিকে চপ ভাজার গল্প শুনিয়ে রোদে ভেজে দিলে সব মহিলাই লক্ষ্মী-ভান্ডারী হয়ে যেতে বাধ্য। সব সন্তান মেধাবী হয় না। তাদের বোম বাঁধতে শিখিয়ে দাও। যদি কোন বিধায়ক ভাল বোম বাঁধতে পারে, তাকে প্রশাসনিক সভা থেকে সংবর্ধনা দিন। এই ভাবে নতুন বাজারের প্রচার হবে। মাকড়সা কীভাবে শিকার বেঁধে ফেলে দেখেছেন? কয়েকটা কেস দিয়ে বেঁধে ফেলুন। সেই সন্তানই অনুপ্রেরণায় সিবিআই, ইডি, এনআইএর আধিকারিকদের পেটাবে। এর চোখেও স্বপ্ন। তত দিনে অপদার্থ কুঁড়ি ফোটা ক্রিমিনাল, আলাঘরের আলোর প্রতিবিম্ব দেখে ফেলেছে।

অটোমান বা মোগল যুগে শাহজাদাদের নজর থাকত বাপদাদার হারেমের হারামিতে। সবাই পৌঁছাবে না, শক্তিশালীরা যাবে। সব সুশীল, নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসনিক কর্তা, সাংবাদিক থেকে হুব্বারা চটি চাটতে শুরু করবে। ভদ্রঘরের সন্তানরা হয় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে যৌবন পুড়িয়ে ফেলবে, নয়ত ভিনরাজ্যে কম উপার্জনে বাঁচতে বাধ্য হবে। নয়ত তৃণমূলের দুষ্কৃতি হয়ে ফাঁসে জড়িয়ে যেতে হবে, যাতে আধ ঘন্টায় অপরাধীরা ব্যাপক জমায়েত করতে পারে। এমনকি ভদ্র ঘরের সন্তানরা ইস্কুলে প্রকৃত শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শিখে স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করতে পারবে না। লক্ষ্মী ভান্ডারের পটভূমি প্রস্তুত না করলে প্রকল্প সুফল দেবে না। সরকার কয়েক শত প্রকল্পের নাম নামতার মত পড়বে। একশ দিনের কাজ হোক বা আবাস প্রকল্পের সম্পূর্ণ প্রাপ্য দরিদ্র পাবেন না। রাস্তা টিঁকবে না, জলের কল আসলেও জল আসবে না। দরিদ্ররা কাটমানি দিয়েও তৃণমূলের নেতাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। সুযোগটা নেবে শাসক দল। যে গরীবের ঘরে সন্ধ্যায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলত, তাঁর ঘরে আর চূলা জ্বলার কোন রসদ থাকবে না।

প্রশান্ত কিশোর যে রোডম্যাপ এঁকেছেন, সেখানে লক্ষ্মী ভান্ডারের সম্পূর্ণ প্যাকেজ ছিল। সেই প্যাকেজ সম্পর্কে আজ পিকে সতর্ক করে দিচ্ছেন নিজের রাজনৈতিক দলের কর্মীদের। ছোট বড় নেতা ধরা পড়লে সাথে সাথে শিরোনামে উঠে আসছে হারেম বিলাসিতার যৌন কেচ্ছা। পার্থ চাটুজ্জের কথা নিরপরাধ অবোধ শিশুরা পাঠ্যপুস্তকে পড়ে বড় হয়। সত্তরোর্ধ পার্থর যুবতী প্রেয়সীর খাটের তলার আলিবাবার গুহা সারা বিশ্বকে বাকরূদ্ধ করে দিয়েছে। অতঃপর সমস্ত ছোট বড় দুর্বৃত্ত নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছে দল। অনেক মহিলা নীতিহীন দলের নেতাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। ভোট লুঠ করতে হলে, কেবল খুন বা আড়ং ধোলাই যথেষ্ট নয় সেটা শাসকরা জানে। মা, বোন, স্ত্রীর সম্ভ্রম খুবই দুর্বল ক্ষেত্র। সেখানে আক্রমণ করতে হবে। অত্যাচারিতরা সেই ভয়ে মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য হবেন। সেই সুযোগ দুষ্কৃতিদের সাথে পুলিশ, প্রশাসনও ভাগ করে নিয়েছে। হাতি ধরবার জন্য যেমন কুনকি হাতির ব্যবহার করা হয়, ঠিক তেমনই আলাঘরের মহিলা দালাল আড়কাঠি ব্যবহার করেছে শাসক দলের বাহুবলী দুর্বৃত্ত সমাজ।

সন্দেশখালি বা ভূপতিনগর কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা বাংলা জুড়ে এটাই চিত্র। শহুরে মধ্যবিত্তরা এখনও সেই আগুনের তাপ অনুভব করলেও তেমন ভাবে সরাসরি পোড়েননি। জনৈক জয়ব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, যখন তাঁর স্ত্রী নন্দিনীকে কাউন্সিলারের টোপ দিয়ে ছেষট্টি বছরের বালুমন্ত্রী দার্জিলিংএ স্ফূর্তি করতে অভিসারে যান। সন্দীপ আগরওয়ালের স্ত্রী সুইটি বা রিঙ্কু দত্তকেও নিয়েও অনেক গল্প। অনুপ্রেরণার নেতারা যে যাপন চিত্র তুলে ধরেন, তা শান্তনু, কুন্তলদের মত নব্য দুষ্কৃতিদের কাছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এই চিত্র পরিবর্তন করলে লক্ষ্মী ভান্ডার কার্যকারী থাকবে না। মনে রাখবেন, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্হারা কিন্তু আলাঘরের জীবন কাহিনীর তদন্ত করতে যায়নি। বালুমন্ত্রীর রেশন দুর্নীতির তদন্তে বেফাঁস আক্রমণে অন্তঃসলিলা নরক জীবনের বাস্তব চিত্র ভেসে উঠেছে। রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কোন বিবৃতিতে মনে হয়নি, তিনি হতবাক। প্রশান্ত কিশোরের নির্বাচনী দাওয়াইতে প্রকল্পের যে মানচিত্র ছিল সেখানে গুরুত্বপূর্ণ উপস্হিতি ছিল আলাঘরের।

হিটলার আজ নেই কিন্তু তাঁর কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পের করুণ কাহিনী বেঁচে আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একদা থাকবেন না, থাকবে আলাঘরের বিভীষিকার গল্প। আলাউদ্দিন খিলজীর কামনা কোন দিন মুক্ত হতে পারবে পদ্মাবতীর অগ্নিস্নান থেকে? যা আছে কেবল তাই থাকে না, যা নেই, তাও থাকে। সুশীল থেকে কান এঁটো করে হাসা মধ্যবিত্তরা আলাঘর নিয়ে গোপন সুড়সুড়িতে একটাও বাক্য ব্যয় করেনি, তারা থাকবে ঘৃণার মহাফেজখানায়। কাশফুলের মত দাড়িওয়ালা কাক-শিল্পীকে কত টাকা দিলে রুদালীর মত কাঁদবেন? জানা হয়নি। যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কোন শিখন্ডীকে দরকার নেই। আশি বছরের বৃদ্ধ কৃষিমন্ত্রী শেখ শাহজাহানের সাগরেদদের আক্রমণকে বলেছিলেন, জনতার স্বতঃস্ফূর্ত রোষ। ওই একটা বাক্য অসভ্যটার জীবন-চরিত এঁকে দিল, যখন শেখ শাহজাহান আদালতে আক্রমণের দায় স্বীকার করে নেয়। সারা বাংলায় কিছু আলাঘরকে সংরক্ষিত করা হোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত চিত্রের জন্য। দুশো পঁচাশি বছর পর কবীর সুমন মমতা মন্দিরে আরতি করতে পারবেন। টালিঘর থেকে আলাঘরের জীবন।

লক্ষ্মী ভান্ডারের রূপকার বলেছিলেন, এটা নারীদের প্রকল্প। গ্রামের আড়কাঠি মহিলারা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে মহিলাদের ছবি দেখাত নেতাকে। তার নক্ষত্র অনুযায়ী লালসার ব্যারোমিটার বদল হত। অটোমান বা মুঘল হারেমেও বাঁদী ও খোজারা থাকত। তারা সুলতানের ইশারায় শিকারকে বিছানায় হাজির করিয়ে দিত। বাংলা জুড়ে মধ্যরাতে নিশিডাকের মত পিঠে বানাবার ডাক পড়ত। অসহায় মহিলা ফ্যালফাল করে তাকাতেন তাঁর স্বামী, সন্তানের দিকে। ওরা নীরব মোদী হয়ে যেত ঘোর কলিতে। গাল বেয়ে নেমে আসত অশ্রু ধারা। রাতের চতুর্থ প্রহরের ডাক দিল বনের শেয়াল। বাঁশ গাছের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে কলঙ্কিনী চাঁদ। একটা অসহায় শরীরকে বাইকে নিয়ে যাচ্ছে আড়কাঠি মহিলা আর সেনাপতির খোজা সেনা। আমরা বিশ্বাস করি, এসব গল্প একদিন লেখা হবে, চলচ্চিত্র হবে। কোন এক হুব্বা শিক্ষামন্ত্রী বানাবেন। শেখ শাহজাহানের চরিত্রে হুব্বা বোস। মুখের ভিতর জন্মগত অপরাধীর ছাপ না থাকলে চরিত্রের সাথে মানানসই হবে না। সকাল হবে হয়ত। ব্যাঙ্ক খুলবে। ভান্ডারীরা খবর নেবে অনুদানের টাকা ঢুকেছে কিনা।