১৪ ই এপ্রিল, ২০২১। রাত সাড়ে ন’টা। অমৃতা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর হাজিরা খাতা থেকে চিরতরে মুছে গেল একটা নাম। অভিমন্যু। বয়স ষোলো।


পদায়নীভেত্তম মন্দিরে উৎসব চলাকালীন একটি দল অভিমন্যুকে ছুরিকাঘাত করে।  সংঘর্ষে আহত হয় আরো দুইজন। দুই কিশোর, আদর্শ (১৮) এবং কাশিনাথন (১৬)।অভিমন্যু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সঞ্জয়জিৎ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।হত্যা মামলার আরেক আসামি বিষ্ণুকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।পুলিশ সন্দেহ করেছে যে আততায়ীরা আনন্দুকে খুঁজতে এসেছিল, কিন্তু তার বদলে অভিমন্যুকে আক্রমণ করে। আনন্দু, অভিমন্যুর বড় ভাই, একজন ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার কর্মী।
অভিমন্যুর বাবা অম্বলিকুমার বলেছেন,  “আমাদের পরিবার একটি কমিউনিস্ট পরিবার। অভিমন্যু স্কুলে একজন SFI কর্মী হতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। আমি জানি না কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে।” কেন হত্যা করা হয়েছিল? মেলেনি উত্তর।


ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) অবশ্য এই হত্যার জন্য ভারতীয় জনতা পার্টি – রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্মীদের দায়ী করেছে। দলের নেতারাও বলেছেন যে অভিমন্যু স্টুডেন্ট ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এসএফআই) কর্মী ছিলেন। তবে, বিজেপি অবশ্য হত্যাকাণ্ডে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করেছে।


ব্যাস, একটা অধ্যায় শেষ। একটা গল্পের শেষ। এরপর, পেরিয়ে গেছে একটা গোটা বছর। তবু …
অভিমন্যু, আমরা তোকে মনে রাখিনি।
তোর মৃত্যুর দায় আমার, আমাদের। তোর কৈশোরকে হত্যা করেছি আমরা। স্বপ্নকে হত্যা করেছি। নতুন বছরে তোকে উপহার দিয়েছি মৃত্যু। নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মম মৃত্যু। ক্ষমা প্রার্থনা করার মত ধৃষ্টতা আমরা করিনি। বরং, তোর ওই নিষ্পাপ হাসিমাখা মুখের ছবিটাতে ফুল দিয়েছি। চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছি, ” কমরেড অভিমন্যু অমর রহে ” কিংবা ” কমরেড অভিমন্যু তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলবো না “। তারপর ? তারপর তোর ছবির পাশে বসেই মুঠোফোনে সময় বন্দি করেছি। ছড়িয়ে দিয়েছি কর্মসূচীর প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কিন্তু তোর অকাল চিতার জ্বলন্ত আগুন স্পর্শ করেনি আমাদের।

তোর চিন্তা নেই অভিমন্যু, তোকে যারা মেরেছিলো, তাদের নিশ্চিত শাস্তির জন্য দাবি জানিয়েছি কিন্তু আমরা। পথসভা করেছি গোটা দেশজুড়ে। জমায়েত হয়েছে অলিতে গলিতে। বক্তৃতা দিয়েছি। স্লোগান দিয়েছি। লড়াই করার কঠিন শপথ নিয়েছি সক্কলে। নৃশংস আরএসএসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছি। পত্র পত্রিকা, খবরের কাগজ, গল্প, কবিতায় লিখে গেছি তোর ছোট্ট জীবনটার করুণ মর্মান্তিক অন্তের গল্প। তোর প্রতি আমাদের সমবেত বেদনার ঔদার্যের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছি ছত্রে ছত্রে। তাই সবকিছু স্বাভাবিক আছে, ভালো আছে। শুধু ভালো নেই তোর বাবা। ভালো নেই আনন্দু। ভালো নেই কাশীনাথন আর আদর্শ। তোর স্কুলের বন্ধুরা ভালো নেই। বিশ্বাস কর, ভাল্লিকুন্নাম গ্রামের কেউ আজও ভালো নেই। সবকিছু একদম একইরকম আছে আগের মতোই। শুধু বিশু উৎসবের প্রাণটুকু মরে গেছে কেবল।
না, আজ অভিমন্যুর মৃত্যুদিন নয়। কোনো তথাকথিত বার্ষিকীর মিথ্যে আড়ম্বর রচনা করতে বসিনি আজ। একটা বছর পেরিয়ে এসে কিছু স্বীকারোক্তির ব্যর্থ প্রয়াস করছি মাত্র। কিংবা মুক্তি চাইছি গ্লানি থেকে। ভারমুক্ত হতে চাইছি সমস্ত মৃত্যুর দায় থেকে। দুর্বল মস্তিস্ক আর ততোধিক ক্ষীণ শক্তির দানবীয় বাহ্যিক প্রকাশের তাগিদে আত্ম চেতনা লুপ্ত হয়েছে আমাদের। সভ্যতার পাপী আমরা। 
অভিমন্যু, তোকে আমরা মনে রাখিনি।


তোর মৃত্যুর দায় আসলে আমার, আমাদের। তোর পনেরো বছরের শরীরে নেমে আসা প্রত্যেকটা আঘাত আসলে আমাদের শঠতার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভাইয়ের মৃত্যুর অভিশাপের বোঝা কাঁধে বয়ে বেরানো আনন্দুর যৌবনকে হত্যার অপরাধ করেছি আমরা। তোকে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতার ক্লান্তি আমরা লেপে দিয়েছি কাশীনাথন আর আদর্শর তরুণ চোখে। তোর বাবার অশ্রুবিন্দুর ক্ষতিপূরণ দিতে পারিনা আমরা। অপরাধী আমরা।


আচ্ছা, বইটা খুলে পড়বি না আর কখনো? বইগুলো যে এখনো স্কুলের ব্যাগে যত্নে গুছিয়ে রাখা আছে তোর অপেক্ষায়। এসএফআই এর লিফলেট গুলোও ছড়িয়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেল। আর একবার পার্টি অফিসে এসে বসবি না? আলমারির তাকে জমে থাকা ধুলো পরিষ্কার করা হয় এখনো। তবু ধুলো জমে। জমতেই থাকে। ওই ধুলোমাখা কোণে আর একবার শ্বেতপতাকাগুলো গুছিয়ে রাখবি না যত্ন করে? আকাশ চিরে স্লোগান দিবিনা আর? দাদার সাথে অমীমাংসিত ছেলেমানুষি ঝগড়াটাও যে বাকি রয়ে গেছে। বাবার কাছে বিচার চাইতে আর যাবি না বল? বাবা অপেক্ষা করছে তো। তোর ফিরে আসার অনন্ত অপেক্ষা!
অভিমন্যু, আমরা তোদের মনে রাখি না।


আমরা হেরে গেছি অভিমন্যু। হেরে গেছে আমাদের দম্ভ। হেরে গেছে আদর্শের আস্ফালন। শুধু জিতে গেছিস তুই। আসলে তোরাই জিতে যাস জানিস তো। কখনো কলকাতার রাজপথে জমাট বেঁধে থাকা সুদীপ্ত কিংবা মইদুলের রক্তে, কখনো হায়দ্রাবাদের হোস্টেলে, ঘরের এক পাশে চাপা দিয়ে রাখা একটা মাত্র চিঠির ভাঁজে, আবার কখনো বিশু উৎসবের শুভক্ষণে।  তোরাই জিতে যাস। লড়াই করতে শিখিয়ে যাস বারংবার। অন্ধ সমাজের চক্ষুদান করতে শিখিয়ে যাস রক্তের মূল্যে।


কিন্তু এর কি খুব প্রয়োজন থাকে? প্রয়োজন থাকে কি এত মৃত্যুর? এই ভয়ংকর সময়ের নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে থাকার কি খুব প্রয়োজন থাকে? এত লাশ আমরা রাখবো কোথায়? এত রক্ত উঠে আসে কোন গরল মন্থনে? এত ক্ষত বহন করার মত বৃষস্কন্ধ অবতার জন্মাতেও লজ্জা পায় বোধ করি।
এই গহীন তমসায় চরাচর এখন আবর্জনাময়। ঘৃণা, ঘৃণা, এক অপরিসীম ঘৃণার আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছে সব। আর তার ঔরসে জন্ম নিচ্ছে সমাজের জঞ্জাল। উন্নাসিক নগ্নতা গ্রাস করছে প্রজন্মকে। জল্লাদের উল্লাসে মত্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেখানে ষোল বছরের মৃত কৈশোরের বীভৎস শরীরের প্রতিটা আঘাতের গায়ে নোংরা কীটের মত নির্লজ্জ্ব হাসি হেসে যায় সামাজিক বোধ, সেখানে ঘৃণার বিপরীতে শুধুমাত্র ভালোবাসা প্রকাশ কাপুরুষতার নামান্তর মাত্র। এই কলি কালে যীশুর নিঃস্বার্থ ত্যাগ ঘৃণার পথকেই আরো প্রশস্ত করে খালি। ন্যায়ের শিক্ষাকে দুরমুশ করে দিয়ে যায়। মানুষ তৈরি করে না। আসলে এই হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাই সুদূর আর্জেন্টিনার গলিপথে হেঁটে যাওয়া বিপ্লবীর পদচিহ্ন মিশে যায় কেরলের গ্রামে লেগে থাকা মাটির ঘরে হাতের ছাপে। এ হত্যা জীবনের হত্যা। আবহমানকাল ধরে হত্যার বীজ রোপিত হয়ে চলেছে। কলুষতার বিরুদ্ধে মূল্যবোধের হত্যা। ঘৃণার বিপ্রতিপে ভালোবাসার হত্যা। ভালোবাসার মন্ত্রে তাই গড়ে উঠুক প্রলয়ের অস্ত্র। ভেঙে যাক স্তব্ধতার যত নিকৃষ্ট আবরণ। যুদ্ধ ঘোষিত হোক। হোক দুন্দুভিনিনাদ। নতুন সময়ের কুরুক্ষেত্র প্রস্তুত হোক। 


অভিমন্যু, আর একবার ফিরে আসবি না? আর একটিবার ফিরে এসে ভালোবাসার মন্ত্রটা শিখিয়ে দিয়ে যাবিনা আমাদের? ঘৃণার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সারল্যের প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিয়ে যাবিনা? লড়াইটা যে এখনো বাকি রয়ে গেছে কমরেড…

 – বিধ্বস্ত এক হিপোক্রিট