
তেইশে মার্চ রাতে ঘুমাতে গিয়ে চব্বিশ তারিখ ভোরে আর ঘুম ভাঙল না গেলেন বাংলা ছবি ও টেলিসিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিষেক চ্যাটার্জী। মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে এই সুদর্শন অভিনেতার মৃত্যুতে এখনও চলচ্চিত্র জগত শোকে মূহ্যমান। বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে আট ও নয়ের দশকে রীতিমতো জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন তিনি । তাপস পাল,চিরঞ্জিৎ,প্রসেনজিৎ এর সঙ্গে নায়ক হিসেবে অভিষেক চ্যাটার্জীর নামও উচ্চারিত হত। অঞ্জন চৌধুরীর “গীতসঙ্গীত” ও স্বপন সাহার “সুজনসখী”র নায়ক যে ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন ছবিতে অসংবেদনশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক স্বামীর চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করা আঠাশ বছর আগে বাংলা ছবিতে যথেষ্ট চমক ছিল বইকি! কিন্তু অভিষেক চ্যাটার্জী পেরেছিলেন। পরিশ্রম সময়ানুবর্তিতা এবং অধ্যবসায়ের জোরে নিজের জায়গা তৈরি করেছিলেন যে কারণে এই সময়ে টেলিভিশন ধারাবাহিকে চরিত্রাভিনেতা হিসাবেও নিজের জনপ্রিয়তা আমৃত্যু ধরে রাখতে পেরেছিলেন। শুরুটা তরুণ মজুমদারের পথভোলা ছবিতে হলেও তাপস পালের মত মসৃণ ছিল না অভিষেক চ্যাটার্জীর যাত্রাপথ।
১৯৮৬ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবির পর দ্বিতীয় ছবি শমিত ভঞ্জ পরিচালিত “ওরা চারজন “ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তারপর অনেক ছবিতে কাজ করেছেন দ্বিতীয় নায়ক হিসাবে। নায়ক চরিত্রে সুযোগ পেয়েছেন অনেক পরে। নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও পেশাগত জীবনে সমস্যায় পড়েছেন। পর পর বাইশটা ছবির চুক্তিপত্র সই করার পরেও বাদ পড়েছিলেন “অন্তর্ঘাতের কারণে “বলে একাধিক সাক্ষাৎকারে অভিমানী অভিযোগ করেছিলেন। হাল ছাড়েন নি। যাত্রা ওয়ান ওয়াল থিয়েটার থেকে টেলিভিশন চ্যানেলের কাজ করে গেছেন। জনপ্রিয়তাও ধরে রাখতে পেরেছিলেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়িওয়ালী ছবিতেও বাংলা ছবির নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অনায়াসদক্ষতায়। আবার তরুণ মজুমদারের আলো ছবিতে খুব বেশি হলে দশ মিনিটের জন্য পর্দায় এলেও দর্শকদের একাংশের মনে হয়েছে “অভিনয়টা অনুপকুমারের মত মনে হচ্ছিল না?” বীরেশ চ্যাটার্জী, প্রভাত রায়ের মত পরিচালকদের ছবিতেও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই কাজ করেছিলেন অভিষেক চ্যাটার্জী।
কিন্তু অভিনেতা নয়। কলকাতার উত্তরের উপকন্ঠে বরানগরের বাসিন্দা তরুণটি হতে চেয়েছিলেন খেলোয়াড়। স্কুলে কলেজে বিশেষত ফুটবলে রীতিমতো ভালো খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিত ছিলেন মিঠু ওরফে অভিষেক চ্যাটার্জী। বাবা পুরোন দিনের বাংলা ছবির চরিত্রাভিনেতা প্রশান্ত চ্যাটার্জীর বন্ধু ছিলেন স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক পীযূষ বসু। দীর্ঘদেহী সুঠাম সুদর্শন প্রতিবেশী ছেলেটিকে বাবার ফ্যাকটরিতে নিয়মিত যাতায়াত করতে দেখে নিজের ছবি “অপরাধী” তে নায়ক চরিত্রে কাজ করার জন্য ডেকে নেন পরিচালক নন্দন দাশগুপ্ত। বাবাকে না জানিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন অভিষেক চ্যাটার্জী। প্রযোজকের অর্থাভাবে ছবিটি মুক্তি পেল না কিন্তু স্টুডিও পাড়াতে যাতায়াত শুরু হয়েছিল সেই ছবির শ্যুটিংয়ের সূত্রে। তপন থিয়েটারে একটি পেশাদার নাটকে চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর পরিবর্ত শিল্পী হিসাবে কাজ করার সময় তরুণ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল অভিষেক চ্যাটার্জীর।
তারপর পেশাদার অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জন্য লড়াই শুরু। যে লড়াই চলেছিল টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় কোন বিশেষ গোষ্ঠীতে নাম না লিখিয়ে কাজ করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে। অবশ্য হাসতে হাসতে চ্যালেঞ্জ নেওয়াই তাঁর অভ্যাস। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে খেলা নির্ভর কাহিনীর সিরিয়ালে ফুটবলারের চরিত্রে যখন অভিনয় করলেন তখন তাঁর বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় ছিল না। ঋতুপর্ণ ঘোষের বাহান্ন এপিসোড ধারাবাহিকে অন্যমেজাজে দেখা গিয়েছিল অভিষেক চ্যাটার্জীকে। বর্ধমানের আদিবাসিন্দা এবং কলকাতার উত্তর অংশে বেড়ে ওঠার কারণে সংলাপ উচ্চারণে একটি বিশেষ স্টাইল তৈরি করে নিয়েছিলেন অভিষেক চ্যাটার্জী,যা চরিত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে চমৎকার মানিয়ে যেত তাঁর চেহারার সঙ্গে। দুশোর ওপর বাংলা ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা তাঁর সময়কার প্রায় সব নায়িকার বিপরীতে নায়ক হিসাবে অভিনয় করা অভিষেক চ্যাটার্জীর প্রায় চারদশকের অভিনয়জীবনে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দাঁড়ি পড়ে যাওয়াও নাটকীয় হয়ে রইল।