পুরানো কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল, বেশ কয়েক বছর আগের একটি সংবাদপত্র । তাতে দেখি মুখ্যমন্ত্রীর জ্ঞানগর্ভ বাণী। মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকার কিছুই করেনি, যা কিছু হয়েছে ওঁর আমলে। উনি বলেন আর ওনার প্রতি আনুগত্যের অপরিসীম আকাঙ্খায় তৃণমূলের একজন কেউকেটা ” সায়নী”বর্ধমানে মিটিং এ বলে দিলেন, “কার্জন গেট” দিদি বানিয়েছে।কি লজ্জা বলুনতো। তবু মানুষ ওদেরকে ভোট দেয়। মানুষ তার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝবে।ওদের লজ্জা সরম বলতে কিছুই নেই।যেমন গুরু তেমন শিষ্য।এবার আসল কথায় আসা যাক।বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই তৈরী হওয়া ১৪ তলা বাড়িটি, যার নামকরণ করা হয়েছে নবান্ন, সেই নবান্নের সচিবালয়ের ১৪ তলায় বসে এক অনুষ্ঠানে প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ,”আমার বিচারে সুশাসনের তিনটি মন্ত্র — ইনটেনশন, মিশন ,অ্যকশন –“

আমাদের দেশে ও রাজ্যে ঘটেচলা দিনগুলোতে এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার প্রভাব জনজীবনে পড়ছে। আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে।যেন একটা হুজুগে রাজত্ব চলছে।
হাট, বাজার যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।
আমি গ্রামে থাকি, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। চাষ বাস কিছু করতে হয়।আমাদের ব্লক এলাকাটি আবার নদী ঘেরা এলাকা। দু তিনদিনের বৃষ্টি হলেই ফসলের ক্ষতি হয়ে যায়। ২০২৩ এর ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে অকাল বর্ষণে নীচু এলাকায় আমার কয়েক বিঘার জমির ধান নষ্ট হয়ে গেল।অন্যান্য কৃষকদের ফসল সব নষ্ট হয়ে গেছে।

দ্বারকেশ্বর নদ ও আমোদর নদের লাগোয়া গ্রাম গুলির কৃষকরা ফসল ঘরে তুলে আনতে পারেনি।কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।ঐ সব এলাকার কৃষকদের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। গ্রামেতেও প্রায়ই ঘুরি। ঘুরতে ঘুরতে মুখ্যমন্ত্রীর ঐ কথাগুলি মনে পড়ে। কথা ও কাজে মিল খুঁজে পাই না।আমাদের রাজ্যে এবং দেশে কী সুশাসন চলছে? মনের মধ্যেই দ্বন্দু হয়। এই রকমই ভাবতে ভাবতে একদিন উঠো সকালে আমাদের গ্রামে হাটে যাই। হাট করাও হয়, আবার নানা জনের সঙ্গে ,কৃষকদের সঙ্গে নানান বিষয়ে কথাবার্তা হয়। তাঁরা বলেন, ফসলের ক্ষতির বিষয়টি এবং তাঁদের কী সর্বনাশ হয়েছে। খুব ভেঙে পড়েছে বুঝলাম ।আমি তাঁদের আশ্বস্ত করলাম যে,তোমাদের পাশে তো মুখ্যমন্ত্রী আছেন। কৃষকবন্ধু, লক্ষী ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পে তো তোমরা টাকা পাচ্ছো। চাষের যা ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরন দিদি দিয়ে দেবেন।তোমাদের অসুবিধা হবে না।আমাকে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, “দিদি জানে কত ধানে কত চাল হয় “।কৃষকদের জ্বালা , যন্ত্রণা, দাদা দিদি বোঝে না।যদি বুঝতো তাহলে কৃষকদের আজ এই অবস্থা হতো না। আমাকে উদ্দেশ্য করে এক চাষী বন্ধু বললেন,”দাদা ঐসবে কি সংসার চলে? স্থায়ী সমাধান হয়? প্রলেপ দিয়ে কি সুরাহা হয়? আমার দুটো ছেলে বেকার। কোন কাজ নেই। তাদের চাকরির কী হবে? আমার ফসলের দাম সরকার দিচ্ছে!এই যে দুবিঘা আলু বসালাম।প্রতি বিঘায় খরচ কুড়ি হাজার টাকা।সব জলের তলায় চলে গেল। কৃষক বন্ধুর টাকায় উষুল হবে!ফসলের ক্ষতিপূরণের জন্য বীমা দেবে!জানেন, কৃষককে দু’বার ঠকতে হয়, একবার তার ফসল বিক্রি করতে গিয়ে ঠকে, আর একবার ঠকে কৃষিফসল ফলাতে যা যা উপকরণ লাগে, এবং সংসার চালাতে যা শিল্পসামগ্রীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস লাগে, সেগুলি বাজারে কিনতে গিয়ে।এই দুবার ঠকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।দেনার পাহাড় হয়। তারপর পাওনাদারদের তাগাদায় কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। হুগলীর তিনজন কৃষক আত্মহত্যা করেছে জানেন? আমি বললাম হ্যাঁ জানি।এই জটলার মধ্যে অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করছে দুই সরকারের বিরুদ্ধেই।এক গরীব কৃষক খুব রাগান্বিত হয়েই বলল রেশনের চাল কমিয়ে দিয়েছে। দেশে দুর্ভিক্ষ হবে, দেখে নেবেন।অতঃপর কি? সমস্বরে বলল যা ভুল করেছি,আর না। এবার বামপন্থীদেরকেই আনতে হবে।
ঐ জটলার মধ্যেই এক যুবক এগিয়ে এসে বলল, জানেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর মিশন কী? আমি বললাম, কী? ছেলেটি বলল, আমি আন্দোলনরত একজন চাকরিপ্রার্থী। আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যা বুঝেছি, তা হল প্রতিশ্রুতি, মিথ্যাচার, সাধারণ মানুষকে আগডুম বাগডুম বলে নাচানো। আর মদের দোকান খুলে রাজস্ব আদায় করা, দেশের যুব সমাজকে পঙ্গু করে দেওয়া। আন্দোলনরত চাকুরী প্রার্থীদের উপরে পুলিশ দিয়ে হামলা করাচ্ছে।ব্রিগেড যাবার কথা জিজ্ঞেস করায় সে বলল, অবশ্যই যাবো, আমরা বাসে করে যাবো। যুব সমাজ ভিতরে ভিতরে গুমরোচ্ছে, সুযোগ পেলেই উল্টে দেবে। তার পর কী হবে? আমি বললাম, বিজেপি? ছেলেটি বলল, আরে না না, সব বুঝি। মোদীর তো মিশন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা। এই যে রামমন্দির হচ্ছে, আমি চাকরি পাবো? বেকার ছেলেদের চাকরি হবে? মোদীর মিশন হচ্ছে দেশ বিক্রি করে দেওয়া, সব অধিকার কেড়ে নেওয়া, আমাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত থাকবে না। আমি বললাম, তাহলে কী হবে? ছেলেটির স্পষ্ট জবাব, দুটো দলকেই হারাতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দুই-ই হচ্ছে সাধারণ মানুষের শত্রু। মোদীও তো মানুষকে বোকা বানাচ্ছে, শ্রম চুরি করছে। মোদীর নীতিতেই রাজ্যে রাজ্যে দেদার জব কার্ড বাতিল হয়ে গেছে।কাজ,কাম নাই।বহু শ্রমজীবী মানুষ অন্ধকারে ডুবে গেছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার সময় বেকরত্বের হার ছিল ৫.৪৪ শতাংশ, আর২০২৩ সালে নভেম্বর মাসে হার বেড়ে ৯. ২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বছরে দু’কোটি ছেলের চাকরি দেবে বলেছিল, কিন্তু বছরে দূরে থাক, গত দশ বছরেও মোট দু’কোটি চাকরির গন্ধটাও শুনিনি। চাকরি পাওয়া তো দূর অস্ত। ইদানীং আবার মাঝে মাঝে “রোজগার মেলা”করে ১০ লক্ষ চাকরির নতুন প্রতিশ্রুতি শুনেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে। সেই প্রতিশ্রুতিও রাখেনি।আবার দিদিও কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিশ্বশিল্প সম্মেলন করলেন। কতজনের চাকরি হয়েছে?সব লোক দেখানো।

ঐ হাটেই চায়ের দোকানে চা খেতে ঢুকলাম। দেখলাম, তর্ক-বিতর্ক চলছে দোকানে। আমাকেও বসতে বলল। ওদের তর্কাতর্কির মধ্যেই একজন আরেকজনকে উদ্দেশ করে বলল, তোর ইনটেনশন ভালো নয়, তোর বদ মতলব আছে। যেমন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। বলতেই ছেলেটি একটু থেমে গেল।। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে মুখ্যমন্ত্রীর ইনটেনশন কী তা জানতে চাইলে আগের লোকটি বলল, মুখ্যমন্ত্রীর ইনটেনশন হল চাকরিচোর, কয়লাচোর, গোরুচোরসহ সব চোরেদের বাঁচানো, তাদের প্রোটেকশন দেওয়া। পিজি হাসপাতালটাতো জেলের ভি আই পি হাসপাতাল করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ বেড পাচ্ছেন না, আর চোরগুলোর জন্য বিপুল আয়োজন। আচ্ছা মশাই, বলুন তো –এই চোর ডাকাতদের বাঁচাতে রাজ্য সরকার যে উকিলের পিছনে টাকা খরচ করছে তার টাকা কোথা থেকে আসছে!সব আমাদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা।কলকাতা হাইকোর্ট নবান্নকে তো এবিষয়ে জঘন্যভাবে ধুয়ে দিয়েছে। তাতেও কি ওদের লজ্জা হবে। যত তোলাবাজ, কাটমানি খাওয়া, সারদা নারদার চোরেদের রক্ষা করছেন। ওদিকে মোদীও তাই, আদানী-আম্বানীসহ দেশের টাকা লুঠ করে নেওয়া চোরেদের আগলে রাখছেন, বিদেশে পাঠিয়ে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আর এসবের প্রতিবাদ করলেই নানা কেস দিয়ে মামলা ঠুকে দিচ্ছেন। এ এক আজব দেশে আমরা বাস করছি। সাধারণ মানুষ ভুতি চুষছে আর ওরা গদিতে বসে নানা রকমের খানাপিনা করছে।দাদা দিদির সাজের বাহার দেখেছেন।এ সবই তো সরকারের টাকায় হচ্ছে।

আড্ডা চলতে চলতেই একটা গোলমালের আওয়াজ এলো। একজন উঠে গিয়ে দেখে এসে জানালো, এ্যাকশন হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করায় বলল, তৃণমূলের দুটো গোষ্ঠীর মধ্যে এ্যাকশন চলছে। যা এখন নিত্যকার ঘটনা। আড্ডা জমে গেল, চায়ের অর্ডার এলো। একজন বয়স্ক মানুষ আক্ষেপ করে বলছেন, কী সর্বনাশ হয়ে গেল। দৈনিকই এ্যাকশন হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ যেন এখন আতঙ্কপুরী হয়ে গেছে। স্যুট আউট, সোনার দোকানে চুরি-ডাকাতি, বোমা বিস্ফোরণ, বস্তিতে আগুন লেগেই আছে। মরেও যাচ্ছে পটাপট। পুলিশ তো ঠুঁটো জগন্নাথ। আবার গতকাল ৫।১।২৩ তাং তৃণমূল কংগ্রেসের এক শাহেনসা ই ডি কে মেরে চৌপাট করে দিয়েছে। ঠিক এই সময়ে একজন বললো,এখন আবার লোকালয়ে বাঘের আতঙ্কও ছড়িয়ে গেছে। এ যেন ‘জলে কুমির ভাঙায় বাঘ অবস্থা’। আমরা যাই কোথায়? সরকার আছে বলে তো মনেই হয়না। দাদা করছে রামমন্দির, দিদি করছে জগন্নাথ মন্দির। ধর্ম নিয়ে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, বিভাজন হচ্ছে, আর দিদির প্রশ্রয়ে আর এস এস-এর বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। আমাদের সচেতন হতে হবে সবাইকে। সামনের নির্বাচনে সব ভোট বামপন্থীদেরকেই দিতে হবে। সবাই মিলে উদ্যোগ নাও।কারণ, ওরাই পারবে এইসব অপকর্ম থেকে রাজ্যটাকে সুরক্ষিত রাখতে।

ঠিক এই সময়েই একজন পরিচিত মাস্টারমশাই এই চায়ের দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দিলেন। তিনি সব শুনে বললেন, তোমরা ডিমিট্রভের নাম শুনেছো? দোকানে যারা ছিল তারা তো হেসেই আকুল। আমরা ওসব জানবো কী করে মস্টারমশাই।চাষাভূযো মানুষ, দিন আনি -দিন খাই।ওসব জানবো কিভাবে!বলুন তিনি কে? মাস্টারমশাই জর্জি ডিমিট্রভের জীবনের কিছু কথা বলে ,তাঁর একটা উক্তির উল্লেখ করলেন। কথাটি হলো, “ফ্যাসিজম জনসাধারণের সবচেয়ে দুর্নীতি পরায়ণ, সবথেকে ভাড়াটিয়া মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের গ্রাসে তুলে নেয়, কিন্তু জনসাধারণের দরবারে তারা হাজির হয় সৎ এবং দুর্নীতির ছোঁয়াচহীন গভর্ণমেন্ট গঠনের দাবী নিয়ে।” কেন্দ্রে এবং রাজ্যে দুই সরকারই এইভাবেই সরকার গঠন করেছিল। তিনি আরো বললেন, দেশে এবং রাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস তারা এই ইনটেনশন, মিশন আর এ্যাকশন নিয়েই চলছে। যার অবিলম্বে পরিবর্তন হওয়া দরকার। আপনারাই পারেন এই পরিবর্তন ঘটাতে — বলে তিনি অচিরেই হাটের ভীড়ে চলে গেলেন।