দিনের বেলাতেও ভিতরে ঢুকতে গা ছমছম করবে। সিমেন্টের দেওয়ালের গায়ে আগাছা, কালো হয়ে থাকা আগুনে পোড়ার চিহ্ন। বিধ্বস্ত, ঝোপঝাড়ে ভর্তি শুনশান ‘প্রাণহীন আবাসন’!

প্রায় দশ বছর আগে, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সেই গুলবর্গা সোসাইটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। গণশক্তি’র তরফে গুজরাট বিধানসভার ভোট কভারেজে। নরেন্দ্র মোদী তখন মুখ্যমন্ত্রী। সেবার ফের গুজরাটে বিজেপি সরকারে আসার পরেই মোদীকে জাতীয় মঞ্চের মুখ হিসাবে সামনে আনার প্রস্তুতি তখন চালাচ্ছিলেন অরুণ জেটলির মত নেতারা।

যাই হোক, ‘শাহী ক্রনোলজি’ বোঝার আগে দশবছর আগের সেই রোদঝলমলে সকালে ফিরে যাওয়া যাক একটিবারের জন্য।

গুলবর্গা সোসাইটির সেই ভয়াবহ ৬ ঘন্টা….

গুলবর্গা সোসাইটি।আমেদাবাদ শহরের চমানপুরা এলাকা। এই পোড়া, জনমানবশূন্য আবাসনে সেবার ভোট কভারেজের ফাঁকে না এলে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বোঝা যেত না ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থাকা একটি দেশে ধর্মীয় ভেদাভেদ কোন বীভৎস চোহারায় নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতিকে।

২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি-দুপুর থেকে সন্ধ্যা। মাত্র ছয় ঘন্টার মধ্যেই উন্মত্ত গেরুয়া বাহিনী যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল তাতে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। আবাসনের একের পর এক ঘরে ঢুকে সংখ্যালঘু বাসিন্দাদের বের করে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে, আগুন ধরিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হত্যালীলা চালানো হয়। মাত্র ৬ ঘন্টার মধ্যে নৃশংসভাবে খুন করা হয় ৩৮জনকে। ঘটনার পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি আরো ৩১জনকে। যদিও পরে তাঁদের মৃতদেহ মেলে।

গুলবর্গা সোসাইটির বন্ধ গেট টপকে ঢুকতে হয়েছিল সে সময়। মূল ফটক পেরিয়ে কিছুটা গিয়েই ডানহাতে পড়বে তিনতলা বাড়িটি। কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরি থাকতেন সেখানেই। সেদিন সন্ধ্যায় প্রাণ বাঁচাতে পড়শীরাও কোনমতে আশ্রয় নিয়েছিল তাঁর বাড়িতেই। প্রাক্তন সাংসদের বাড়ি, ফলে প্রাণে বেঁচে যেতে পারেন এই আশা ছিল।কিন্তু এহসান জাফরি নিজেও রেহাই পায়নি।বিকাল থেকে বারেবারে ফোন করেও প্রশাসন থেকে কোন সাহায্য সেদিন পায়নি কংগ্রেসের সাংসদ।

মসনদে তখন আধুনিক নীরো। গোধরার ঘটনার পরে আজকের প্রধানমন্ত্রী সেসময় বলেছিলেন,‘হিন্দুদের রাগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত’। সেই সুযোগ দিয়েছিল তাঁর সরকার। ফলে এহসান জাফরিদের বাঁচার সুযোগ মেলেনি।

গোটা মহল্লায় মূলত হিন্দুদের বাস।এই সোসাইটির ভিতরে ২৯টা ফ্ল্যাটে ছিলেন সংখ্যালঘু পরিবারগুলি। গুলবর্গাসোসইটি থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে শাহ আলম। গুজরাট গণহত্যায় আশ্রয় দিয়েছিল আক্রান্তদের। সেখানেই কথা হয়েছিল শেরখান পাঠানোর সঙ্গে। দশ বছর আগে। এখন কী অবস্থায় আছেন, জানিনা। যোগাযোগ আর হয়নি পরবর্তীতে। সেদিন শেরখান পাঠান বলছিলেন, গণহত্যার দিনগুলির সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। চোখের সামনে দেখেছেন মাথায় গুলি করে র‌্যাফ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বছর কুড়ির যুবককে। সব কিছু হারিয়ে শাহ আলমে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করার অভিজ্ঞতাও বলছিলেন। শেরখান পাঠানের কথায়- ‘‘আপনাদের জ্যোতি বসু তো এদের অসভ্য, বর্বর বলেছিলেন। কেন বলেছিলেন নিজের অভিজ্ঞতাতেই তা টের পেয়েছিলাম। ঐ শাহ আলমে অটলবিহারী বাজপেয়ী সভা করতে এসেছিলেন। কারো পরিবারের পাঁচজন খুন হয়েছে, কারো মেয়ে ঐ গণহত্যার পর্বে ধর্ষিতা হয়েছিল, সেসব কথা আমরা যখন ওনাকে বলতে গিয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন- ‘আমি এখানে লাশ গুনতে আসিনি, ওসব কথা ভুলে যান আপনারা’! মানে, সব ভুলে যেতে হবে, কেউ পারবে ঐসব দৃশ্য ভুলে যেতে!’’

তিস্তা শীতলবাদে আক্রোশ কেন?

সব ভুলে যাওয়ার কথাই তো বলছে রাষ্ট্র। ভুলতে পারেননি জাকিয়া জাফরি, খুন হওয়া কংগ্রেসসাংসদের স্ত্রী। ভুলতে পারেননি তিস্তা শীতলাবাদের মত মানবাধিকার কর্মীরাই। তাই রাষ্ট্র বেপরোয়া।

কেন গ্রেপ্তার তিস্তা শীতলবাদ? দাঙ্গাকারীরা জামিনে। গণহত্যার বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলা মানবাধিকার কর্মী জেলে-ফ্যাসিবাদের উল্লাসমঞ্চে স্বাগত ভারতবাসীকে।

এর আগে দীর্ঘ তদন্তের পরে ‘বিশেষ তদন্তকারী দল’ বা ‘সিট’ গুজরাট দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ক্লিনচিট দিয়েছিল। সেই ক্লিনচিটকেই ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ বলে অভিযোগ এনেছিলেন জাকিয়া জাফরি। তিনি সিটের ক্লিনচিটকে চ্যালেঞ্জ করে অভিযোগ করেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদী গুজরাট গণহত্যার সময় সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এই দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলায় অন্যরা দোষী সাব্যস্ত হলে মোদী কেন হবেন না, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন জাকিয়া। সেদিন মোদীকে বারবার ফোন করেও কোনো সাহায্য পাননি এহসান জাফরি। ‘হিন্দুদের রাগ মেটানোর সুযোগে’ সাংসদ সহ ৬৯জন সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল।

যদিও গুজরাট গণহত্যার দু’দশক পরে বিচারপতি এএম খানউইলকারের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ ২০০২ সংখ্যালঘু গণহত্যায় জাকিয়া জাফরির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যদিও এই ঘটনায় মোদীর ‘তেমন ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পায়নি। বরং এতদিন ধরে বিষয়টি ‘জিইয়ে রাখা’ নিয়ে আপত্তি তুলে আদালত বলেছে, ‘কারও নির্দেশে’ এই আবেদন পেশ হয়েছিল।

গুজরাট গণহত্যার সময় আমেদাবাদের গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে নিহত কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া এবং সমাজকর্মী তিস্তা যৌথভাবে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। যে মামলার মূল কথা ছিল, ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীকে দেওয়া ক্লিনচিট খারিজ করুক আদালত। এই গণহত্যা সহ বিভিন্ন হত্যালীলায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে বারে বারেই। গণহত্যার জন্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিউটনের তৃতীয় সূত্র আওড়ানো মোদীকে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়ে দেয়। জাকিয়া জাফরির আবেদনকে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে আদালত। বিতর্কিত এই রায়ে আদালত একইসঙ্গে আবেদনকারীদেরও সমালোচনা করে।

আর তারপরেই গত ২৫ জুন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সরাসরি তিস্তা শীতলবাদের নাম করে আক্রমণ শানান। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুম্বাইয়ে পৌঁছে অপারেশনে নেমে পড়ে গুজরাট এটিএস। গান্ধীনগরে একইভাবে গুজরাট পুলিশ গ্রেপ্তার করে একসময়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি আরবি শ্রীকুমারকেও।

পুলিশি হেপাজতে থাকা তিস্তা শীতলবাদের অভিযোগ, জোর করে গুজরাট পুলিশ তাঁর বাড়িতে ঢুকেছে। তাঁর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে হেনস্তা করা হয়েছে। এমনকি তাঁর আইনজীবীর সঙ্গেও তাঁকে যোগাযোগ করতে দেওবা হয়নি। মানবাধিকার কর্মী তিস্তা তাঁর প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন।তাঁর হাতে কালশিটের দাগ রয়েছে। গুজরাট গণহত্যা নিয়ে প্রথম থেকেই সরব এই মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধেই এখন আক্রোশ মেটাতে ব্যস্ত মোদী সরকার। গুজরাট গণহত্যা, গুলবর্গা সোসাইটি নিয়ে নাকি মিথ্যা প্রচার চালানো হয়েছিল!তিস্তা শীতলাবাদ ও তাঁর সংগঠন সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস তাই আক্রমণের লক্ষ্যে। ২০০২ গণহত্যার বিশেষ করে গুলবার্গ হত্যাকাণ্ড ও নারোদা পাটিয়া হত্যালীলার মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলি লাগাতার সামনে নিয়ে এসেছিল এরাই। সেই লেগে থাকার জেরেই জেলে যেতে হয়েছিল মায়া কোদনানির মতো দাঙ্গাকারী বিজেপি নেত্রীকে। যদিও মোদী প্রধানমন্ত্রী হওবার পরে মায়া এখন মুক্ত।

গুজরাট গণহত্যার সময়ে কীভাবে রাজ্য সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রধান, হিন্দুত্ববাদী নেতারা ভূমিকা পালন করেছেন তা ‘ফুট সোলজার অব কনস্টিটিউশন’ বইতে  বিশদ তুলেও ধরেছেন তিনি। তাঁর একের পর এক প্রতিবেদনে ফাঁস হয়েছে কীভাবে বিশেষ করে এহসান জাফরির হত্যাকাণ্ডের সময়ে বারংবার আবেদনে পুলিশ তাঁকে বাঁচাতে আসেনি, কীভাবে আমেদাবাদে নৃশংস গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে।

অপেক্ষা করুন আর কিছুদিন। ২০২৫-এ আরএসএসের একশো বছর। ২৪‘এ যদি ফের ক্ষমতায় ধকল করতে পারে মোদী-শাহ জুটি তাহলে আদৌ গুজরাটে এমন কোন ঘটনা, দাঙ্গা, গণহত্যা হয়েছিল কীনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে।

তিস্তা শীতলবাদের গ্রেপ্তারি আসলে গোটা দেশের প্রতিবাদী সব সত্ত্বার কাছেই একটা হুঁশিয়ার- সরকার, রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তোলা হলে পরিণতি হবে এমনই। দাভেকর, পানসারে,কালবুর্গি-তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।

মমতার ফুলের তোড়া ও তিস্তায় হিরন্ময় নীরবতা!…

তিস্তা শীতলাবাদের গ্রেপ্তারি নিয়ে সেভাবে মুখ খুলতে দেখা যায়নি মুখ্যমন্ত্রীকে, তৃণমূলের তরফেও শোনা যায়নি কোন কথা। তৃণমূলের এই হিরন্ময় নীরবতার এক আশ্চর্য সমীকরণও আছে। তখন তিস্তা শীতলাবাদরা গুজরাট গণহত্যার বিরুদ্ধে আদালতে, রাস্তায় লড়াই চালাচ্ছিলেন তখন মমতা ব্যানার্জির তরফে ভোটে জেতার পরে নরেন্দ্র মোদীকে ফুলের স্তবক পাঠানো হয়েছিল শুভেচ্ছা জানিয়ে।

তৃণমূলেরই প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু দুবছর আগে প্রয়াত হয়েছে। ২০০৮ সালে আত্মজীবনীমূলক ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’ বইটি লিখেছিলেন কৃষ্ণা বসু। সেই বইটিতে গুজরাট গণহত্যার বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর ভূমিকার সমালোচনার পাশাপাশি মমতা ব্যানার্জির ‘দ্বিচারিতা’ও তুলে ধরেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তা নিয়ে বিতর্কও হয়। সেই বইটিতেই কৃষ্ণা বসু গুজরাট দাঙ্গার পরেও মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এনডিএ সরকারের পক্ষে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মতবিরোধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবেই বইটিতে সেই সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘…গুজরাট দাঙ্গা আমার সামনে এক ব্যক্তিগত সঙ্কট তৈরি করে দেয়। এই বিষয়ে বিজেপি’র ভূমিকায় আমি তীব্র বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু আমার দলে আমি একা ছিলাম। এই প্রশ্নে মমতার দ্বিচারিতায় আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ওঁকে সবাই ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলিম-দরদি বলেই জানত। কিন্তু গুজরাট সঙ্কটের তাৎপর্য ও কেন বুঝতে পারছিল না বা বুঝতে চাইছিল না, তা আমার কাছে ছিল রহস্য…সংসদে এই প্রশ্নে বিতর্ক ও ভোটাভুটির ঠিক আগে ও সংসদীয় দলের সভা ডাকে। মমতা প্রত্যেকের কাছে এক এক করে জানতে চায়। ততদিনে সকলেই বুঝে গিয়েছেন মমতার নিজের মত কী। সেই অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে সকলে সায় দিতে থাকে এবং বলে যে সরকারের সমালোচনা করা হোক কিন্তু সরকারের পক্ষে ভোট দেওয়া হোক…আমাকে সরকারের পক্ষে ভোট দেবার জন্য দলের পক্ষ থেকে হুইপ দেওয়া হয়…হুইপ অমান্য করে সাংসদপদ খোয়ানোর কথাও আমার মনে আসে….এখন মনে হয় ২০০২ সালে হুইপ অমান্য করে সাংসদ পদ ছেড়ে আসাই আমার উচিত ছিল’।

এরাজ্যেও তাই সেই মোদী মডেলেই গণতন্ত্র হত্যার দৃশ্য প্রায় প্রতিদিনই দেখছেন রাজ্যবাসী।