অতি সম্প্রতি কর্ণাটকে ফ্যাসিস্ত শক্তির পরাজয় ঘটেছে। অশুভ শক্তির এই পরাজয় নিশ্চিত ভাবেই শুভ শক্তিকে উৎসাহ যোগাবে…আরও কঠিন লড়াইয়ে সঙ্গবদ্ধ হতে সাহায্য করবে। পরাজয় থেকে যেমন আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার ঠিক তেমন ভাবেই জয় থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। মনে রাখা দরকার যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এটাই শেষ লড়াই নয়। আরও দীর্ঘ পথ আমাদের চলতে হতে।

কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর অনেক জায়গাতেই দেখছি অমুক বিধানসভা অঞ্চলে এতো শতাংশ হিন্দু এতো কম শতাংশ মুসলিম…তবুও বিজেপির পরাজয় হয়েছে। অতএব এটা গণতন্ত্রের জয়, ধর্ম নিরপেক্ষতার জয় ইত্যাদি প্রভৃতি। এদের কাছে আমার জানতে ইচ্ছে করে, ধর্মীয় পরিচয়টাই কি তাহলে আমাদের একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠলো? যা ফ্যাসিস্ত বিজেপি চাইছে…শুধু ধর্মীয় পরিচয়টাই হোক একমাত্র পরিচয়! ফ্যাসিস্ত শক্তি যা চাইছে আমরাও কেন সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তিকরে গনতন্ত্রের, ধর্ম নিরপেক্ষতার পাঠ পড়াবো? ফ্যাসিস্টদের ফেলে রাখা চটিতে কেন পা গলাবো?

সবাই যখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইছেন তখন একটু লোক সঙ্গীত গাইবার ইচ্ছে হলো। অবাক হয়ে যাই তখন, যখন দেখি, কিছু প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষেরাও বিজেপির মতোন ধর্ম দিয়েই মানুষের পরিচয় দিচ্ছেন দেখে! ভাবখানা এমন যেন, দেখো বিজেপিতো বলেছিল হিন্দুদের ইজারা তারাই নিয়ে রেখেছে…পারলো কি? না বন্ধু। আমি আমার দেশের সাধারণ মানুষকে ধর্মের চশমা দিয়ে দেখতে পারবো না। কেননা এই দেশটা যেমন অমল, বিমল, ভবানীদের; ঠিক তেমনই এই দেশটা সাবির, ইমরান, মতিউলদের। যে দেশের বুকের উপর দিয়ে গঙ্গা বয়ে গিয়েছে, যে গঙ্গার জলে হরিদ্বার থেকে সাগর পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ পুণ্যস্নান করেন, সেই গঙ্গার দু পাড়ে গড়ে ওঠা মসজিদে হাজার হাজার মানুষ নামাজ পড়েন। তাই যখনই দেখি ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ত সুলভ বিভাজনের রাজনীতির অঙ্ক…বুক আমার কেঁপে ওঠে। মেহের আলির মতো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়।

বেনারসের সন্ধ্যা আরতী তো আমরা অনেকেই দেখেছি কিন্তু আমরা ক’জন জানি যে, সেই আরতীর সলতে বংশ পরস্পরায় মুসলিম ভাইয়েরা বানিয়ে আসছেন। আবার তাজমহল, ফতেপুর সিক্রির ইতিহাস দর্শনার্থীদের জানাবার জন্য বংশ পরস্পরায় গাইডের কাজ করে আসছেন হিন্দুভাইয়েরা। বেনারসের ঘাটে সন্ধ্যা আরতীর সময় গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানোর সময় কি প্রদীপ বিক্রেতার কাছে আপনি জানতে চান- এই সলতে কে বানিয়েছে…হিন্দু না মুসলিম?…জানতে চান তাজমহল, ফতেপুর সিক্রির গাইডের পরিচয়? না। জানতে চান না। কেননা বেনারসের ঘাটে প্রদীপ বিক্রেতাই হোক কি তাজমহল, ফতেপুর সিক্রির গাইড -এদের সাথে আপনার/আমার একটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়…ক্রেতা আর বিক্রেতার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কখনোই ধর্মীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে না…গড়ে ওঠে প্রয়োজন বা তাগিদের উপর ভিত্তি করে।

লড়াইটা আসলে ধর্মের জিগির তোলা কিছু অন্ধ মানুষের সাথে নয়, লড়াইটা আসলে “HAVE” আর “HAVE NOT” দের মধ্যে। “নেই ভারত” আর “জমকালো ভারত”-এর মধ্যে। মালিক আর শ্রমিকের মধ্যে। শ্রম আর পুঁজির মধ্যে। যে লড়াইটা আমরা বারবার জিতেছি…বারবার। কিন্তু জিতেও have not-দের দলে থেকে গিয়েছি…নেই ভারতের দলে সামিল হয়েছি…দুঃখ, যন্ত্রণাকে বুকে চেপে বাঁচতে শিখেছি। জেনেছি, ক্ষুধা নিবারণের জন্য লড়াই সংগ্রাম  করতে। বুঝেছি ধর্মীয় পরিচয় কখনোই এই লড়াই সংগ্রামের হাতিয়ার নয়। এই লড়াইয়ের হাতিয়ার হলো, যন্ত্রণা, ক্ষোভ আর জমে থাকা চোখের জল।

কর্ণাটকের ফলাফল আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ধর্ম নয়, জাতপাত নয়, ধর্মীয় অন্ধ ঘোঁড়ামি নয় মানুষের পরিচয় একটাই- তারা সবাই মানুষ। যাদের ক্ষুধা পায়, প্রচন্ড গরমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে কষ্ট হয় তবুও তারা ঘাম ঝড়ায় সন্তানের কথা ভেবে, পরিবারের কথা ভেবে…মন্দির মসজিদের কথা ভেবে নয়। -এই সাধারণ কথাগুলিই তো বারবার আমাদের বলতে হবে। তিল তিল করে গড়ে তুলতে হবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণের জোট। যে জোট ধর্মের মোড়কে মানুষে মানুষে বিভাজনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে…গর্জে উঠবে শোষণের বিরুদ্ধে, শাসকের বিরুদ্ধে। সর্বোচ্চ গনতন্ত্রের পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরবে। তাই শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে এই জোটের ব্যাখ্যা করা যায় না। উচিতও নয়। কেননা এই ব্যাখ্যার সর্ষের মধ্যেই ফ্যাসিবাদ যে বিভাজনের রাজনীতির কথা বলছে সেই ভূত থেকেই যায়। তাই বলছি, দুঃখে ভেঙে পড়ো না আবার আনন্দে উৎসাহিত হয়ো না, দরকার বাস্তব অবস্থার সঠিক মূল্যায়নের।