গৌতম আদানির ব্যবসার কারচুপি আর জালিয়াতি এখন প্রকাশ্যে এসে গেছে। মার্কিন হিন্ডেনবার্গ সংস্থার রিপোর্টের ফলে তা সারা পৃথিবী জুড়ে ব্যবসায়ীরা আজ জেনে গেছে।কিন্তু এর ফলে মুস্কিলে পড়েছে বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি তো প্রকাশ্যেই আদানির পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। এমন কি তৃণমূল কংগ্রেস মুখে অনেক কথা বললেও আদানির বিরুদ্ধে কোন কঠিন পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করছে না। কিন্তু কেন? এ ধরণের ঘটনা কর্পোরেট দুনিয়ায় নতুন নয়। বহু দেশে অসাধু কর্পোরেট নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ব্যবসা প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে। যেদিন ধরা পড়ে, সেদিন শাস্তি হয়, অতীতে বহু দেশে এরকম হয়েছে। প্রশ্ন এটা নয় যে আমাদের দেশে আদানির মত অসাধু কর্পোরেট কেন আছে; প্রশ্ন এটাই যে এই অসাধু আদানিকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে গেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার। এখানেই ধন্ধ। প্রশ্ন এখানেও যিনি আদানির বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলবেন, তিনি সরকারের রোষানলে পড়বেন।সরকারের স্বার্থ কোথায়? বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস, এই দুটি সরকারের বৈশিষ্ট্য এটাই যে এদের মানুষের স্বার্থ দেখার কোন দায় নেই; নিজেদের স্বার্থ দেখাই এদের কাজ। আদানির প্রতিপত্তি বিজেপি-আর এস এস এর হাত ধরেই হয়েছে।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে যে ভারতীয় সাংবাদিকের রিপোর্টের সূত্রের কথা বলা আছে তিনি সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা। তিনি কর্পোরেটদের উপরেই লেখালেখি করেন। তিনি অনেককে নিয়েই লিখেছেন; কিন্তু আদানির বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করে তিনি যখন লিখলেন, তখন আহমেদাবাদের একটি কোর্টের নির্দেশে আদানি নিয়ে লেখা এবং বলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় তাঁর উপর। যদি ক্রোনি শব্দটির আক্ষরিক ব্যাখ্যা দেখি, আদানি সব অর্থে ক্রোনি। তার উত্থানের কারণ হল তিনি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এবং তিনি ব্যবসায় মুনাফা করছেন বলে তিনি শাসকদলকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছেন। তাই এই রাজনৈতিক দলগুলি আদানি নামে গোষ্ঠীর উপর পরজীবী।

আদানির উত্থান এবং প্রতিপত্তি, শাসক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ বিপজ্জনক কারণ আদানি গোষ্ঠী দেশের কতগুলি মৌলিক ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করেন। দেশের মৌলিক পরিকাঠামো আদানির হাতে। আদানির হাতে প্রায় বেশির ভাগ বন্দর। দেশের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলে এক ডজনেরও বেশি বন্দর এই গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করে। সেই হিসেবে দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ বেসরকারী বন্দরের তারা মালিক। এ ছাড়াও সি আই এল বা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডের পরেই তারা সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদক সংস্থা। অর্থাৎ অর্থনীতির মৌলিক ক্ষেত্রগুলির নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আদানির হাতে। এন টি পি সির পড়ে এই গোষ্ঠী সর্ববৃহৎ কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থা। তার প্রথম ব্যবসা ছিল হীরের। সেখানেই শুরু তার অসাধু লেনদেন। এই কথা একটি বহুলপ্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর সেই পত্রিকার সম্পাদককে সরে যেতে হয়েছিল।

আদানি গোষ্ঠীর উত্থান ২০১৪ সালে মোদী জমানায়। ২০১৪ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে তার উত্থান হয়েছে গুজরাটে মোদীর সহায়তায়।২০১৪ সালে ৬০৯ তম ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠল বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি। কোথায় সহায়তা করেছে বিজেপি আর আদানি পরস্পরকে? নির্বাচনী বন্ড হল কর্পোরেট আর রাজনৈতিক দলের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের সূত্র। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে নির্বাচনী বন্ড প্রাপকদের মধ্যে। অদ্ভুত ভাবে এই নির্বাচনী বন্ডের বিষয়টি গোপন। এই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি গোগোই প্রশ্ন করলে জানা যায় যে যেই কোম্পানিগুলি  বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলগুলিকে আর্থিক সাহায্য করছে তাদের গোপনীয়তা প্রয়োজন। কেন? ক্ষমতাসীন দল কোন কর্পোরেটের সাহায্যে ক্ষমতায় এল তা তো গোপন রাখতেই হবে ; তা না হলে সেই কর্পোরেটকে যখন সাহায্য করবে শাসক দল, তখনই তো তাদের পারস্পরিক উভজীবী বিষয়টি প্রকাশ্যে আসবে। প্রকাশ না হলেও আন্দাজ করা যায়। তথ্যের অধিকার আইনের এক প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় যে নির্বাচনী বন্ডের ৯৩.৫% ই প্রতিটি ১ কোটি টাকার বেশি। এই টাকা কারা দিতে পারে, তা জলের মত পরিষ্কার নয় কি? তার বদলে আদানি গোষ্ঠীকে কম সুদের হারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়া এর প্রতিদান নয় কি? এল আই সি থেকে শুরু করে একে একে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এর বদলে।

পশ্চিমবঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হল তাজপুর বন্দর। এছাড়া দেউচা-পাচামীর মত বিতর্কিত খোলা মুখ কয়লা খনি তুলে দেওয়া হল আদানির হাতে।২০২২ সালে এপ্রিল মাসে আদানি জানান যে পশ্চিমবঙ্গে তিনি ১০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবেন। কোথায়? রাজ্যের বিভিন্ন পরিকাঠামোতে। পরিকাঠামোই পাখির চোখ আদানি গোষ্ঠীর। আর পাখির চোখ হল রাজ্যের শক্তির বা এনার্জি ক্ষেত্র। সেই কারণেই দেউচা পাচামীর মত মানবতা বিরোধী প্রকল্পে আদানি এগিয়ে এসেছে। এটিও আদানি গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য । পরিবেশের নীতির তোয়াক্কা করে না তারা, মানুষকে ভুল বোঝায়, অসত্য আশ্বাসবাণী দেয় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। এই ধোঁকাবাজিই তো হিন্ডেনবার্গ সংস্থার প্রধান অভিযোগ ছিল আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তারা বলে যে আগামী ১০ বছরে ২৫,০০০ মানুষকে তারা কর্মসংস্থান করবে। অর্থাৎ এই আশ্বাস তারা দিচ্ছে আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকে ১০ বছর লম্বা করার জন্য। তৃণমূল কংগ্রেস এর প্রতিদানে রাজ্যের সম্পদ আদানির হাতে তুলে দেবে একটি একটি করে। এখানেও সেই উভজীবী সম্পর্ক। এছাড়াও রয়েছে ২৫,০০০কোটি টাকার তাজপুর বন্দরের পরিকল্পনা। এই বন্দরের পরিকল্পনা হয়েছিল বামফ্রন্টের সময়ে। দেশের বাজেটে ২০১৪ সালের পর কোন এক নির্বাচনের আগে এই বাবদ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টাকাও বরাদ্দ করেছিলেন। তারপর তার কি হল কেউ জানে না। বছর বছর ঘুরে গেল সেই প্রকল্প চলে এল আদানির হাতে। বিজেপি সরকার তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এবং আদানি গোষ্ঠীর কি সুন্দর যোগাযোগ!বাজেটে বরাদ্দ হলেও আসলে প্রকল্প হবে আদানির। পশ্চিমবঙ্গে সমুদ্রের তল দিয়ে কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, তথ্য কেন্দ্র অর্থাৎ প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণের স্বপ্ন দেখালেন আদানি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর হয়ে। দেউচা পাচামী নিয়ে এতদিনে সকলে জেনে গেছে আদানি কেন উৎসাহী ছিল। আদানি সেই প্রকল্পেই উৎসাহী হয়, যার মুনাফা বেশি, মানুষকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব এবং মানবতা বিরোধী।

এই কাজ করতে গেলে ক্রোনি অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের সহায়তায় পরিবার পরিজন নিয়ে আর্থিক লাভ ক্রমাগতই করে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল যাতে ক্ষমতায় থাকে তা দেখভাল করা। আদানি প্রকৃত ক্রোনি এ ক্ষেত্রে।তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে কোন শিল্প কারখানা হয় নি; কোন বিনিয়োগও আসে নি, এ রাজ্য থেকে পরিযায়ী হয়ে মানুষ দলে দলে অন্য রাজ্যে চলে গেছেন, একমাত্র আদানি কেই মানুষের সামনে শিল্পপতি বলে হাজির করতে পেরেছে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী। তাই সংসদে এ বিষয়ে বিজেপি যখন কোন আলোচনা করতে দিচ্ছে না, এ বিষয়ে বামপন্থী সহ অন্য বিরোধী  দলগুলি যেভাবে সোচ্চার, তৃণমূল কংগ্রেস নয়। রাজ্যের ক্ষেত্রে তারা কি করবে সে বিষয়ে কিছু তারা জানায়নি রাজ্যের মানুষকে। প্রায় গোটা রাজ্যই আদানির হাতে তুলে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের পর রাজ্যবাসীর উদ্দেশ্যে কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে করে নি তৃণমূল কংগ্রেস সরকার । ঠিক এমনটাই করেছে বিজেপি সরকার।

আদানি নিয়ে আপাতত কোন কথা সংসদে বলা হবে না -এমনটাই ইচ্ছে বিজেপি দলের। গণমাধ্যমে আদানিকে যেভাবে আড়াল করে রক্ষাকবচ দিচ্ছে বিজেপির প্রতিনিধিরা, তাতে এই উভজীবী চরিত্রই প্রকাশিত হচ্ছে। বামপন্থী সহ বিরোধীদের দাবি এ বিষয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ার। দলে পরে তৃণমূল কংগ্রেস এই দাবি মুখে করলেও যখনই কোন ভোটদান হয় বিরোধীদের সঙ্গে তারা একজোটে থাকে না; ভোটদানে বিরত থাকে।আদানি সম্পর্কিত বিষয়টি আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপরেও আঘাত হেনেছে। আদানির স্বার্থ রক্ষা বা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেশের মানুষের মুখ বন্ধ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এটাই কর্পোরেটের আদলে আসলে স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিস্টপন্থীর কণ্ঠস্বর।