প্রসঙ্গ – আদানি

জাতীয়তাবাদের আড়ালে দেশ লুঠ

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এর রিপোর্টে আদানির আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে। প্রায় দু বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তির কারচুপির সম্পদের ওপর সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমানের ভিত্তিতেই আঙুল তোলা হয়েছে। সরাসরি বলা হয়েছে, আদানির মোট ১৪০ বিলিয়ন ডলার সম্পদের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারই মাত্র শেষ তিন বছরে গড়ে তোলা, একদম রকেট গতিতে উত্থান। পরিস্কারভাবেই উঠে এসেছে, কিভাবে শেয়ার বাজারে সাংঘাতিক দুর্নীতি করে আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ এর সব শেয়ার কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে মোদী জমানার বিগত বছরগুলিতে। যারা আদানি গোষ্ঠীর সব সংস্থার বার্ষিক অডিট করে, সেই সংস্থার নাম ঠিকানা উল্লেখ করে লেখা রয়েছে সেটিও আদতে একটি সন্দেহজনক অডিট সংস্থা।

প্রথম দু দিন শেয়ার বাজারে ব্যপক ক্ষতির পর আদানি গ্রুপ উত্তর দিতে এগিয়ে এল। আদানি গ্রুপের মুখ্য আর্থিক অফিসার জুগসিন্ধার সিং প্রেস ব্রিফ করে সব অভিযোগ খারিজ করলেন। মিস্টার সিং একটা বিশাল বড় ভারতের জাতীয় পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বললেন। ওকে দেখে মনে হল ভারত সরকারের অর্থ দফতরের কোনও অফিসার, একবারও মনে হল না ক্রমাগত জালিয়াতি করে চলা একটা গ্রুপ অফ কোম্পানির কেউ ! বার্তাটা পরিস্কার, তুমি যদি আদানির সাথে সঙ্ঘাতে যাও, তাহলে সেটা ভারতের সাথেই সঙ্ঘাতে যাওয়া হিসেবে দেখা হবে।

এটাই ধান্দার ধনতন্ত্র, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। মোদী জমানায় এটাই দস্তুর। সেই গুজরাত জমানা থেকেই সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী মোদীর সাথে গৌতম আদানির দোস্তি। ২০১২ থেকেই মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গোটা দেশ জুড়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কর্পোরেট মাধ্যমে আদানির বিনিয়োগ ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০১৪ র লোকসভা ভোটের আগে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে যে বিমানে চেপে রোজ গোটা দেশ জুড়ে ১৬ ঘণ্টার সফর করতেন মোদী, সেটাও ছিল এই গৌতম আদানির প্রাইভেট জেট। এমনকি নির্বাচনে জয়ের পরেও সেই আদানির প্রাইভেট জেট করেই দিল্লীতে আসেন মোদী। তাই ২০১৪ সালে যে আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ এর মোট সম্পদের মূল্য ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার, সেটা মোদী জমানার আট বছরে ২০২২ র শেষে ১৪০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের ৬০৯ নম্বর ধনী ব্যক্তি থেকে একলাফে ৩ নম্বরে। মোট ৭ টি স্টক মার্কেটে নথিভুক্ত সব শেয়ারগুলোর শেষ তিন বছরে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির পরিমান ৮১৯ শতাংশ ! এরকম জালিয়াতির নজির এর আগে নেই। যদিও এই জালিয়াতির শুরু অনেক আগে থেকেই। গৌতম আদানির আরও দুই ভাই যথাক্রমে রাজেশ আদানি ও বিনোদ আদানি এর আগেও জালিয়াতি করেছে। মোদী জমানার আগে মোট ৪ টি সরকারী তদন্তে এদের জালিয়াতি ধরা পড়েছিল, যার পরিমান ছিল দেড় লক্ষ কোটি টাকা। এদের মূল কাজই হচ্ছে শুধুমাত্র খাতায় কলমে অস্তিত্ব রেখে দেশে বিদেশে বিভিন্ন শিখণ্ডী সংস্থা খুলে কালো টাকা বিনিয়োগ ও সরবরাহ করা। হিন্ডেনবার্গ এর রিপোর্টেও লেখা রয়েছে শুধুমাত্র মরিশাসেই ৩০ এর বেশি এরকম কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এরকম একগাদা কোম্পানি রয়েছে। সরকারী কর ফাঁকির অভিযোগে এই দুই ভাই এর আগে গ্রেপ্তারও হন।  তো সেসব এখন অতীত। মোদী জমানা শুরুর পর পুরো চিত্রটাই পাল্টে যায়। এমনকি আদানি গোষ্ঠীর জালিয়াতির সুবিধের জন্য দেশের এস ই জেড ( স্পেশাল ইকোনমিক জোন ) সংক্রান্ত আইনও পাল্টে দেওয়া হয় ২০১৬ সালে। দেশের বানিজ্য মন্ত্রক দ্বারা আগস্ট ২০১৬ তে এস ই জেড সংক্রান্ত ২০০৫ সালের আইনে একটা সংশোধনী যোগ করে দেওয়া হয়। ঐ সংশোধনীতে কোম্পানিগুলোর দ্বারা কাঁচামাল আমদানিকৃত প্রদেয় শুল্ককর ফেরতের কথা বলা হয়। আগের আইনে এরকম কোন কর ফেরতের দাবির বিধান ছিল না। এস ই জেড আইনের ঐ সংশোধনীটি আনার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল আদানি গ্রুপের ৫০০ কোটি টাকা কর ফেরতের একটি মিথ্যা দাবি উত্থাপনের জন্য। আদানি পাওয়ার লিমিটেড বা সংক্ষেপে এ পি এল দাবি করে যে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির জন্য কর প্রদান করেছে। যদিও পরে গোপন ভাবে ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, আদানি গ্রুপ তাদের কাঁচামাল আমদানি বাবদ প্রায় ১০০০ কোটি টাকা শুল্ককর আদৌ প্রদান করেনি। কিন্তু আইনের সংশোধনী আসার পরেই তারা শুল্ককর ফেরতের আবেদন করে ফেলে। ফলে এই জালিয়াতির পরিমানও ছিল ১৫০০ কোটি টাকার।

আদানি কে বেড়ে উঠতে আর কি কি করেছেন মোদী তথা ভারত সরকার ? সাধারন মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা নিগমকে বাধ্য করেছেন আদানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে। জানুয়ারির ২৪ তারিখে আদানি গ্রুপের শেয়ারে এল আই সি র বিনিয়োগের মূল্য ছিল ৮১,২৬৮ কোটি টাকা। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর ঠিক তিন দিন পরে জানুয়ারির ২৭ তারিখে এর মূল্য নেমে দাঁড়ায় ৬২,৬২১ কোটি টাকা। ক্ষতির পরিমান ১৮ হাজার কোটি টাকা । ভারতের সবচেয়ে বড় সরকারী ব্যাঙ্ক এস বি আই এর কাছে আদানি গ্রুপের ধারের পরিমানও প্রায় ২৭,০০০ কোটি টাকা , যার মধ্যে অর্ধেক পরিমানই জোর করে পাইয়ে দেওয়া বা নিয়ম বহির্ভূত। এই টাকা নিয়ে আদানি কি করছেন ? একের পর এক বিমান বন্দর , স্থল বন্দর , লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কিনছেন। ভারত সরকার দায়িত্ত্ব নিয়ে সেগুলো তুলে দিচ্ছে। প্রতিদিন দেশ সরকারী থেকে বেসরকারি হচ্ছে।   

শুধুমাত্র দেশেই নয়, বিদেশেও আদানি গ্রুপকে প্রসারে সরবচ্চ সহযোগিতা করছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। অস্ট্রেলিয়া , ইজরায়েল , বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা সর্বত্র। সবচেয়ে লজ্জার কথা বলেছিলেন শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি দেশের সংসদীয় কমিটিকে পরিস্কারভাবে জানান , তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ খোদ তাঁকে বলেছিলেন যে, আদানিকে বিদ্যুৎ প্রকল্প তুলে দিতে চাপ দিচ্ছেন মোদী নিজে। 

তিরিশের দশকের জার্মানি , ইতালি সাক্ষী কিভাবে ফ্যাসিবাদের প্রসারে একনায়ক ও তার পুঁজিপতি বন্ধু একযোগে কাজ করেছেন। ভারতে সেই কাজ করার জন্য আদানিকেই বেছে নিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। তাই একযোগেই এই রকেট গতির উত্থান দুপক্ষেরই। 

হিন্ডেনবার্গ এর বিরুদ্ধে আদানি গ্রুপের প্রেস ব্রিফের পরেও ব্যাপারটা যখন ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হয়নি তখন তারা মোট ৪১৩ পাতার একটা জবাবি বয়ান তৈরি করে হিন্ডেনবার্গ এর কাছে পাঠায়। মাত্র একদিনের মধ্যেই হিন্ডেনবার্গ আদানি গোষ্ঠীর জবাব প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা উত্তর দেয়। হিনডেনবার্গ বলেছে, আদানি গোষ্ঠীকে মোট ৮৮টি নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছিল। তারা ৬২টি প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ জবাবদিহির মধ্যে মাত্র ৩০ পৃষ্ঠায় তারা মূল বিষয়গুলোর অবতারণা করেছে। বাকি পৃষ্ঠায় রয়েছে অবান্তর সব বিষয়ের উল্লেখ। যেমন কীভাবে তারা নারীদের উদ্যোগী হতে সাহায্য করছে কিংবা কীভাবে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ভারতকে খাটো করার যে অভিযোগ হিনডেনবার্গের বিরুদ্ধে আদানি গোষ্ঠী এনেছে, সেটা খণ্ডন করে মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তাদের অভিযোগ নির্দিষ্ট এক সংস্থার বিরুদ্ধে। ভারতের বিরুদ্ধে নয়। ভারতের গণতন্ত্র প্রাণবন্ত।

সবচেয়ে মোক্ষম কথাটি বলা হয়েছে সবশেষে – ‘আমরা বিশ্বাস করি, ভারতের ভবিষ্যতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আদানি গোষ্ঠী। ভারতীয় পতাকায় শরীর ঢেকে তারা দেশকে লুট করে চলেছে।’