সাম্প্রতিক সময়ে ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের মাধ্যমে চারবছরের চুক্তির ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে  ‘অগ্নিবীর’নামে যে নিয়োগের প্রক্রিয়া কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়েছে,তা  ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিনত করবার লক্ষ্যে আর এস এসের  নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গঠন করবার যে দীর্ঘদিনের এজেন্ডা রয়েছে সেই  এজেন্ডাই পূরণ করা।১৯২৫সালে আর এস এস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই সংগঠনের উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারা এই সংগঠনের সামরিকীকরন নজর দিয়েছিল।৩০-র দশকে দশকে যখন বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে সেই সময় ফ্যাসিস্টদের সংগঠন কীভাবে পরিচালিত হয় তা দেখতে আর এস এসের প্রতিষ্ঠা লগ্নের গুরুত্বপূর্ণ নেতা বি.এস মুঞ্জের আসেন ইতালিতে(১৯৩১র ১৫ –২৫শে মার্চ তিনি রোমে ছিলেন)     নিছক বিদেশ ভ্রমণ নয় মুঞ্জেরের এই ইতালি ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল মুসোলিনির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা ।রোমে তিনি সেন্ট্রাল মিলিটারি স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন,মিলিটারি কলেজ,ফ্যাসিস্ট একাডেমি ,এভানগুয়ারদিস্তা, বাল্লিলার মতো ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসকদের সামরিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করেন।        

মুঞ্জের ইতালির এই সমস্ত সামরিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের কাজ প্রত্যক্ষ করবার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে ইতালির ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলির আদলে গড়ে তোলে আর এস এসের সংগঠন।মুঞ্জের কতখানি প্রভাবিত হয়েছিল ইতালির ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলির মাধ্যমে তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার নিজের লেখায় ,তিনি লিখেছেন “শান্তির চর্চা করতে গিয়ে ভারতীয়দের মতো ইতালিয়রাও যুদ্ধ বিদ্যাকে অবহেলা করেছে ।মুসোলিনি তাঁর দেশের এইসব দুর্বলতা লক্ষ করে বাল্লিলা সংগঠনের কথা ভেবেছেন।ইতালির সামরিকীকরনে এর চেয়ে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব নয়।ফ্যাসিবাদের ধারনা জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার ভাবনাকে স্পষ্ট প্রকাশ করে।ভারতে এবং বিশেষ করে হিন্দু ভারতের এইরকম সংগঠন প্রয়োজন হিন্দুদের সামরিক পুর্নজন্মের জন্য। আমাদের প্রতিষ্ঠান নাগপুরের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ অনেকটা এইরকম,যদিও এটা স্বাধীনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে।”    হিন্দু সম্প্রদায়ের সামরিকীকরনের উদ্দেশ্য নিয়ে মুঞ্জের এবং আর এস এস যে একযোগে কাজ শুরু করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের ১৯৩৩সালের নথি(Nai homepol department 88/33/1933)থেকে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে মুঞ্জের কর্তৃক আর এস এসকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা একইসঙ্গে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে-“এটা বলা বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না যে ,আরএসএস ভবিষ্যতে ভারতে ঠিক সেই ভূমিকা নিতে চায় যেমনটা ইতালিতে ফ্যাসিস্ট এবং জার্মানিতে নাৎসিরা নিয়েছে।”        ইতালি থেকে ফেরার কয়েক বছর পর মুঞ্জের শুরু করেন “ভোঁসলে মিলিটারি স্কুল “প্রতিষ্ঠার কাজ। এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করবার সাহায্য তিনি কিছু বৃত্তবান হিন্দু ব্যবসায়ীদের কাছে চিঠি লেখেন যেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন “এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য আমাদের ছেলেদের গণহত্যার খেলায় যোগ্য করে তোলা।শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ জয়ে নিজেদের রক্তপাত যত কম আর বিপক্ষের লোকক্ষয় বেশি হয় ততই ভালো।”(সূত্র:মুঞ্জে পেপার্স)        মুঞ্জের উল্লেখিত এই বিপক্ষ কারা তা কিন্ত স্পষ্ট করেনি মুঞ্জে বা আরএসএসের নেতারা।গোটা স্বাধীনতা পর্বে আরএসএসের ইতিহাস কার্যত ব্রিটিশদের প্রতি দালালির ইতিহাস ।স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও পর্বেই সংঘের নেতারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বা অহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়নি।তাহলে মুঞ্জের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল কাদের। আসলে মুঞ্জেরের লক্ষ্য ছিল উগ্র জঙ্গিবাদী সংগঠন গড়ে তোলা যারা নিবেদিত থাকবে হিন্দুদের একাংশের প্রতি (মূলত উচ্চবর্নের)সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজের প্রতি নয়।           

মুঞ্জের এক উগ্র হিন্দু জঙ্গি গোষ্ঠী গঠনের যে পরিকল্পনা নিয়ে “ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের “প্রতিষ্ঠা করেছিল !সেই পরিকল্পনা যে অনেকাংশেই সফল হয়েছিল তা জনসমক্ষে আসে ২০০৬সালে ‘নান্দেদ’ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার সময়।এই বিস্ফোরণ কান্ডে এটিস(মুম্বাই)এর জেরায় ভারতীয় নেভির একজন প্রাক্তন ক্যাপ্টেন সনত কুমার ভিট্টাল জানায় যে তাকে,নাগপুরে অবস্থিত ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলে নিয়োজিত করা হয়েছিল বজরংদলের কয়েকজন সদস্যকে বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। তার বয়ান থেকে আরও জানা যায় যে প্রশিক্ষণ চলাকালীন সে দুজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার এবং একজন ইন্টেলিজেন্স বিভাগের অফিসারকে দেখেন যারা এই ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন। বজরংদলের সদস্য হেমন্ত  পানসে এবং নরেশ রাজকোন্দার নান্দেদ বিস্ফোরণের সময় মারা যায়।মুম্বাই এটিস সূত্রে জানা যায় নান্দেদ বিস্ফোরণের বোমা এই দুজনেই তৈরি করেছিল।নাগপুরের ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের চেয়ারম্যান স্বীকার করেছিলেন যে ২০০১সালে তারা বজরংদলের সদস্যদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্পের ব্যবস্থার করেছিল। যদিও অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।     ভারতবর্ষের উগ্রহিন্দুত্ববাদের প্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিনয়ক দামোদর সাভারকর  ।যিনি ব্রিটিশদের জেলে বন্দি থাকবার সময় একাধিকবার মুচলেকা দিয়ে ব্রিটিশরাজের সেবা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের মুক্তি নিশ্চিত করেছিলেন। মতাদর্শগত ভাবে সাভারকার হিটলারের নাৎসিবাদকে সমর্থন করতেন।ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে সাভারকার বরাবরই উদ্যোগি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তার বিখ্যাত শ্লোগান ছিল “Hindus all politics and militaries Hinduism”।      সাভারকার প্রতিষ্ঠা করেছিল “অভিনব ভারত”নামে এক সংগঠন। তার প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের নাম  শিরোনামে উঠে আসে মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্ত প্রক্রিয়া চলার সময়।প্রসঙ্গত মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডের সময় এই সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন ছিনানি সাভারকার যিনি ছিলেন বিনয়ক দামোদর সাভারকরের নিজের নাতনি।     

মহারাষ্ট্রের নাসিকে অবস্থিত মালেগাঁও ২০০৬এবং ২০০৮ দুবার উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের সন্ত্রাসের শিকার হয়।২০১০সালে হরিদ্বার থেকে গ্রেফতার হন স্বামী অসীমানন্দ(মালেগাঁওকান্ডে যুক্ত থাকবার অভিযোগে)। এই গ্রেফতারির ঘটনার পর থেকে সামনে আসে ভারতবর্ষে গৈরিক সন্ত্রাস সৃষ্টির ব্লু প্রিন্ট। জানা যায় অভিনবভারত, বজরংদল,অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এবং আরএসএসের এই সন্ত্রাসে যুক্ত থাকার কথা।নাম আসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত,মেজর রমেশ উপাধ্যায় এবং অধুনা বিজেপি সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞার ।২০১১সালের ১৫ই জানুয়ারি হরিয়ানার পঞ্চকুলা জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বামী অসীমানন্দের স্বীকারোক্তি থেকে উঠে আসে ভয়ংকর তথ্য। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কিছু মেজর এবং কর্নেল সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সদস্যদের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো ,বিস্ফোরক নির্মানের প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিভিন্ন জঙ্গি কার্যকলাপ সংগঠিত করবার জন্য।     সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত দের কাজে লাগিয়ে রীতিমতো সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলি যেভাবে নান্দেদ থেকে মালেগাঁওয়ে নাশকতা চালিয়েছে তা আরএসএসের হিন্দুদের সামরিকীকরনের মাধ্যমে যে উগ্র হিন্দু জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করার যে এজেন্ডা সেই এজেন্ডাই প্রতিফলিত হয়েছিল।      

২০১৪সালে লোকসভা নির্বাচনে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি ক্ষমতায় আসায় আরএসএসের সুবিধা হয় তাদের উগ্রহিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা গুলি পূরন করবার ।জার্মানিতে হিটলার তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করার জন্য যেভাবে এস এ বাহিনীকে সামরিক পদ্ধতিতে সংগঠিত করেছিল এবং এস এস বাহিনী নামে আরও একটি বাহিনী গঠন করেছিল তেমনই এই স্বল্প মেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে “অগ্নিপথ প্রকল্পের”নামে যাদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হবে! আগামীতে বিজেপি তথা আরএসএস ভারতবর্ষে উগ্রহিন্দুত্ববাদী শাসন কায়েম করবার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে এই সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অগ্নিবীরদের। হিটলার জার্মানির শাসনভার করায়ত্ত করবার পর এস এস  বাহিনী হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য ।সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হতো।ইহুদী নিধন,গণহত্যা,ভয়ংকর অত্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে সন্ত্রস্ত করে রাখাই ছিল এই এসএস বাহিনীর কাজ।বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের দিকে তাকালে দেখা যাবে কর্পোরেটদের হৃদয়সম্রাট নরেন্দ্র মোদী দেশের সমস্ত সম্পত্তি তুলে দিচ্ছে আদানি আম্বানির মতো কর্পোরেটদের হাতে।দেশের বেকারত্বের হার  ক্রমশ ই বেড়েই চলেছে।রেল থেকে বীমা সমস্ত লাভজনক ক্ষেত্রগুলিকে ঢালাও বেসরকারি করন করা হচ্ছে কর্পোরেটদের স্বার্থে।২০০৭–০৮সালে বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার সময়েও ভারতের অর্থনীতির এতটা করুন দশা হয়নি ,যতখানি মোদীর শাসন কালে হয়েছে।টাকার দাম ডলারের তুলনায়  কমতে কমতে ১মার্কিন ডলার সমান ৮০টাকা হয়েছে।দেশের অর্থনীতির এই ক্রমবর্ধমান অধঃপতনেও হুশ ফেরেনি সরকারের। উল্টে রান্নার গ্যাস থেকে কেরোসিনের দাম প্রতিনিয়ত বাড়তে বাড়তে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো চাল ,মাখন থেকে মুড়ির উপর জিএসটি বসিয়েছে সরকার ।   

মোদী সরকার বিরোধী যেকোনও কন্ঠস্বরকে নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে।সাম্প্রতিক সময়ে সমাজকর্মী তিস্তা শীতলাবাদ সাংবাদিক জুবেরের গ্রেফতারি বা তার আগে জেল বন্দি অবস্থায় শারিরীক ভাবে প্রায় ৯০শতাংশ পঙ্গু  জি এন সাইবাবার উপর তীব্র অত্যাচার এবং জেলের অভ্যন্তরেই ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু সরকারের এই হিংস্র মনোভাবের ই পরিচয় দেয়।    কিন্ত আরএসএস জানে যে এইভাবেই তাদের শাসন টিকিয়ে রাখা যাবে না।জনগণ একদিন এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধেই পথে নামবেই।আর সে কারনেই প্রয়োজন জনগনকে আরও বেশি সন্ত্রস্ত করা তাদের ভিতর আতঙ্কের সৃষ্টি করা যাতে তারা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে সাহস না পায়।আর তার জন্যই প্রয়োজন হিটলারের এসএস বাহিনীর মতো সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত এক বাহিনী।অগ্নিপথ প্রকল্পের নামে চারবছরের চুক্তিতে যে অগ্নিবীরদের নিয়োগ করা হচ্ছে এই অগ্নিবীররাই হবে হিটলারের এস এস বাহিনীর মতো আগামীদিনে আরএসএসের সশস্ত্র বাহিনী।যাদের দিয়ে অস্ত্রের জোরে কায়েম রাখার চেষ্টা হবে বিজেপির শাসন ব্যবস্থার।     সারা দেশ ব্যাপী গণআন্দোলনের মাধ্যমে অগ্নিপথ প্রকল্প বাতিল না করানো গেলে দেশবাসীকে হিটলারের শাসনাধীন জার্মানির মতো এক ভয়ঙ্কর পুলিশী রাষ্ট্রের সম্মুখীন হতে হবে আগামী দিনে।