গত এক বছর ধরে চলল স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। কতটা অমৃতের স্বাদ দেশবাসী পেলেন এই এক বছরে? একটু অনুসন্ধান করা বোধহয় অনুচিত হবে না! দেশপ্রেমের ঠিকুজি নেওয়া চাড্ডিগণ কী বলেন?

      ব্রিটিশের ‘ভাগ করো ও শাসন করো নীতি’ (Devide & Rule Policy)-র কারণেই আমাদের গৌরবজনক স্বাধীনতা সংগ্রামে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হলাহল অনুপ্রবিষ্ট হতে পেরেছিল। গৌরবজনক এই কারণে যে, বিভিন্ন জাতি-উপজাতি-সম্প্রদায়ের মনে কোনও ভেদবুদ্ধি ছিলনা। তাদের সংগ্রামগুলিও ছিল প্রকৃত অর্থেই ঐক্যবদ্ধ। সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ এক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।  কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিটিশের কৌশল সফল হয় এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম দুর্বল হয় সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভাগাভাগিতে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ‘ Devide & Rule Policy-র প্রকট প্রকাশে এবং ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ক্ষেত্র নির্দ্ধারণে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’কে আইনসিদ্ধ করার কূট কৌশল সফল হল। এই ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ই ছিল হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তি। পরিণামে দেশভাগ ও বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে এল স্বাধীনতা। গঠিত হল ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র  হিসেবে আত্মপ্রকাশ  করলেও স্বাধীনতা প্রাপ্তির সেই ক্ষণে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল না। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণতন্ত্র রূপেই স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করল। রাগে,ক্ষোভে, হতাশায় হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি গান্ধীজীকে খুন করল। কারণ গান্ধীজী সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের বিভাজনের বিরুদ্ধে জীবনভর সোচ্চার ছিলেন। তাঁর এই ভূমিকা আরও ঘনীভূত হয় দেশ ভাগ ও স্বাধীনতা লাভের সময় সাম্প্রদায়িক শক্তির বর্দ্ধিত আস্ফালনের পটভূমিকায়। আজ অমৃত মহোৎসবের নামে জাতীয় পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে গান্ধীজী ও সাভারকারকে একাসনে বসানোর  হীন প্রচেষ্টায় সামিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আর এস এস পরিচালিত  বিজেপি সরকার। যা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনার সমগ্র ইতিহাসকেই ধ্বংস করার পথে নিয়ে যাচ্ছে।

        হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূ হিসেবে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ স্তরের ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসেছে। আর এই ক্ষমতার জোরে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভাঙছে অহরহ। এই সব ঘটনার পিছনে রয়েছে আর এস এস। কথায় বলে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আর এস এস মূল চালিকাশক্তি। বিজেপি তার নিয়ন্ত্রণাধীন রাজনৈতিক মঞ্চ। আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ তথা সংঘ পরিবারই এখন দেশের প্রশাসন, আইন, কানুনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার বাড়বৃদ্ধিতে বেড়ে ওঠে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা। সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা রূপ নেয় ফ্যাসিবাদের। আর সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা রূপ নেয় সন্ত্রাসবাদের।

        আর এস এস-এর ওপর জন্মলগ্ন থেকেই ইতালির ফ্যাসিস্ট নায়ক মুসোলিনীর চিন্তাধারা ও ভাবাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আছে। আর এস এস-এর জন্মলগ্নের আগে-পরে হিন্দুত্ববাদী পত্রপত্রিকাগুলিতে চলেছিল মুসোলিনী বন্দনা। যেমন, ১৯২৪ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে ‘কেশরী’ পত্রিকা ইতালি, সেখানকার ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনী সম্পর্কে নিয়মিত সম্পাদকীয় ও নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ১৯৩০-এর দশকের শেষদিকে ‘Hindu Outlook’ পত্রিকায় স্পেনের স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কো, মুসোলিনী ও হিটলারের প্রশংসাসূচক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। আর এস এস-এর আদর্শ ‘এক চালক অনুবর্ত্তিত্ব’ অর্থাৎ ‘এক নেতার প্রতি আনুগত্য’, মুসোলিনীর নীতি ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির তুলনায় একনায়কতন্ত্র জাতির পক্ষে অনেক বেশি উপযোগী ও সংহতি সহায়ক’-এর রূপান্তর মাত্র। ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনীর সঙ্গে ভারতের যে হিন্দুত্ববাদী নেতা প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করেন তিনি হলেন বি এস মুঞ্জে। যিনি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আর এস এস-এর সঙ্গে এবং তাঁকে আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের মন্ত্রগুরুও বলা হয়। ১৯৩১ সালের ১৫ থেকে ২৫শে মার্চ মুঞ্জে ইতালি সফর করেন এবং মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাত ও মতবিনিময় করেন। আর এস এস-কে ইতালিয় ফ্যাসিস্ট ধাঁচে গড়ে তুলতে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন এই মুঞ্জে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আর এস এস-এর সংগঠন পরিচালনার জন্য কোনও সংবিধান বা গঠনতন্ত্র নেই এবং সরসংঘচালক  বা সংঘপ্রধানকে নির্বাচিত হয়ে পদাসীন হতে হয় না। পূর্বসূরী নতুন প্রধানকে মনোনীত করেন। একটি সংগঠনের ফ্যাসিস্ট কাঠামোর এ এক চূড়ান্ত নিদর্শন।

      এছাড়া ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও পরবর্তী সময়ে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে Italian Institute for the Middle and Far East-এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের যোগাযোগের আর একটি দৃষ্টান্ত  দামোদর বিনায়ক সাভারকারের উক্তি ও ভাষণ। ১৯৩৭-এ জেল থেকে ছাড়া পাবার পরেই সাভারকার হিন্দু মহাসভার সভাপতি হন এবং ওই পদে আসীন ছিলেন ১৯৪২ পর্যন্ত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ইতালি, জার্মানি ও জাপানের অক্ষশক্তিকে হিন্দু মহাসভা সহ হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি স্বাগত জানায়। সেই সময় সাভারকার বিভিন্ন সভায় ভাষণের পর ভাষণে হিটলারের ইহুদি নির্যাতনের নীতিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আর এস এস-এর তাত্ত্বিক গুরু এবং সরসংঘচালক হিসাবে হেডগেওয়ারের উত্তরসূরী এম এস গোলওয়ালকর তাঁর পুস্তিকা We or our Nationhood Defind-এ জার্মান জাত্যাভিমান প্রসঙ্গে আলোচনায় লিখেছেন, ‘নিজেদের জাতি ও তার কৃষ্টির অকৃত্রিমতা বজায় রাখার লক্ষ্যে তারা দেশ থেকে সেমিটিক জাতি ইহুদিদের উন্মুলনের পথ নিয়েছে। জাতিগত অহং এখানে তার শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করেছে। জার্মানি এটা দেখিয়েছে যে, ভিন্ন ধাতের জাতি ও কৃষ্টির পক্ষে একটা ঐক্যবদ্ধ সমগ্রের মধ্যে মিশে যাওয়া অসম্ভব। হিন্দুস্থানের এই শিক্ষা নিয়ে, সেইমতো চলা উচিৎ’। গোলওয়ালকর ‘রাষ্ট্র মীমাংসা’ পুস্তিকায় হিটলারের ভাবাদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হবার কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। তাঁর কাছে সব চাইতে আকর্ষণের বিষয় ছিল ইহুদিদের প্রতি নাৎসিদের নির্মম আচরণ। ইহুদিদের উৎখাতের ঘটনার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের তুলনা টেনে একইভাবে মুসলিমদের এদেশ থেকে বিতাড়নের কথা জোর গলায় বলতে থাকেন।

       আর্য রক্তসম্পন্ন জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় হিটলারের বক্তব্য, ”আর্যরাই কেবল মানুষ শব্দটির প্রতিনিধিত্ব করে” এবং “ইহুদিরা আর্যদের থেকে সবচাইতে বেশি বিপরীত ধরনের”। গোলওয়ালকর ‘বাঞ্চ অব থটস্’-এ বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণ শিরোদেশ, নৃপতি হস্তযুগল, বৈশ্য উরু ও শূদ্র পদদ্বয়’। তিনি ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইণ্ড’ পুস্তিকায় বলেছেন, ‘আমরা হিন্দুরা বিদেশী জাতি এই দেশে হানা দেওয়ার আগে আট এমনকি দশ হাজার বছরেরও বেশি কাল ধরে শান্তিতে, নির্বিরোধে এ দেশের দখল নিয়ে আছি, আর তাই, এই দেশের পরিচয় হিন্দুস্থান, অর্থাৎ হিন্দুরা যে দেশে থাকে।’ গুরু গোলওয়ালকর ও ‘গুরুর গুরু’ হিটলারের মধ্যে চিন্তার কত মিল!

       এছাড়া নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে হিটলারের ও গোলওয়ালকরের অবস্থান একই রকম। হিটলারের বক্তব্য ছিল নারীর স্থান হল রান্নাঘর। হিটলারি  জমানায় জার্মান জাতির জন্য স্বাস্থ্যবান পুত্র অর্থাৎ ‘ভবিষ্যত সৈনিক’-এর জননী হওয়াই নারীর জীবনের লক্ষ্য বলে নির্দ্ধারিত হল। হিটলারের আহ্বান ছিল, ”ছোট্ট মেয়ে মনে রেখ যে তুমি একদিন হবে জার্মান মাতা’। নারীদের সম্পর্কে গোলওয়ালকরের বিধান—‘শৈশবে নারী পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর ও স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রের। উহার পক্ষে স্বনির্ভর হওয়া বিধেয় নহে’।

      ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অদম্য যোদ্ধা জর্জ ডিমিট্রভ ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিবাদীরা জনসাধারণকে চরম দুর্নীতিপরায়ন, বিষাক্ত লোকজনদের করুণার হাতে সঁপে দেয়। অথচ তাদের কাছে হাজির হয় একটি সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকারের দাবি নিয়ে। জনসাধারণের গভীর বিতৃষ্ণার মনোভাবকে তারা এইভাবে কাজে লাগায়। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা নানা ভড়ং গ্রহণ করে। বিপুল সংখ্যক পেটি বুর্জোয়া এমনকি বঞ্চনাগ্রস্ত, হতাশা, বেকারি এবং জীবনধারণের অনিশ্চয়তার শিকার শ্রমজীবী জনসাধারণের একটি অংশও ফ্যাসিবাদের উগ্র দেশপ্রেমী গরম গরম বুলির শিকারে পরিণত হয়।’ এই ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে দেড় দশক আগে বিজেপির আলাদা ধরনের পার্টি (Party with a difference) উপহার দেবার দাবি কিংবা ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর সুদিন আনার প্রতিশ্রুতি বর্ষণকারী তুখোড় ভাষণের কথা।

       জর্জি ডিমিট্রভ বলছিলেন,  ‘ফ্যাসিবাদ কাজ করে পরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে, কিন্তু জনগণের কাছে হাজির হয় ভ্রান্ত জাতীয় ধ্যানধারণা নিয়ে এবং উগ্র হিংসাত্মক চেতনাকে উস্কে দিয়ে।’ ফ্যাসিবাদের এহেন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় গোলওয়ালকরের কলম নিঃসৃত সত্যিকারের জাতীয়তাবোধের পরিবর্তে আর এস এস মার্কা জঙ্গি জাত্যাভিমানকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায়—‘হিন্দুস্থানের বিদেশী জাতিরা হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করুক, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করুক, সম্ভ্রমের স্থান দিক, হিন্দু বর্ণ ও সংস্কৃতিকে গৌরবান্বিত করা ছাড়া অন্য সব ধ্যান বিসর্জন  দিক, তাদের স্বতন্ত্র সত্তা ছেড়ে হিন্দুবর্ণে মিশে যাক। নতুবা হিন্দু জাতির আজ্ঞাধীন হয়ে, কোনওরকম দাবি, কোনও বিশেষ সুবিধা, অগ্রাধিকার তো দূরের কথা, নাগরিক অধিকারও দাবি না করে বাস করুক। তাদের জন্য অন্য কোনও ব্যবস্থা থাকা উচিত  নয়। আমরা এক প্রাচীন জাতি। এদেশে বাস করতে ইচ্ছুক বিদেশী গোষ্ঠীর জন্য আমরা প্রাচীন জাতির উপযুক্ত আচরণই  করব।’ সেই প্রাচীন জাতির আচরণ হবে গোলওয়ালকরের ভাষ্য অনুযায়ী ফ্যাসিবাদ অনুপ্রাণিত—‘জাতির বিশুদ্ধতা ও তার সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে জার্মানি সেমিটিক জাতি ইহুদিদের বহিষ্কার করে সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল। এখানে জাত্যাভিমান তার তীব্রতম রূপে প্রকট। জার্মানি দেখিয়ে দিয়েছে যে, মূলেই যারা পৃথক, সেই জাতি, সংস্কৃতিকে অভিন্ন সত্তায় সমন্বিত করা প্রায় অসম্ভব। হিন্দুস্থানে আমরা আমাদের হিতার্থে এ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পারি।’ ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যায় ডিমিট্রভ আরও বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিস্টরা চরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে, কিন্তু জনগণের সামনে হাজির হয় বঞ্চিত জাতির মুখোশ প’রে,আহত জাতীয় আবেগে ঘা দিতে।’ গোলওয়ালকরের রচনায় হিন্দুরা বঞ্চিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে এই মর্মে মিথ্যা চেতনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা পরিস্ফূট হয়ে ওঠে এবং এর জন্য মুসলমানদের দায়ী সাব্যস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রতিভাত হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে এক্ষেত্রে আর এস এস-কে বীর বা ত্রাতার বেশে হাজির করার চেষ্টা দেখা যায়।

            এই আর এস এস পরিচালিত বিজেপির সরকারের একমাত্র অ্যাজেণ্ডা তাই ধর্মীয় বিভাজন ঘটানো ও সেই অস্ত্রে জন ঐক্য ধ্বংস করে কর্পোরেট ও লগ্নি পুঁজির শোষণকে জমজমাট করা। ‘সুদিন’ ইত্যাদি গালভরা ভালো ভালো ভাষণ দিয়ে আজ তারা সবদিক থেকেই তাদের ফ্যাসিবাদী রূপ প্রকট করেছে। ওষুধ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য অগ্নিমূল্য, গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ, বিরোধী দলের নেতাদের নেই কোনও মর্যাদা, কথায় কথায় বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করা, (এমনকি রাহুল গান্ধীকেও ছাড়ছে না), সংসদের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া, প্রধানমন্ত্রীর বেশিরভাগ সময়ে সংসদে না আসা, প্রশ্নের জবাব না দেওয়া, অনবরত বড়ো বড়ো আত্মম্ভরী কথা, বিরোধী দল ও নেতৃত্বকে আক্রমণ করা কীসের ইঙ্গিত? ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি নয়? গুরু গোলওয়ালকরের দেখানো পথেই কি হাঁটছেন না মোদী-অমিত শাহরা? আর তার সাথে আম্বানী-আদানি সহ কর্পোরেট স্বার্থে চলছে লুট। সেই লুটের ইজারা নিয়েছে মোদীর সরকার।

         মণিপুরের ঘটনায় সারা দেশ উত্তাল হয়েছে। ফ্যাসিবাদীরা  নারীকে যে দৃষ্টিতে দেখে তারই প্রতিফলন ঘটেছে মণিপুরের মা-বোনদের ওপর শতাব্দীর জঘন্য ও বর্বরতম ঘটনায়। এর সঙ্গে রয়েছে মেইতেই ও কুকিদের  মধ্যে দিনের পর দিন জাতিদাঙ্গা জিইয়ে রাখার নোংরা কৌশল। এই সবকিছুর জন্য দায়ী বিজেপির তথাকথিত ডবল ইঞ্জিন সরকার। যার জন্য গর্বোদ্ধত বাগাড়ম্বর করতেন স্বয়ং মোদী। আর সবকিছুর ওপরে রয়েছে মণিপুরের বহুমূল্য খনিজ সম্পদের অবাধ কর্পোরেট লুট চরিতার্থ করতে ‘এলোমেলো করে  দে মা লুটেপুটে খাই’ মনোভাবে দাঙ্গার আগুন লাগানো।

      এরা নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে পাত্তা দেয়নি দলিত হবার কারণে। একই কারণে নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটনে ব্রাত্য রইলেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। এরা এদের ভাবাদর্শ চরিতার্থ করতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধানকেও রেয়াত করেনা। বিজেপি আসলে মুখে দলিত প্রীতি দেখায়, তাদের হয়তো পদেও বসায় কিন্তু মর্যাদা দেয় না। আসলে এরা মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী। তাই দলিত, আদিবাসীদের শত্রু। কারণ ওদের দর্শন অনুযায়ী শূদ্রের অবস্থান ব্রম্ভার পায়ের তলায়। এরা নিজেরা ব্রিটিশদের চাটুকারিতা করেছে, আর ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’, ‘ঘর ঘর তিরঙ্গা’ বলে বাজার গরম করছে। অথচ লিখিতভাবে আর এস এস-এর ডকুমেন্টে আছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাকে ওরা মানেনা।

     তাই নিবন্ধের ইতি টানব এই বলে যে, অমৃত মহোৎসব আসলে লোকঠকানো, চোখভোলানো কথা। অর্থনৈতিক নীতি, বিদেশনীতি, সংবিধানের মর্যাদা,গণতন্ত্র রক্ষা, মণিপুর, হরিয়ানা, কালা ইউ এ পি এ আইন, দেশদ্রোহী তকমা লাগানো, বুলডোজার নীতি সব সব সবকিছুই প্রমাণ করছে দেশজুড়ে কেবল হলাহলই ছড়িয়ে দিচ্ছে  ওরা ফ্যাসিবাদী কায়দায়। ওদের পরাস্ত করতেই হবে। সবাইকে জোট বাঁধতে হবে। এটাই এবারের স্বাধীনতা দিবসের আহ্বান হোক। স্বাধীনতা দিবসের আহ্বান হোক এই ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করতে চায় যে সিঁধেল চোরেরা নিজেদের স্বার্থে, তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকার। দোদুল্যমানতা দিয়ে এ লড়াই জেতা যাবে না। দোদুল্যমানরা সাবধান, দোদুল্যমানদের থেকে সাবধান।