প্রত্যাশা মতই আনিস খানের হত্যাকাণ্ড ঘিরে রাজ্য সরকারের তৈরি বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট ‘, তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে। শব্দটা ‘প্রত্যাশা মত ‘ বলা হলো এই কারণে যে, এই বিশেষ তদন্তকারী দল কি প্রতিবেদন দিতে পারে, তার ভাষা , আমরা আনিস খানের হত্যাকাণ্ডের অব্যবামহিত পরে রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসক শিবিরের কর্তা ব্যক্তিদের অভিব্যক্তি থেকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।
প্রথম থেকেই রাজ্য সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা এবং তার বসংবদ পুলিশ, আনিস খানের গোটা হত্যাকাণ্ড টিকে ‘একটি দুর্ঘটনা’ বলে চালাতে চাইছিল। একদম প্রথমে তো আনিস খানের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে পুলিশ গিয়েছে ,এই কথাটাই পুলিশ বা রাজ্য সরকার কেউ স্বীকার করতে চাইনি। পরবর্তী সময়ে তারা জনমানুষের চাপে, রাত্রিবেলা আনিস খানের বাড়িতে জোর করে পুলিশের ঢোকা ,আনিস খানের বাবার বুকে বন্দুক ধরে একদম ডাকাতির কায়দায় আনিসের আব্বার উপর চড়াও হওয়া ,কার্যত এই সমস্ত কিছুই প্রকারান্তরে স্বীকার করেছে রাতের অন্ধকারে আনিসের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল এই স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়ে।
অর্থাৎ ; প্রথম থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছিল; এনআরসির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যা ঘিরে রাজ্য সরকার ,তাদের পুলিশের অপকর্ম কে আড়াল করবার জন্য অতিমাত্রায় উদগ্রীব ।তাই ই একের পর এক মিথ্যে ।একটা মিথ্যে কে আবার জাস্টিফাই করতে আরেক ধরনের মিথ্যে, এই মিথ্যের বেশাতি শুরু করেছিল। বিষয়টি নিয়ে প্রবল জন-আন্দোলন হয়েছে। বামপন্থী ছাত্র যুব থেকে শুরু করে সমস্ত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘিরে সোচ্চার হয়েছেন। রাজ্যের পরিমণ্ডল কে অতিক্রম করে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সর্বভারতীয় সংবাদের শিরোনাম পর্যন্ত হয়েছে।
আনিসের পরিবারের প্রথম থেকেই রাজ্য সরকার নিয়োজিত বিশেষ তদন্তকারী দলের তদন্তের উপরে কোন আস্থা ছিল না। তাঁরা মনে করেছিলেন, রাজ্য সরকারের পুলিশের হাতেই নিহত হয়েছেন আনিস খান। তাই সেই পুলিশ, নিজেদের কৃতকার্যের সঠিক তদন্ত করবে, এটা আনিস খানের পরিবার কখনোই মনে করেন নি। আনিস খানের পরিবারের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আনিসের সহযোদ্ধারা সকলেই একমত ছিলেন আনিসের পরিবারে মানুষদের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গিয়ে সি পি আই(এমে) র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ,আনিস হত্যার বিচার চেয়ে শেষ তক এই রাজনৈতিক আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন।আনিসের কবরের মাটি হাতে ‘ ইনসাফে’ র শপথ তিনি নিয়েছিলেন।
আনিসের পরিবার চেয়েছিল সিবিআই তদন্ত ।তাঁরা এই নিয়ে হাইকোর্টে লড়াই পর্যন্ত করেছেন। হাইকোর্ট সিটের উপর ভরসা রাখায়, হাইকোর্টের সেই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আনিসের পরিবার যে সহমত পোষণ করতে পারেন নি সেই কথা আমরা সংবাদ মাধ্যমের ভেতর দিয়ে জেনেছি।
অবশেষে সিটের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রত্যাশা মতই গোটা হত্যাকাণ্ড টিকে’ একটি দুর্ঘটনা’ বলে রাজ্য সরকারের নিয়োজিত বিশেষ তদন্তকারী দল ,রাজ্য সরকারের ভাবনাকেই, রাজ্যের শাসকদলের ভাবনাকেই শিল মোহর দিয়েছে। বিশেষ তদন্তকারী দলের এই প্রতিবেদনের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই আনিসের বাবা বা তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন বা গোটা বিষয়টি নিয়ে রাজ্য জুড়ে আন্দোলনরত বামপন্থীরা সহমত পোষণ করতে পারেন নি।
আনিস হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই রাজ্য সরকার, রাজ্যের শাসকদলের মানসিকতা থেকে এটা খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ,এন আর সির বিরুদ্ধে আনিসের যে আন্দোলন ,তা কেন্দ্রের শাসক বিজেপি কে একটা প্রচন্ড রকমের অসুবিধে জনক জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছিল। আরএসএস – বিজেপির যৌথ বিভাজনের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির বিরুদ্ধেই আনিস প্রথম থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেও তাঁর যে কর্মকাণ্ড ,সেখানেও এই বিশ্ববিদ্যালয় টিকে অকেজো করে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের যে পদক্ষেপ , তার বিরুদ্ধে আনিস লড়াই করেছেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ,বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্য অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের যে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, যার বিরুদ্ধে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন, সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীর ভূমিকা আনিস খান পালন করেছেন ।
মুসলমান সমাজের ভেতরে সার্বিক অর্থ- সামাজিক -রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক সচেতনতা কে সুতীব্র করতে , কেবলমাত্র কলকাতা মহানগরীর বুকেই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও আনিস এবং তাঁর সহযোদ্ধারা যে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করেছেন, সেই সামাজিক ভূমিকা, ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক মৌলবাদী আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ও তাদের একান্ত সহযোগী প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসকে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে। মুসলমান সমাজের তথাকথিত ‘ মসিয়া’ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছদ্মবেশধারী ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে আনিস খান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।
মুসলমান সমাজের আর্থ- সামাজিক উন্নতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত যে একটি পদক্ষেপ নেননি, সে কথা আমজনতাকে বোঝানোর ক্ষেত্রে আনিস খানের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। মুসলমান সমাজকে ধর্মনিষ্ঠা নয়, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ধর্মান্ধতার কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত করবার জন্যে কি ভয়ংকর রাজনৈতিক চক্রান্ত ,মুসলমান সমাজেরই একটা কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল কে ব্যবহার করে ,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করে চলেছেন ,তা বোঝানোর ক্ষেত্রে আনিস খান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি, বিশেষ করে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, নানা ধরনের কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা , নারী শিক্ষা – কোন প্রশ্নই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ ১২ বছর ধরে রাজ্য সরকার পরিচালনা করে একটি পদক্ষেপও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেননি– এটা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে আনিস খান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলেছিলেন।
আনিস খান যাতে আরেকটি আনিস খান তৈরি করতে না পারেন, হাজারটা আনিস খান তৈরি করতে না পারেন, সেই জন্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রয়োজন ছিল আনিস খানকে হত্যা করা ।আর সেই কাজটা তাঁরা তাঁদের সুশৃংখল গুন্ডাবাহিনী ‘পুলিশ’ কে দিয়ে করিয়েছে। পরবর্তীতে পুলিশের সেই বর্বরোচিত ভূমিকা কে আড়াল করবার জন্য ,খোদ রাজ্যের শাসক দল আদা জল খেয়ে নেমে পড়েছে।
এই সমস্ত ঘটনাকেই আড়াল করে গোটা হত্যাকাণ্ডটিকে একটি ‘দুর্ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই রাজ্য সরকার সিট তৈরি করেছিল। আর সিটের কর্মপদ্ধতি কি হবে ,তা তদন্তের আগেই তদন্তের ফল প্রকাশের অনেক আগেই ‘ দুর্ঘটনা তত্ত্বে’ ভেতর দিয়ে রাজ্য সরকার বা রাজ্যের শাসক দল বুঝিয়েছিল। অর্থাৎ ; আনিস যে পুলিশের দ্বারা নিহত হন নি , আনিসের মৃত্যুটি যে একটি নিছক ‘দুর্ঘটনা’ এইটা তদন্তের আগেই রাজ্য সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা, পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসারেরা বলে দিয়ে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াটি কে প্রভাবিত করেছিলেন ।
স্বভাবতই শাসকের সেই সিদ্ধান্তকে সীলমোহর দিয়েছে বিশেষ তদন্তকারী দল ।শাসকের এই সিদ্ধান্ত বিশেষ তদন্তকারী দলের সীলমোহর দেওয়ার প্রবণতার পাশেই এই প্রশ্নটি থেকে যায় যে, আনিসের মৃত্যুটি যদি নিছক দুর্ঘটনার পলেই ঘটে থাকে, তাহলে একজন নাগরিক দূর্ঘটনাগ্রস্থ হয়ে, মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে, তবুও তাঁকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ,পুলিশ কি করে আনিসের বাড়ি থেকে চলে যায় ? আনিস কি কোন দাগি অপরাধী, দাগি আসামি ছিল ?যে কারণে গভীর রাত্রে তাঁর বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়?
আসলে এন আর সি ,সি এ এ, এন পি আর ইত্যাদির মাধ্যমে মুসলমান সমাজকে ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করবার যে নগ্ন ষড়যন্ত্র হিন্দু আধিপত্যবাদীরা করেছে ,সেই ষড়যন্ত্রের একটি অঙ্গই হলো তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পুলিশের দ্বারা সুসংগঠিত ভাবে আনিস খান হত্যা ।আনিস খানকে হত্যা করার ভেতর দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরএসএস – বিজেপিকে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের বুকে এনআরসি নিয়ে, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ,এনপিআর নিয়ে যদি কোন সহ নাগরিক মুসলমান প্রতিবাদে সামিল হয় ,তাহলে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ইত্যাদিতে ও মুসলমান সমাজের মানুষদের যে পরিণতি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গেও সেই পরিণতি হবে।
আনিস খান হত্যাকাণ্ডের পর গোটা ব্যাপারটিকে একটা সাম্প্রদায়িক অভিমুখে ঠেলে দেওয়ার কম চেষ্টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার করেনি।, রাজ্যের সচেতন মানুষ বামপন্থীদের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ,রাজ্যের শাসকদের সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করবার একটা শক্ত জমি তৈরি করতে পেরেছেন ।তাই আজ আনিস খানের হত্যাকাণ্ড ঘিরে জনমানুষের বিক্ষোভকে আরো সুতীব্র গণআন্দোলনে আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কেবলমাত্র মুসলমান সমাজ নয়, গোটা ভারতের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ ই আজ সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তির পরিবর্তিত রূপ ,সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদী আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এবং তাদের একান্ত সহযোগী প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি প্রতিভূ তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বস্তরের আক্রমণের প্রথম এবং প্রধান টার্গেট।