আসুন একটা গল্প বলি। সিনেমা শুরুর আগে যেমন ডিসক্লেইমার দেওয়া থাকে নাম চরিত্র বা ঘটনাবলীর সাথে কোন মিল পেলে তা নেহাতই কাকতালীয়, আসলে এটা নিতান্তই একটি গল্প৷ গল্পের শুরু বছর পনেরো আগে। চাকুরিসুত্রে কলকাতার তিন বাঙালি যুবক তখন ব্যাঙ্গালোরে। পেশা আলাদা হলেও নেশা তাদের অভিন্ন। যেই সুত্রেই বন্ধুত্বে পাক লাগল। গান, সিনেমা লেখালেখি নিয়ে তাদের স্বপ্ন দেখা শুরু হল। অনেকেই এমন স্বপ্ন দেখে রুজি রুটির পেছনেই জীবন কাটিয়ে দেয় কিন্তু এরা ছিল অন্য ধাতুতে গড়া৷ এদের মধ্যে একজন একটা স্ক্রিপ্ট লিখে তৎকালীন বাংলা ছবির কেষ্ট বিষ্টুদের বাড়ি হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিলো। ইন্ডাস্ট্রির এক নাম্বার হিরো সেই সময় একটু চাপে ছিলেন। সময়টাও ছিল একটু খটোমটো। বামফ্রন্ট তখন অস্তগামী সূর্য। ডোবার অপেক্ষায় দিন গুনছে। এদিকে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বেনোজলের মত ঢুকছে চিটফান্ডের টাকা। টেকনোলজিতেও আসছে বড়সড় পরিবর্তন। সিনেমা ফিল্ম ছেড়ে ঢুকছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। ক্যামেরা বদলে যাচ্ছে। বড় ইনভেস্টমেন্ট যেমন লাগছে তেমনই ফিল্মের র স্টকের খরচ কমে যাচ্ছে ডিজিটাল হওয়ার জন্য। এক নাম্বার হিরোর মারদাঙ্গা ডায়লগবাজির কমার্শিয়াল ছবিগুলো বক্স অফিসে আশানুরূপ সাফল্য পাচ্ছিল না। তার থেকে এক হাত লম্বা আর দু যুগ কম বয়েসি একটা ছিপছিপে ছেলে সরল হাসি দুর্দান্ত নাচ আর তুতলিয়ে ডায়লগ ডেলিভারি করেও বাজারে জনপ্রিয় হচ্ছিল। কমার্শিয়াল ছবি থেকে সরে কম বাজেটের আরবান মাল্টিপ্লেক্স নির্ভর ছবিতে যাওয়ার জন্য একটা মাধ্যম খুঁজছিলেন ইন্ডাস্ট্রির এক নাম্বার হিরো।

ব্যাঙ্গালোর থেকে আসা ঝকঝকে স্মার্ট ছেলেটির স্ক্রিপ্ট হিরোর কাছেও এলো৷ ওনার অনেক দিনের শখ ছিল মহানায়ক উত্তমকুমারের জুতোয় পা গলানোর। তা উনি পড়ে দেখলেন এ হল সত্যজিৎ রায়ের নায়ক সিনেমার রিমেক! তখনও ইন্ডাস্ট্রি অঞ্জন চৌধুরী আর তার হাতে তৈরি সহকারীদের গ্যাদগ্যাদে মেলোড্রামার ল্যাগসি বহন করছিল উনি এই স্মার্ট যুবকের উপর ভরসা রেখে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিলেন প্রযোজকের অফিসে। প্রযোজক ভ্রাতৃদ্বয় স্ক্রিপ্ট রিডিং সেশনেই বুঝে গেলেন এই ছোকরা সত্যজিৎ রায় আর বিশ্বসিনেমা গুলে খেলেও সিনেমা মেকিং এর বিন্দুবিসর্গ বোঝে না। তারা তাকে প্রস্তাব দিলো এই স্ক্রিপ্ট নিয়ে অন্য কোন ডিরেক্টর এর হাতে ছবিটা বানানো হোক৷ কিন্তু ছেলেটি গোঁ ধরে রইল না ছবিটা সেই ডিরেক্ট করবে আর তার ব্যাঙ্গালোরের বন্ধুদের বাঁধা সুর করা গান তাতে ঢোকাবে। সেই সময় ওই প্রডিউসারদের অফিসে বিদগ্ধ চিত্রপরিচালক অপর্ণা আন্টির একটি ছবির প্রি প্রোডাকশনের কাজ চলছিল। প্রযোজক ভ্রাতৃদ্বয় ছেলেটিকে হাতেকলমে কাজ শেখার জন্য সেই ইউনিটে এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে ঢুকিয়ে দিলেন৷অন্য বন্ধুটি অপর্ণা আন্টির মিউজিক ডিরেক্টর দেবুদার সাথে এ্যাসিস্ট করার জন্য ঢুকলো। পিড়িংপিড়িং গিটার বাজিয়ে গান করলেই তো হবে না ছবিতে সুরারোপ করার টেকনিক্যাল দিকগুলোও তো শিখতে হবে নাকি!

দিন যায় দিন আসে। একদিন আমাদের গল্পের ছেলেটির ও দিন এলো। হিরো ডেট দিলো শুটিং শুরু হল। প্রযোজক ভ্রাতৃদ্বয় তাদের হাউজের বাছাই করা টেকনিশিয়ান আর সেট আপ ছেলেটার সাথে দিয়ে ছবিটা বানিয়েও ফেলল। কথামত তার বাকি দুই বন্ধুর গানও ছবিতে রইল কিন্তু ছবির সংগীত পরিচালক হিসাবে নাম গেলো দেবুদার। আশ্চর্যজনক ভাবে ছবিটা বাংলা বাজারে বিশাল হিট হয়ে গেল৷ ডিরেক্টর হিসাবে নতুন আসা ছেলেটির গাড়িও চলতে শুরু করল। যদিও সমালোচকরা বলল নায়কের জঘন্য রিমেক আর ততোধিক জঘন্য অভিনয়। শুধুমাত্র গানগুলোর জন্যই ছবিটা হিট হয়েছিল।অপর দুই বন্ধুর একজন তার প্রতিভার জোরে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে গেল৷নিয়মিত গান লিখতে লাগল সুর বসাতে লাগল। অপরজন হতাশা আর মানসিক যন্ত্রনায় ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে একদিন সুইসাইড করলো৷
এসব কবেকার কথা। সবাই ভুলেই গিয়েছিল।হেরে যাওয়া মানুষের কথা কেই বা মনে রাখে! হঠাৎ করে ফেসবুকে কেচ্চা ঘাঁটতে ঘাঁটতে আর স্ল্যান্ডার করতে গিয়ে ভেসে উঠল সেই হেরো ছেলেটির গল্প। আমিও এই সুযোগে গল্পটা লিখে ফেললাম।