দিল্লির আম আদমি পার্টি সরকারের মুখ‍্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আবগারি দুর্নীতির অভিযোগে প্রথমবার হাজির হয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অছিলায় গত ২১শে মার্চ ইডি গ্রেফতার করায়, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরোধী কন্ঠস্বরকে রুদ্ধ করার প্রবণতাই আবার ধরা পড়ল। ৩১শে জানুয়ারি সামরিক বাহিনীর জমিকে কেন্দ্র করে বেআইনি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে একইভাবে ঝাড়খণ্ডের পদত‍্যাগী মুখ‍্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে ইডি গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতার করা হতে পারে আঁচ করেই একদিন আগেই ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রধান মুখ‍্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নির্বাচিত সরকারের ওপর দুর্নীতির তদন্তের অজুহাতে এভাবে চাপ তৈরি করার পিছনে কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের দুর্নীতি দমনের সদিচ্ছা আদৌ কতটুকু রয়েছে তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয় যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মণ্ড হারবারের বিদায়ী সাংসদ অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কে গ্রেফতার না করার জন‍্য এবং তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দেওয়ার চেষ্টা দেখে। অথচ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি,গোরু পাচার,কয়লা পাচারে বেআইনিভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে ইডি সিবিআই এর মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাই তদন্ত করছে। স্বভাবতই ঘাসফুল পদ্মফুলের সেটিং এর কথা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। প্রশ্ন ওঠে, এই কারণেই কি I.N.D.I.A মঞ্চের বোঝাপড়ার বাইরে বেরিয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিয়াল্লিশটি আসনে একাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব‍্যানার্জী?

প্রতিশোধের রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিশোধের মধ‍্যে তফাৎ বড়ো সূক্ষ। প্রতিশোধের রাজনীতির সহজতম রাস্তা হল পুলিশ ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের হেনস্থা করা। অন‍্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ কোন ইস‍্যুকে কেন্দ্র করে প্রধানত নির্দিষ্ট কৌশলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করার দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। হিমাচল প্রদেশে সরকারের বিরুদ্ধে আনা আস্থাভোটকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের এম এল এ দের কয়েকজন কে দলে টেনে সরকার ভাঙবার চেষ্টা করেছিল বিজেপি। সেখানকার বিধানসভার অধ‍্যক্ষ কুলদীপ সিং পাটনিয়া এবং মুখ‍্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখুর তৎপরতার জন‍্য সরকারের পতন আপাতত রুখে দেওয়া গেলেও বহিষ্কৃত কংগ্রেস ও নির্দল বিধায়কদের দলে টেনে নিয়ে তাঁদের কেন্দ্রে দ্রুত উপনির্বাচন করানোর চেষ্টা করছে বিজেপি। INDIA মঞ্চের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে প্রতিমূহুর্তে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া আম আদমি পার্টির মুখ‍্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করার আগে তাঁর সরকারের উপমুখ‍্যমন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়া এবং আপের রাজ‍্যসভার সাংসদ সঞ্জয় সিংকে এই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অপরাধে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

অসাংবিধানিক নির্বাচনী বণ্ড কেলেঙ্কারিতে পিছু হটছে বিজেপি। কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে তারা যে নির্বাচনী বণ্ডের মাধ‍্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলেছে তা জনসমক্ষে চলে আসার পরে মুখ বাঁচানোর জন‍্য যুৎসই কোন বিবৃতি দিতে পারেন নি অমিত শাহ। ফলে আপাতত দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করার রাজনৈতিক অবস্থান কে প্রতিষ্ঠিত করার জন‍্য অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারিকে হাতিয়ার করতে চেয়েছে বিজেপি। কিন্তু বিতর্ক তো সেখানেও। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পপতি শরৎ চন্দ্র রেড্ডি নিজেই আবগারি কেলেঙ্কারির অন‍্যতম অভিযুক্ত। ওষুধ প্রস্তুতকারক একটি সংস্থাও রয়েছে তাঁর। নির্বাচনী বণ্ডের মারফত বিজেপির তহবিলে টাকা দেওয়ার পরেই শরৎ রেড্ডি কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী হিসাবে সরকারের পক্ষ থেকে চিহ্নিত হয়ে যান। আমাদের মনে পড়ছে অসমের বিজেপি বর্তমান মুখ‍্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে কৃষিজমি কেলেঙ্কারি, কোভিডের চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার বরাত নেওয়া কেলেঙ্কারির তদন্ত আজও শুরু হয়নি,কারণ হেমন্ত বিশ্বশর্মা তদন্ত এড়াতেই কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে চলে গিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের অজিত পাওয়ার এন সি পিতে থাকার সময় প্রতিনিয়ত অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদি তাঁকে ভ্রষ্টাচারী বলে গালিগালাজ করতেন। আজ মহারাষ্ট্রের বিজেপি শিবসেনা (অজিত পাওয়ার ) গোষ্ঠীর সমর্থনে চলা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ সরকারের প্রধান শরিক দলের নেতাকে নিয়ে নীরব বিজেপি। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের অশোক চ‍্যবন থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের শুভেন্দু অধিকারী কাউকেই বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে আর তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়নি। দুর্নীতিকে ব‍্যবহার করে এই ধরণের নির্লজ্জ রাজনৈতিক কৌশল ভারতের রাজনীতিতে সম্ভবত নজির বিহীন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতার আবার সেই কৌশলকেই সামনে আনল। কিন্তু এই অনৈতিক পদক্ষেপের ফলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এককাট্টা হয়ে নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ তুলেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পাল্টা সমালোচনার করে ভারত সরকার মুখরক্ষার চেষ্টা করলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একনিষ্ঠ লড়াইয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে পরিচালিত বিজেপি সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দেশের অভ‍্যন্তরে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তার প্রভাব লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।