আশা এক মিলিয়নেরও বেশি মহিলা স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত৷ গত 22 মে,2022 রবিবার 75 তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)’র মঞ্চে ১০ লক্ষ আশাকর্মীকে কুর্নিশ জানাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আশা কর্মীদের “কর্মী হিসাবে” স্বীকৃতি না দিলেও রবিবার সম্মানিত হতেই সোমবার তড়িঘড়ি তাঁদের টুইটারের মাধ্যমে সূদূর জাপান থেকে অভিনন্দন বার্তা পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় আশা কর্মীরা সামাজিক স্বাস্থ্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করে 2006 সালে এবং পশ্চিমবঙ্গের পথ চলা শুরু হয়। সেই সময় থেকেই বাম গণ সংগঠন CITU তাদের লড়াইয়ে সঙ্গী হিসাবে পথ চলতে শুরু করে। তাঁরা কেবলমাত্র কাজের ভিত্তিতে উৎসাহ ভাতা পেতেন , যা তাদের জীবন অতিবাহিত করা তো দূরের কথা সামান্য হাত খরচা টুকু পূরণ করা দূর্বিসহ হয়ে উঠেছিলো।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আশা কর্মীদের এই ভাতা ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা করেছে। অনেক রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তাদের নিজ নিজ বাজেট থেকে আশা কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট মাসিক ভাতা চালু করেছে। আশা কর্মীদের উৎসাহিত করতে এবং তাঁদের সুরক্ষার জন্য সরকার বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করলেও তা বাস্তবে রূপান্তরিত হয়নি আজও। সরকার ২০১৮ সালে আশা কর্মীদের জন্য বেশ কিছু প্যাকেজের কথা ঘোষণা করে। সেই কথা রাজ্যসভায় এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনীকুমার চৌবে এই তথ্য জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বীমা যোজনায় আশা কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনা, প্রধানমন্ত্রী শ্রমযোগী মানধন যোজনা প্রভৃতিতেও তাদের যুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় আশা কর্মীদের বীমা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে কোভিড সংক্রান্ত কর্তব্য পালন করতে গিয়ে জীবনহানি ঘটলে ৫০ লক্ষ টাকা পরিবার পাবে। সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিগত প্রায় দুবছর ধরে অন্যান্য ফ্রন্ট লাইন কর্মীদের সাথে ৫৫ হাজার আশা কর্মী কোভিড পর্বে তৃণমূল স্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজ নিরলসভাবে প্রদান করেছেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। অথচ কোভিড-পর্বে সামান্য মাস্ক-স্যানিটাইজারটুকুও সরকার বরাদ্দ করেনি। যে সামান্য ভাতা বরাদ্দ রয়েছে, তা-ও বকেয়া থাকে মাসের পর মাস। বহুদিন ধরেই আশাকর্মীরা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানালেও কোনও সরকারই তাতে এখনও পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি। ২0২১ আগস্ট মাসে, দেশের বিভিন্ন স্থানে আশা কর্মীরা তাদের কাজের অবস্থা তুলে ধরতে দুই দিনের ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। আশা কর্মচারি ইউনিয়নের উত্তরপ্রদেশ ইউনিটের রাজ্য সভাপতি বীণা গুপ্তা বলেছেন, “বেশিরভাগ আশা কর্মীরা, ফ্রন্টলাইনে থাকা এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল হওয়া সত্ত্বেও, সুরক্ষামূলক গিয়ার (পিপিই) পাননি। আমাদের এলাকার কর্মীদের কোনো তথ্য ও প্রশিক্ষণের উপকরণ দেওয়া হয়নি। ঠিক একি দাবী CITU অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য ইউনিয়নের। মোট ১৬ দফা দাবিকে সামনে রেখে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনে নেমেছেন তারা। সেই আন্দোলনকে দমাতে বিজেপি’র সরকার এসমা জারি করেছিল।

দেশজুড়ে ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন ৬ লক্ষ আশাকর্মী। তাঁরা জেল ভরো কর্মসূচিরও ডাক দিয়েছেন। করোনা সংক্রান্ত সচেতনতা প্রচার থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোভিড আক্রান্তদের খোঁজখবর, সবই করেছেন আশাকর্মীরা। কিন্তু ন্যূনতম সুরক্ষা পর্যন্ত তাঁরা পাননি। প্রয়োজনীয় সুরক্ষার অভাবে কয়েকজন আশা কর্মী করোনায় প্রাণও হারিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আশা কর্মীরা মাসে ১ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। শ্রমিক সংগঠনগুলি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ” অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড-ডে মিল, সমগ্র শিক্ষা-সহ সমস্ত স্তরের কর্মীদের দাবিপূরণের জন্য অগস্টের ৭ ও ৮ তারিখ ধর্মঘট। আশা কর্মীদের দাবি, লকডাউন পর্বে তো বটেই, করোনা পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজের কোনও মূল্য সরকার দিচ্ছে না। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক ইসমত আরা খাতুন বলেন, ‘‘স্বেচ্ছাশ্রমিক নাম দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করানো হলেও কোনও মর্যাদা নেই। প্রসূতি মা ও সদ্যোজাতকে পরিষেবা দেওয়াই তাঁদের কাজ। কিন্তু অভিযোগ, তা ছাড়াও বিভিন্ন কাজে তাঁদের পাঠানো হয়। তার সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনও যোগ থাকে না। করোনা পরিস্থিতিতেও তাঁদের কাজ করতে হয়েছে। তা-ও দীর্ঘ দিন ধরে তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেই অভিযোগ আশা কর্মীদের। ধিকি ধিকি জ্বলছিল ক্ষোভের আগুন। এবার তা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সমকাজে সমবেতনের দাবিতে। প্রসঙ্গত, আশা কর্মীদের বিক্ষোভ আজকে নতুন নয়।


এর আগেও CITU অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য ইউনিয়নের উদ্যোগে এপ্রিলে ২০১৩ , এপ্রিল ২০১৭, সেপ্টেম্বর ২০১৮, ফেব্রুয়ারী ২০১৯ এবং নভেম্বর ২০২০ তে আমরা জয় ছিনিয়ে নিয়েছি। সেই আন্দোলনের জেরে এখন পশ্চিমবঙ্গের আশাকর্মীরা মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা সমেত ১০০ টাকা মোবাইল বিল , টর্চ, ছাতা এবং বছরে দুটো ইউনিফর্ম পেয়ে থাকে। এবং আন্দোলনের ফলে আগে সরকারী ছুটি থাকলে ইন্সেটিভ কেটে নেওয়া হতো যা এখন আর কাটা হয় না। এবং তাদের সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হতো সেটাও বদলানো গেছে। তারপরেও বারে বারে একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।


সেই সমাধান পথ খুঁজতে একাধিকবার রাজ্যে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সামিল হয়েছেন আশা কর্মীরা। এই লড়াই সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় সরকার স্বাস্থ্যের বিষয়ে জবাবদিহিতার প্রশ্নে কিছু চমকপ্রদ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। সেপ্টেম্বরে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বলেছিলেন যে মন্ত্রক কোভিড -19-এ আক্রান্ত এবং মারা যাওয়া ডাক্তার, নার্স, সহায়তা কর্মী এবং আশা কর্মী সহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সংখ্যার তথ্য সংরক্ষণ করেনি। কিন্তু কেনো তার সঠিক উত্তর আজও মেলেনি। সমস্ত পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করেই বিগত ৩ জানুয়ারি ২0২২ CITU অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য ইউনিয়নের উদ্দ্যোগে স্বাস্থ্য ভবনে আবারও কিছু নির্দিষ্ট দাবী নিয়ে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ৭ জানুয়ারি ২0২২ কলকাতায় বিশালাকার বিক্ষোভ সমাবেশ হয় এবং ১২ ফেব্রুয়ারি রাজভবন অভিযানের ডাক দিয়েছিলো ‘ CITU অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য আশা কর্মী ইউনিয়ন’। এমনকি, স্বাস্থ্য ও রোজগারের সুরক্ষাও নেই, কেন্দ্রও বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে তাই, এই সমস্ত বিষয়কে নিয়ে রাজ্যপালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবিপত্র পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে’।


” তাই আশা শুধুই লড়াকু মানুষের জীবনসংগ্রামের স্বীকৃতিই আদায় করেনি, নিজেদের শ্রমশক্তির বিনিময়ে সবার ভালো থাকার লড়াইয়েও ভরসা দিয়েছে – আশা তাই সকলেরই।”

পর্শিয়া ভট্টাচার্য
2/6/22