অশোক স্তম্ভকে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই স্তম্ভের নিচে লেখা রয়েছে “সত্যমেব জয়তে”। অথচ অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভের সাথে সত্যমেব জয়তের কোনো যোগাযোগই নেই। তবুও কেন অশোক স্তম্ভের উপর এমনটা লেখা হলো? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে খুঁজতে যা পেলাম তা বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্যই এই আলোচনা ।


 পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজাদের মধ্যে সম্রাট অশোক ছিলেন অন্যতম। নেপোলিয়ানকে যেমন শ্রেষ্ঠ রাজাদের মধ্যে ধরা হয় তাঁর রণকৌশলের জন্য। ঠিক তেমনই সম্রাট অশোককে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে তাঁর মৈত্রী, প্রেম ও শান্তির নীতিকে কার্যকরী রূপ দেওয়ার জন্য। জনগণের মানসিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য প্রচলিত রীতি নীতির আমূল পরিবর্তন করে এক মহৎ আদর্শের নজির স্থাপন করেছিলেন তিনি। অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আসলে মানুষকে ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা, লোভ, হিংসা দ্বেষ, মোহ ইত্যাদি থেকে মুক্ত করে কিছু নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি।

 
তিনি কেমন ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন এবং কেমন ভাবেই বা এই ভালোবাসা, মৈত্রীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন দেশ থেকে দেশান্তরে তা জানা যায় তাঁর শিলালিপিগুলির মাধ্যমে। 


ছবি: এক – [প্রথম ছবিতে আমি সম্রাট অশোকের তেরো নম্বর শিলালিপির শেষের কিছু অংশ তুলে ধরলাম। এটি দক্ষিণ ভারত থেকে পাওয়া গিয়েছে। ]


বঙ্গানুবাদ: “…আমার পুত্র ও পৌত্রদের জন্য এই লিপি রক্ষিত হলো। তারা যেন সামরিক শক্তি দ্বারা পররাজ্য জয়ের যুদ্ধে লিপ্ত না হয়।”
সুতরাং স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে কি অসীম দয়া, দান, সত্যবাদিতা, সংযম, অহিংস, গুরুজন ভক্তি, সহনশীলতা, ক্ষমা, সুব্যবহার, সৎ ও নির্মল জীবন, স্নেহশীলতা প্রভৃতি নৈতিকতাগুলিকে তিনি সারা রাজ্যে ও বাইরেও প্রচার করেছিলেন তাঁর শিলালিপিগুলির মাধ্যমে। পাথর, শিলাস্তম্ভ, গুহা ইত্যাদিতে খোদাই করে জনসাধারকে এই আদর্শগুলো মান্য করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রাকৃত ভাষায় (চালু ভাষা) এই সমস্ত শিলালিপিগুলি লেখা হয়। সে সময় সংস্কৃত ভাষা চালু থাকলেও আম জনতা কিন্তু কথোপকথন করতেন প্রাকৃত ভাষায়। অর্থাৎ লোকমুখে প্রচলিত ভাষা। এই প্রাকৃত ভাষাগুলির মধ্যে পালি ভাষা ছিল অন্যতম। মূলত বৌদ্ধ সাহিত্যে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। 


তাই, ভারতের সরকারি মোহরে অশোক স্তম্ভের নিচে #সত্যমেব_জয়তে দেখে অবাক লাগে। অশোকের সামান্য কিছু শিলালিপি বৌদ্ধ সংকর সংস্কৃত ভাষায় থাকলেও বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় একটিও শিলালিপি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। #সত্যমেব_জয়তে রাষ্ট্রীয় এই নীতি বাক্যটির মানে হলো, “সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী”। আসলে এই নীতি বাক্যটি #মুন্ডক_উপনিষদের একটি শ্লোক। 


মুন্ডক উপনিষদের মূল মন্ত্রটি ছিল এই রকম-
सत्यमेव जयते नानृतंसत्येन पन्था विततो देवयानः ।येनाक्रमन्त्यृषयो ह्याप्तकामायत्र तत् सत्यस्य परमं निधानम्।
বাংলা প্রতিলিপিকরণ================
সত্যমেব জয়তে নানৃতংসত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।যেনাক্রমন্ত্যৃষয়ো হ্যাপ্তকামাযত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্‌।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত #মদন_মোহন_মালব্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় উপনিষদের এই মন্ত্রটিকে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে এসে জনপ্রিয় করেন। বর্তমানে এই মন্ত্রটি দেবনাগরী হরফে ভারতের জাতীয় প্রতিকের নিচের অংশে লেখা থাকে। কিন্তু অশোক স্তম্ভে দেবনাগরী হরফের প্রয়োগ কোথাও দেখা যায়নি। সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষটি (যা বর্তমানে জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়) আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সারনাথে একটি অশোক স্তম্ভের উপর স্থাপন করেন সম্রাট অশোক [ছবি: দুই]। 


এই স্তম্ভশীর্ষ পালিশকরা একটি একক বেলেপাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। অশোক স্তম্ভটি ও স্তম্ভশীর্ষটি দুইটি ভিন্ন পাথরের টুকরো দ্বারা নির্মিত। এই স্তম্ভশীর্ষে চারটি এশীয় সিংহ পরস্পরের দিকে পিঠ করে চারদিকে মুখ করে বসে রয়েছে। এই চারটি সিংহ যে ভিত্তিভূমির ওপর দন্ডায়মান সেখানে একটি হাতি, একটি ঘোড়া, একটি ষাঁড় ও একটি সিংহের মূর্তি খোদিত রয়েছে, যাদের মধ্যে একটি করে ধর্মচক্র খোদিত রয়েছে। এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি একটি ঘণ্টাকৃতি পদ্মের ওপর স্থাপিত। সম্ভবত এই স্তম্ভশীর্ষের ওপর একটি ধর্মচক্র ছিল, যার কিছু টুকরো ঐ স্থানে পাওয়া গেছে। সারনাথের অশোক স্তম্ভ ও এই স্তম্ভশীর্ষের একটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত প্রতিরূপ থাইল্যান্ডের ওয়াট উমোং মন্দিরে রাখা আছে, যেখানে ধর্মচক্র বা অশোক চক্র স্তম্ভশীর্ষের ওপর রয়েছে।

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে ইংরেজ প্রকৌশলী ফ্রেডরিখ অস্কার ইমানুয়েল ওয়ের্টেল সারনাথ অঞ্চল খননের দায়িত্ব পান। তিনি প্রথমে মূল স্তূপের পশ্চিমে অশোকের আমলের এক স্থাপত্যের ওপর নির্মিত একটি গুপ্ত যুগের মন্দিরের অবশেষ খুঁজে পান। এর পশ্চিম দিকে তিনি অশোক স্তম্ভের নিচের ভাঙ্গা অংশটি আবিষ্কার করেন। অশোক স্তম্ভটির বাকি অংশ তিনটি ভাগে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর অশোক স্তম্ভটির শীর্ষ ভাস্কর্য্য খোঁজার চেষ্টা করা হয় এবং অদূরেই সেটিকে পাওয়া যায়। সাঁচী থেকে প্রাপ্ত অনুরূপ সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষের চেয়ে সারনাথে আবিষ্কৃত ভাস্কর্য্যটি তুলনামূলক ভাবে যথেষ্ট ভালো অবস্থায় ছিল। শীঘ্রই উৎখননের স্থানে সারনাথ সংগ্রহালয় স্থাপন করে আবিষ্কৃত প্রত্নসামগ্রীর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। 
গৌতম বুদ্ধ তাঁর ধর্মমত প্রচার করেছিলেন পালি ভাষায়। বুদ্ধ ধর্ম বিকাশলাভ করেছিল আর্য সভ্যতার (সংস্কৃতভাষী) মৌলিক বিষয়গুলিকে বিরোধিতা করে। সেই জন্যেই গৌতম বুদ্ধ পুতুল পুজো ও যোগ্যের চূড়ান্ত বিরোধিতা করেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় দুশো বছরের কিছু বেশি সময় পরে সম্রাট অশোক সিংহাসন লাভ করেন। সম্রাট অশোকের তাম্রশাসনে তাঁর “দেবনামপ্রিয়” নামটি পাওয়া যায়। যদিও “দেবনামপ্রিয়” অশোকে নাম না উপাধি এ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু তবে মাস্কি( ভারতের কর্ণাটকের স্থান) ও গুজার্রা ( মধ্যপ্রদেশ) অঞ্চলে প্রাপ্ত তাম্রশাসন অশোক ও দেবনামপ্রিয়কে একই ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছে।
 #মুন্ডকোপনিষদ বা #মুন্ডক_উপনিষদে রয়েছে কতকগুলি প্রশ্ন। কিন্তু এই উপনিষদে প্রশ্নকর্তা একজন। এই উপনিষদের নাম মুন্ডক কেন তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। বিশুদ্বানন্দের মতে, অথর্ব বেদের আঠাশটি উপনিষদের মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ; তাই এটি মুন্ড বা শিরঃ। আবার এটি অজ্ঞান ও অবিদ্যা নামক কেশরূপ অঙ্গকে মুন্ডন করে বলে এর নাম “মুন্ডকোপনিষদ” বলে অনেকে মনে করেন। এখন প্রশ্ন হলো, “অজ্ঞানতা” ও “অবিদ্যা” বলতে কি বোঝানো হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর এই উপনিষদের মূল ভাবধারার মধ্যেই রয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে-
“ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা, সত্যমেব জয়তে”
কি অদ্ভুত কথা! ‘ব্রহ্ম’ যা কেউ কোনো দিনও দেখেনি তা হলো ‘সত্য’ আর জগৎ অর্থাৎ প্রকৃতি (বিজ্ঞান) হলো ‘মিথ্যা’!  মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু ধর্মে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মন বলতে মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অক্ষন্ড সত্যের ধারণাকে বোঝায়। কিন্তু বিজ্ঞান (প্রকৃতি) আমাদের শিখিয়েছে, “শাশ্বত বা চিরন্তন সত্য বলে কিছু হয় না, আজ যা সত্য কালই তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে।” 


কিন্তু ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভের সাথে মুন্ডক উপনিষদের এই মন্ত্রটি যুক্ত করার প্রয়োজনীয় হলো কেন? বস্তুত পক্ষে অশোকের রাজত্ব কালের সমস্ত কার্যকলাপ ছিল অহিংস নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর মুন্ডক উপনিষদের মূল বার্তা থেকে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এখানে অপর এক পক্ষ বা মতাদর্শ রয়েছে যাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যেই “অজ্ঞান”, “অবিদ্যা” ইত্যাদি বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের ঘৃণা করো। তাঁদের প্রতি হিংস্রতামূলক, বিদ্বেষ মূলক প্রচার করো। যুক্তির কথা ও অপর পক্ষের কথা মটেও শুনো না। কেননা এটা ‘অবিদ্যা’। আর ধর্ম মতে ‘সত্য’ কোনটা, অশিক্ষা, বিজ্ঞান বর্জিত শিক্ষা! বিজ্ঞানের জগতে এটাকে কি সত্য বলে মানা যায়? না, মানা যায় না। এই সত্য, সত্য নয়। এই সত্যের জয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কখনোই চাইতে পারে না।


সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষটির সাথে “সত্যমেব জয়তে”-এর কোনো সংযোগ কস্মিনকালেও ছিলো না। এটাকে যুক্ত করা হয়েছে। এটাকি  ইতিহাসকে উপেক্ষা করে অবিজ্ঞানকে (পড়ুন হিংসাকে) প্রতিষ্ঠিত করা নয়? এভাবে কি আমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক শান্তির দূত সম্রাট অশোকেও অপমানিত করলাম না? এসব দেখে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে-“সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”___________________________________________
ছবি: এক- অশোকের শিলালিপি।
ছবি: দুই- সারনাথে অশোক স্তম্ভ 
ছবি: তিন- অশোক স্তম্ভ (ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক)