বাংলা গানের জগতের কিংবদন্তী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াণ, বাংলা সঙ্গীত জগতের একটি অধ্যায়ের অবসান ।সমাজসচেতন শিল্পীদের অন্যতম প্রতিনিধি অভিজিৎ বাবুর প্রাণের পর মনে হচ্ছে ,শিল্প যে কেবলমাত্র বিনোদনের বিষয় নয় ,তার সঙ্গে মানুষের জীবন সংগ্রামের দৈনন্দিনতার একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে, সেটা বোঝানোর মানুষ বোধহয় বাংলা গানের জগতে আর কেউ রইলেন না ।


বহু গীতিকার সারা জাগানো শব্দে বিপ্লব বিপ্লব গন্ধে গান লেখেন, কিন্তু সেই সব গানের অর্থের সঙ্গে তাঁদের জীবনবোধের সম্পর্ক খুব একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে সলিল চৌধুরী ,প্রবীর মজুমদারদের প্রজন্মের অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি তাঁর রাজনৈতিক আস্থার বিষয়টি সলিল চৌধুরী ,প্রবীর মজুমদার, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই কখনো গোপন করতেন না। তাই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে ,নিজের রাজনৈতিক বোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে ,প্রচলিত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মত মানুষ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো ছিলেন না।


গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমস্ত রকম বোধের প্রকাশের সঙ্গে সংযোগ রাখার ব্যাপারে ,জীবনে কখনো আড়াল করেননি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। যে রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে তাঁর বিন্দুমাত্র মানসিক সম্পর্ক নেই, সেই রাজনৈতিক বোধের মানুষদের সঙ্গে দন্ত বিকশিত করে, রাজপ্রাসাদের প্রসাদ ভিক্ষুক তিনি কখনো ছিলেন না। আজকের গোটা বিনোদন জগতের বেশিরভাগ মানুষ, শাসকের দ্বারা কোন না কোন ভাবে নিজেদের প্রভাবিত করে ফেলছেন। দেনা পাওনার হিসেব নিরিখে নিজের সৃষ্টিকে পরিচালিত করছেন ।এইরকম একটা অদ্ভুত আঁধারের মুহূর্তে যে সারেঙ্গিতা বাজিয়ে গেলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় , তা বহুকাল তাঁর মতো শক্ত মেরুদন্ডের মানুষদের মনের গহীনে বাজতে থাকবে, বাজতে ই থাকবে ।
সদ্যপ্রয়াত এক শিল্পীর রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে শাসক ঘনিষ্ঠতা ঘিরে অভিজিৎ দা কে একবার প্রশ্ন করেছিলাম ।অত্যন্ত মার্জিতভাবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, দিনবদলের গান গাইলেই তো কেউ আর দিনবদলের বোধে বিশ্বাসী মানুষ হয়ে ওঠেন না ।দিনবদলের বোধ তৈরি করবার জন্য চাই একটা পরিশীলিত অনুশীলন ।সেই পরিশীলিত অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে মানুষ যদি নিজের শিল্পীসত্তাকে ,শৈল্পিক বোধকে এগিয়ে নিয়ে না যেতে পারে ,তাহলে সে ভাল পারফর্মার হতে পারে নিশ্চয়ই ,কিন্তু কখনও তাঁকে শিল্পী বলতে পারা যায় না ।সেই অর্থে বাংলা গানের জগতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস কলিম শরাফী, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখদের যে শিল্পী হিসেবে সমসাময়িককালের বহু পারফরমারদের থেকে অনেক উঁচুতে তিনি স্থান দিতেন, সে কথা বলতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো কোন রাখঢাক রাখেননি ।


আসলে তাঁর সৃষ্ট গানের মতোই তাঁর বোধের জায়গাটা ছিল ভীষণ খোলামেলা সেখানে কোন আড়াল আবডাল দিয়ে নিজের বোধকে লুকিয়ে রেখে ,ভাবের ঘরে চুরি করবার মতো মানুষ কখনোই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন না। তাই নিজের বহু দুঃখ যন্ত্রণা সত্বেও, কখনো কোনদিন ,তা সে বাম জমানা ই হোক, বা পরবর্তী কালের শাসনব্যবস্থা ই হোক ,শাসকের কাছে নতজানু হয়ে তিনি প্রসাদ ভিক্ষা করেন নি। আসলে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রা আসেন কোন কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় নয় ।তাঁরা তাঁদের সৃষ্টিকে মানুষের জন্য উজাড় করে দেওয়ার জন্যই বোধহয় জন্মগ্রহণ করেন ।নশ্বর পৃথিবী থেকে যখন তাঁরা বিদায় নেন ,তখন ধন-দৌলত ,গান স্যালুট ,কোনকিছুর পরোয়া করেন না ।রেখে যান নিজের সৃষ্টিতে ।যে সৃষ্টি র সারেঙ্গীটা বেজেই চলে।
গণনাট্য, আই পি টি এ এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের সংস্কৃতিক বোধকে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এবং সলিল চৌধুরী কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন ।জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র কে যখন বর্তমান প্রজন্ম প্রায় ভুলে যেতে বসেছে, তখন কলিম শরাফী প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সে গাইলেন আবার,’ নবজীবনের গান ‘।সে গান শুনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যে কতটা খুশি হয়েছিলেন তা বলে বোঝানো যায় না। কলিম- অভিজিৎ, দুজনেই তখন সরোজিনী নাইডুর সেই মূল্যায়নে মেতে উঠেছিলেন সরোজিনী নাইডু ,নবজীবনের গান শুনে বলেছিলেন; রবীন্দ্রনাথের পরে ,এত ভালো বাংলা কম্পোজিশন আর হয়নি ।


মজা করে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বলেছিলেন, তিনি যদি সলিল ,প্রবীর, এঁদেরকে দেখে যেতেন একটিবারের জন্য ।কিন্তু তিনি নিজের কথা বললেন না। বললেন সলিল চৌধুরী ,প্রবীর মজুমদার প্রমুখ দের কথা। এই যে আড়াল না রেখেই নিজের আত্মপ্রচার থেকে শতহস্ত দূরে থাকা ,এটাও কিন্তু ছিল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ।এই বৈশিষ্ট্যটা কিন্তু তাঁর সমসাময়িক কালের আর একজন গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেও ছিল অত্যন্ত প্রবল।
সুরের বৈচিত্র নির্মাণে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় কন্ঠ সম্পদের অনুশীলনকে সবথেকে গুরুত্ব দিতেন। খানিকটা হয়তো দুঃখ পেয়েছিলেন আজকের প্রজন্মের কণ্ঠ সম্পদের অনুশীলন ছাড়া , এই স্টেজ এবং রেকর্ডিং এর ব্যাপার গুলো দেখে। এই প্রসঙ্গে অভিজিৎ বাবুকে আমি শ্যামল গুপ্তের জীবনের একটি ঘটনা বলেছিলাম। আজকের প্রজন্মের এক খ্যাতনামা শিল্পী এসেছেন শ্যামল গুপ্ত – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ।সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য ছাদের উপরে নিজের হাতে করা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন ।সেই সময়ে, সেই নবীন শিল্পী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কে অনুরোধ করলেন ,একবার ,’গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু ‘ গান টার একটা কলি গেয়ে শোনাতে।
প্রায় সাতাত্তর,আটাত্তর বছর বয়সেও ,একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে সন্ধ্যায যখন ওই গানটির কুহুতান বিস্তার করলেন ,নবীন শিল্পী তো বিস্ময়ে হতবাক।শ্যামল গুপ্ত তখন কিন্তু তাঁর স্বভাবসুলভ কাটা কাটা ভাষায়, ওই নবীন শিল্পী কে বললেন; আর যাই হোক তোমরা কিন্তু কখনো হেমন্ত মুখার্জী হতে পারবে না।


এই কঠিন কঠোর বাস্তব কথাটা শুনে সেই শিল্পী হয়তো একটু বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু শ্যামল গুপ্ত, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রজন্মটি কিন্তু সত্যি কথা বলতে কখনও দ্বিধাবোধ করতেন না।চিরন্তন সত্যকে আড়ালে রেখে, একটা ক্যামোফ্লেজিং চরিত্র হিসেবে নিজেদের কখনো মেলে ধরতেন না। তাই অভিজিত বাবুর মৃত্যুর অবহিত পরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে ,শাসক ঘনিষ্ঠ এক দল শিল্পী ,তাঁরা অভিজিত বাবুর গান ইত্যাদি নিয়ে বহু আলোচনা করলেও, প্রত্যক্ষভাবে বামপন্থী গণ আন্দোলন সংগ্রাম চিন্তা চেতনার সঙ্গে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে একান্ত সংযোগ ,সেই বিষয়টিকে কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন ।


বামপন্থী মানে কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন ই একমাত্র বোঝায় না ।বামপন্থা মানে কিন্তু একটি আদর্শের প্রতি ভালোবাসা ।মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা ।সেই জায়গাটি কিন্তু অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গোটা জীবন ধরে দেখিয়ে গিয়েছেন ।অথচ অভিজিতের চরিত্রের এই উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য থেকে আড়াল করেই ,কেবল মাত্র তাঁর সুরারোপিত দুটো চারটে গান নিয়ে আলোচনা ,এই খণ্ড ক্ষুদ্র করে দেখার যে মানসিকতা ,তা সদ্য প্রয়াত একজন শিল্পীকে কতটা সম্মান প্রদর্শন করবে, সে প্রশ্নের মধ্যে না হয় নাই বা আমরা প্রবেশ করলাম ।
আসলে শিল্প আর শিল্পীকে একটা শ্রেণী চেতনার মধ্যে দেখার অভ্যাস শাসকের চিরদিন আছে। সেই শ্রেণিচেতনা তাগিদ থেকেই আমরা দেখতে পাই, সদ্যপ্রয়াত এক প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শেষ যাত্রায় শাসক শিবির যে আচরণ করলেন, তাতে অনেক মানুষের এই ধারণা হলো যে, এটা কি শোক মিছিল? না ,কোন ব্যক্তি বিশেষের রাজনৈতিক প্রচারের রোড শো? সেই একই প্রশ্নটা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘিরে আবার উঠে আসছে।
আজন্ম শ্রেণীসংগ্রামের চেতনায় নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষের মৃত্যুতে, তাঁর শ্রেণী চেতনার দিকটি কে অস্বীকার করে ,কেবলমাত্র তাঁর সৃষ্টি করা দুটো চারটে গান নিয়ে আলোচনা করে, তাঁকে ‘মেসোমশাই’ পিসেমশাই’ বলে সম্মোধন করলেই কি এই গোটা কার্যক্রমের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে? শিল্পের ভেতর দিয়ে, সাহিত্যের ভেতর দিয়ে, সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে ,মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রামকে তুলে ধরতে পারা যাবে না – এটাই হলো শাসকের মূল উপপাদ্য বিষয় ।


তাই শাসক কখনো শ্রেণীর চিন্তার পরিচয়বাহী সৃষ্টিকে দিনের আলোর সামনে আসতে দেবে না ।আমরা জরুরি অবস্থার সময় দেখেছি ,শাসক সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে এনে, এই মানুষের দৈনন্দিন রুটিরুজির প্রশ্ন সংস্কৃতি জগতে তোলা হলে, সেই জগতকে অবরুদ্ধ করবার জন্য সচেষ্ট হতো আর এখনও অ ঘোষিত জরুরি অবস্থার সময় দেখছি ,সরাসরি নিষিদ্ধকরণের ফরমান জারি না হলেও, জরুরি অবস্থার সময়কালের থেকে আরো ভয়ঙ্কর ভাবে ,আরো রাজনৈতিক ক্রুড়তার সঙ্গে ,সংস্কৃতি র ভেতর দিয়ে ,মানুষ কে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির দিক টি কেচে গন্ডুস করে দেওয়া হয় – এটাই হলো এই রাজনীতির অংশ।অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ,তাঁকে ঘিরে মূল ধারার প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোতে যে ধরনের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এই কথাগুলি বারবার উঠে আসছে।